একজন খৃস্টানের জানাযা কিভাবে পড়া হবে?
ফয়জুল্লাহ আমান ❑ হ্যান্সন ক্রুজো। ৪৫ বছর বয়সের একজন ইতিলায়িান যুবক। পেশায় গ্রাফিক্স ডিজাইনার। সিডনিতে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মূল ইতালির হলেও দীর্ঘ দিন ধরে অস্ট্রেলিয়াতে রয়েছেন। মূলত তার বাবাই এখানে প্রবাসী হন প্রথম। এখন সিডনিতে তাদের বিরাট পরিবার। তার শ্যালকের বন্ধু এক মুসলিম। দীর্ঘ দিন ধরেই সে তাকে ইসলামের কথা বলত। ছেলেটি লেবানিজ আরব। সাআদ হামুদ নামক সেই মুসলিম তার নিকট ইসলামের সৌন্দর্যের কথা তুলে ধরত। বিভিন্ন সময় ইসলামের নবীর কথা বলত। প্রিয় নবীজীর কথা শুনে সে মুগ্ধ হতো।
চার পাঁচ বছর হয় সে ক্যান্সারে আক্রান্ত। অসুখ দিন দিন বাড়ছে। যে কোনো সময় মৃত্যু এসে যাবে। অক্টোবরের শুরুর দিকেই প্রচন্ড অসুস্থতার ভেতর সাআদ হামুদকে খবর দিয়ে তার বাসায় আনালো। ক্রুজো বললো, সে ইসলাম গ্রহণ করতে চায়। সাআদ আরও দুজন আরব বন্ধু নিয়ে ক্রুজোর বাসায় এসেছিল। শাহাদাহ পাঠ করলো পরপর তিনবার। অর্থসহ বুঝে সজ্ঞানে সে শাহাদাহ পাঠ করেছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এর পর পরই ক্রুজোর জবান বন্ধ হয়ে যায়। চিরদিনের জন্যই জবান বন্ধ। একটি কথা বলার ক্ষমতা নেই তার। তিন আরবের সামনেই সে আর কথা বলতে পারে না। আমাকে তখনই মাসআলাটি জিজ্ঞেস করেন সিডনির এক ইমাম। ক্রুজো এখন মারা গেলে তার জানাযা পড়া যাবে কি না? সে যে মুসলিম হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরিবার কট্টর ক্যাথলিক খৃস্টান। তারা কোনোভাবেই লাশ মুসলিমদের হাতে দিবে না।
পাঠককে আমাদের নও মুসলিম ভাইয়ের মৃত্যুর দুঃসংবাদটি দিয়েই আলোচনা শুরু করব। এই গত ২৭ অক্টোবর আমাদের মুহাম্মদ ক্রুজো ইন্তিকাল করেন। তার নাম বদলে রাখার সুযোগও পাওয়া যায়নি। লেবানিজরা তাকে মুহাম্মাদ ক্রুজো বলেই স্মরণ করছে।
আমরা যদি এর জানাযা না পড়ি তাহলে দুনিয়াতে আর কেউ নেই যে এই মুসলিম ভাইটির জানাযা আদায় করবে।
সিডনির ইমাম মাওলানা মাহমুদ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হানাফি মাযহাব অনুসারে এই নওমুসলিমের জানাযা পড়ার কি হবে? লেবানিজ তিন আরও হানাফি। মাওলানা মাহমুদও হানাফি। সিডনির মুসলিম কমিউনিটিতে অনেক মুসলিম থাকলেও এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ বিষয়ে অন্যদেরকে সম্পৃক্ত করার মত অবস্থা সেদেশে নেই। ঝামেলা এড়াতে আসলে কী করা উচিত? মুসলিমদের গোরস্থানে দাফন হতে দিবে না ক্রুজো পরিবার। জানাযা পড়ার জন্য লাশও দিবে না। অথচ জানাযা পড়া ফরজে কেফায়া। হানাফি মাযহাব অনুসারে গায়েবানা জানাযা পড়ার অবকাশ নেই। ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর মতে জানাযা গায়েবানাও পড়া যায়।
মাওলানা মাহমুদ বলছে, আমরা যদি এর জানাযা না পড়ি তাহলে দুনিয়াতে আর কেউ নেই যে এই মুসলিম ভাইটির জানাযা আদায় করবে। এ অবস্থায় কী করণীয়?
লাশ সামনে না থাকলেও জানাযা পড়ার বিষয়ে রাসূল সা.-এর সীরাতে একটি ঘটনাই পাওয়া যায়। হাবশা, বর্তমান ইথিওপিয়ার বাদশা নাজাসি ইন্তিকাল করেন নবম হিজরি সনে। রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তখন গায়েবানা জানাযা আদায় করেন। গায়েবানা জানাযার এ একটি ঘটনাই রয়েছে হাদীসের কিতাবে। এ হাদীসের ভিত্তিতেই ইমাম শাফেয়ী রহ. যে কোনো মুসলিমের গায়েবানা জানাযার পক্ষে মত দিয়েছেন।
ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, নবীজীর যুগে বহু সাহাবি মদীনার বাইরে ইন্তিকাল করেছেন। কই, রাসূল সা. তো আর কারও জন্য এভাবে গায়েবানা জানাযা পড়েননি? কাজেই এ একটি ঘটনার কারণে যে কোনো মুসলিমের মৃত্যুতে গায়েবানা জানাযা পড়ার অবকাশ নেই। সেখানে রাসূল সা.-এর সামনে অলৌকিকভাবে নাজাসির লাশ এনে রাখা হয়েছিল। তাই এটি গায়েবানা নয়, লাশ সামনে রেখেই জানাযা হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ার ঘটনাটির পর আমার মনে হচ্ছে নাজাসির বাদশার সাথে এ ঘটনাটির একটি মিল রয়েছে। মূলত হাবশায় একমাত্র মুসলিম ছিলেন আসহামা নাজাসি। মক্কা মুকররমা থেকে সাহাবায়ে কেরাম হিজরত করে যাবার পর সেখানে বেশ কয়েকজন হাবশি লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তাদের কেউ নাজাজির ইন্তিকালের সময় উপস্থিত ছিল না।
সিরাতে ইবনু হিশাম গ্রন্থে লিখা হয়েছে, নাজাসির ছেলে আরিহাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। সপ্তম হিজরি সনেই সেখান থেকে নাজাসির ছেলে সহ বড় একটি কাফেলা যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা সবাই একটি জাহাজে করে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের সে জাহাজ সাগরে ডুবে যায়। একজনও সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারেনি।
নাজাসির জানাযা যদি রাসূল সা. না পড়তেন তাহলে তার জানাযা পড়ার মত পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না।
ইসলামের শুরুর যুগে যখন মক্কায় সাহাবায়ে কেরাম খুব নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন সে সময়ে নাজাসির সহযোগিতা ছিল মুসলমানদের জন্য বিরাট কিছু। সত্তরের অধিক সাহাবি সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের মাঝে রাসূল সা.-এর কন্য হযরত রুকাইয়াও ছিলেন। আরও ছিলেন হযরত জাফর তাইয়ার রা.।
রাসূল সা. ওহির মাধ্যমে জানতে পারেন হাবশার বাদশা ইন্তিকাল করেছেন। তার ইন্তিকালের খবর পেয়েই জানাযা পড়েন মদীনা মুনাওয়ারায় উপস্থিত সবকজন সাহাবিকে সাথে নিয়ে। এর কারণ হয়ত এই ছিল, নাজাসির জানাযা যদি রাসূল সা. না পড়তেন তাহলে তার জানাযা পড়ার মত পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না। হাবশার জনগণ ছিল কট্টর খৃস্টান। আজও পর্যন্ত ইথিওপিয়া ইরিত্রিয়ায় খৃস্টানরা সংখ্যা গুরু। সে হিসেবে এমন কোনো পরিস্থিতি হলে গায়েবানা জানাযা পড়ার অবকাশ থাকা উচিত।
কিন্তু আমি মাওলানা মাহমুদকে বললাম, অন্য আরেকটি সমাধান আছে ইসলামে। গায়েবানা যানাজা নয়, সরাসরি জানাযা পড়াই বরং ভালো হবে। রাসূল সা.-এর সীরাতে গায়েবানা জানাযার মাত্র একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে, আর সেটির ব্যাখ্যায় বিভিন্ন ব্যখ্যাও রয়েছে। ইমামদের মাঝে এ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। তাই ইখতিলাফে না গিয়ে অন্য সমাধান গ্রহণ করাই শ্রেয়।
আগ্রহভরে জানতে চাইলেন, কী সেই সমাধান? কী করতে হবে আমাদের?
বললাম, গোরস্থানে গিয়ে দুজন মুসলিম জানাযা আদায় করলেই জানাযা আদায় হয়ে যাবে। খৃস্টানদের কবরস্থানে ক্রুজোর কবর সামনে রেখে জানাযা পড়তে হবে। রাসূল সা. অন্তত তিনবার এভাবে কবর সামনে রেখে জানাযা পড়েছেন। এ নিয়ে কোনো মতানৈক্যও নেই। সব মাযহাবের ইমাম এ ব্যাপারে একমত। কোনো মৃত ব্যক্তির জানাযা না হলে তাকে কবরস্থ করার পর হলেও জানাযা আদায় করতে হবে। এটিই ইসলামী ফিকহের কথা। সবগুলো ফিকহ এব্যাপারে একমত।
রাসূল সা. সাহাবাদের নিয়ে সেই কবরের সামনে কেবলা মুখি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। যথারীতি জানাযা আদায় করলেন।
মসজিদে নববীতে এক হাবশি মহিলা ঝাড়ু দিত। মহিলা মারা গেল এক রাতে। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা.কে না জানিয়ে রাতারাতি তার দাফন দিয়ে দিলেন। সাধারণ হাবশি মহিলা বলে ভাবলেন, এটা রাসূল কে জানানোর প্রয়োজন নেই। বেশ কিছু দিন পর মদীনার পথে হাঁটতে গিয়ে নতুন কবরটি দেখতে পেয়ে রাসূল সা. বললেন, কার কবর এটি? সবাই বলল, সেই হাবশি মহিলার, যে মসজিদ ঝাড়ু দিত। রাসূল সা. বললেন, তোমরা আমাকে জানাওনি কেন? সাহাবিরা বললেন, মহিলা রাতে মারা গিয়েছিল। আপনাকে তখন কষ্ট দেওয়া ঠিক মনে হয়নি। রাসূল সা. সাহাবাদের নিয়ে সেই কবরের সামনে কেবলা মুখি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। যথারীতি জানাযা আদায় করলেন।
একই রকম ঘটনা ঘটেছে হযরত সাআদ ইবন উবাদা রা.-এর আম্মার মৃত্যুর পর। তাবুক থেকে ফিরেই জানতে পারেন তার মৃত্যুর কথা। এ মহিলারও কবরের সামনে মৃত্যুর একমাস পর জানাযা হয়।
তৃতীয় ঘটনাটি হচ্ছে ওহুদের শহীদদের। রাসূল সা. ইন্তিকালের কিছুদিন আগে ওহুদের শহিদদের কবর যিয়ারত করতে এসে তাদের জানাযা পড়েছিলেন।
এসব ঘটনা থেকে আমরা বলতে পারি, এধরনের কোনো পরিস্থিতি হলে, খৃস্টানদের গোরস্থানে গিয়েও জানাযা পড়া যায়। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নও মুসলিম ক্রুজোকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। লোকটি এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ারও সুযোগ পায়নি। তবু তো সে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য পেয়েছে। আমরা আশা করি আল্লাহ তার ইসলাম গ্রহণকে কবুল করে নিবেন। এবং পরকালে তাকে জান্নাতবাসী করবেন।
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক