একটি সহজ সমীকরণ | আল আমিন মুহাম্মাদ

একটি সহজ সমীকরণ | আল আমিন মুহাম্মাদ

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে নাকাল পুরো ঢাকাবাসী। গরমের প্রকোপে জনজীবনে নেমে এসেছে একপ্রকার স্থবিরতা। রাস্তার ধারে মরে পড়ে আছে কয়েকটা কাক। রৌদ্রের প্রখর তাপে। এই রোদের একটা নাম রয়েছে, ‘কাকমরা রোদ’। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নগরবাসীও ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। যারা বের হয়েছেন, কেউ স্বীয় কর্মস্থলের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। কেউ আবার স্কুল কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। যাইহোক, এই আচমকা দৃশ্যপট সায়বাদ থেকে গাজীপুরগামী তুরাগ বাসের জানালা দিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ঢাকাবাসীর করুণ অবস্থার কথা। আমার সীট ছিল বাসের পেছনের সারির ডানদিকে। জানালার পাশে। হঠাৎ গাড়ির মধ্যে হৈ-চৈ, হট্টগোলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। সামনে চেয়ে দেখি যাত্রীরা তাড়াহুড়া করে দৌড়ে গাড়ি থেকে নামছে। বেশ শঙ্কায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম, হয়ত কেউ ককটেল মেরেছে। কয়েক সেকেন্ডে বিভিন্ন অদ্ভুত ভাবনায় ছেয়ে গেল পুরো হৃদয়। আমিও দৌড়ে বাস থেকে নেমে গেলাম। দেখলাম, এক জীর্ণশীর্ণ যুবকবয়সী ছেলেকে যাত্রীরা বেধড়ক কিল ঘুষি, লাথি উষ্ঠাসহ সবধরনের উত্তমমধ্যম প্রয়োগ করছে। আল্লাগো, মাগো করে চিৎকার করছে সে। পাশে এক ব্যক্তি হাঁপাচ্ছিলেন। তার কাছে ব্যাপারটা জানতে চাইলে তিনি বললেন, পকেটমার ধরা পড়েছে। তাকে মেরে একেবারে ক্লান্ত। এই জন্যই হাঁপাচ্ছি। চাইলে আপনিও আপনার শক্তির জানান দিতে পারেন। ব্যাপারটা দেখে খুব খারাপ লাগল।

ছেলেটার নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এলো। ছেলেটাকে পিকাপে উঠিয়ে নিল। লক্ষ্য করলাম কিছুদূর যাওয়ার পরই পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে তাকে। বুঝতে আর বাকি রইল না। হয়তো থানায় নিয়ে গেলে চিকিৎসা করাতে হবে বা মোটা অংকের টাকা ঘুষ খেতে পারবে না। এজন্যই হয়ত বেচারাকে নামিয়ে দিয়েছে। জানি না, মুফতেও ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারে। এজন্যই হয়ত বেচারাকে নামিয়ে দিয়েছে।


লক্ষ্য করলাম কিছুদূর যাওয়ার পরই পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে তাকে। বুঝতে আর বাকি রইল না। হয়তো থানায় নিয়ে গেলে চিকিৎসা করাতে হবে বা মোটা অংকের টাকা ঘুষ খেতে পারবে না। এজন্যই হয়ত বেচারাকে নামিয়ে দিয়েছে। জানি না, মুফতেও ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারে। এজন্যই হয়ত বেচারাকে নামিয়ে দিয়েছে।


যাইহোক, আমি আর সেই বাসে উঠলাম না। হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দিয়ে ছেলেটার দিকে অগ্রসর হলাম। নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল তার। ধরে পাশের এক ফার্মেসীতে নিয়ে গেলাম। ফার্মেসীয়ান রক্ত মুছে ক্ষতচিহ্নে ঔষধ লাগিয়ে দিলেন। বেশ ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছিল তাকে। বললাম কিছু খাবেন? কিছু বলছিল না সে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল খাবে। রাস্তার ঐ পাড়ে ছিল খাবার হোটেল। নিয়ে গেলাম তাকে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলাম। সেও ঝটপট উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। যখন বললাম, মানুষের পকেট মারেন কেন?

জবাব দিল, এ ছাড়া কি আর করব?

কেন কাজ করে খেতে পারেন না?

দুই বছর চাকরির জন্য ঘুরেছি। চাকরি পাইনি। পড়াশুনা করেছেন?

ইন্টার পর্যন্ত পড়েছি।

তাহলে এই পথে কিভাবে আসলেন?

পড়াশুনা করেও যখন কাজ পাচ্ছিলাম না তখন পরিবার লোকজন বেশ খারাপ আচরণ শুরু করে দিল। অবশেষে হতাশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেশা ধরলাম। গাঞ্জা, মদ, হিরোইন, ইয়াবার নেশা। সেই থেকেই এই পথে আসা।
বললাম, এজন্য তো মানুষকে পকেট মেরে বিপদে ফেলতে পারেন না।

সে উত্তর দিল, আমি চোর বটে, আমি কি সাধে চোর হয়েছি? খেতে পেলে, পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করতে পারলে কে চোর হয়? যারা বড় বড় সাধু, চোরের নাম শুনলে শিউরে উঠে, তাঁরা চোর থেকেও বড় নিকৃষ্ট। তাদের প্রয়োজন নাই বলেই তারা চুরি করে না। কিন্তু প্রয়োজনাতীত ধন থাকতেও চোরের প্রতি মুখ তুলে তাকায় না। এতেই চোর চুরি করে। এক শিল্পপতির কাছে চাকরির জন্য গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকবার গিয়েছি। পরে অফিস থেকে লাথি মেরে ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। সেই দিন থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছি, এই কোট-টাই পরিহিত, পেট মোটা ধনীদের পকেট ফাঁকা করব। যতদিন বাঁচি। অনেক অনুনয় বিনয় করলাম। এ পথ থেকে ফিরে আসার জন্য কিন্তু পারিনি। অবশেষে বিফলমনোরথ হয়ে গন্তব্যে রওনা দিলাম।

প্রিয় বন্ধুরা! একটা দেশ উন্নয়নের অগ্রযাত্রার ধারপ্রান্তে পৌঁছার জন্য যুবশ্রেণিকে বলা হয় ঋড়ৎবসড়ংঃ। কিন্তু আমাদের দেশের যুব সমাজ আজ চরম হতাশার মধ্যে রয়েছে। আজ ইন্টার, অনার্স পাশ করেও চাকরি পাচ্ছে না- এমন যুবকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এই পর্যন্ত বহু যুবকের সাথে কথা বলেছি আমি। অধিকাংশের একটাই বক্তব্য, পড়াশুনা করে আমাদের দেশে আজ কিছুই হয় না। সব রাজনীতির খেলা। ক্ষমতাবানদের লেজ ধরে একটু ঝুলে থাকতে পারলেই সব জুটে। তাহলে পড়াশুনা করার কী দরকার? এই চরম সংকটাপন্ন মুহূর্ত থেকে আমাদের যুবসমাজকে টেনে আনা আমাদেরই দায়িত্ব। নইলে অতিশিগগিরই এই সোনায় সোহাগা দেশ হবে বেকারদের স্বর্গরাজ্য।

একবার জাফলং
জাফলং বাজারে। গাড়ি থেকে কেবল নেমেছি। ঘড়ির কাটা বলছে, দুপুর ১২:০০ টা। পেটে কিছুটা ক্ষুধাও অনুভব করছি। ভলো মানের হোটেল খুঁজতে লাগলাম চারিদিক। ভূরিভোজ করতে। সেই সকালে হালকা নাস্তা করেছিলাম। পেটের চার কোণার দুই কোণা ভরেছিল। আর দুই কোণা খালি ছিল। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবৎ প্রলয়ঙ্করী রাস্তার ভয়াবহ ঝাকুনিতে হেলিয়া দুলিয়া দোদুল্যমান অবস্থায় পুরোটা রাস্তা অতিক্রম করেছি। স্বস্তিতে থাকা পেট মহোদয় পুরোটাই ফাঁকা হয়ে গেছে। এখন যা কিছু আছে তা কেবল পানি। শিগগিরই পেটের মধ্যে যদি পানি আর খাবারের সম্মিলন না ঘটাই তাহলে আমার আজকের কার্যসিদ্ধি হাসিল হবে না। বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্য আছে, পেটে সহাইতে পারিলে পিঠে সয়। তাই মুগডাল আর তিনখানা গরম গরম পরটা দিয়ে ভূরিভোজনটা সেরে নিলাম। পয়েন্ট দিয়ে যখন ঝর্ণা এবং বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। দেখতে পেলাম, রাস্তার দুই ধারে দৃষ্টিনন্দন উঁচু উঁচু পাথরের স্তূপ। সাদা, কালো, রঙিন হরেক রকমের পাথরের সারি সারি স্তূপ। পাথরের স্পর্শে হাত দুটোকে কিছুটা মলিন করে নিলাম। একটা সুন্দর দেখে পাথরও সাথে নিয়ে নিলাম। সাদা কালো পাথর। দেখতে খুব সুন্দর। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, এই এলাকায় অন্য প্রজাতির মানুষও বসবাস করে। ছোট ছোট টং বানিয়ে থাকে তারা। বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। তাদের সংস্কৃতির নানা বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করলাম। জানতে পারলাম অনেক কিছু।
কিছুটা সামনে অগ্রসর হওয়ার পর দৃষ্টিগোচর হলো, ছোটখাটো একটা নদী। নদীর ওপাড়ে এক অপরূপ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বেলাভূমির প্রান্তর। ভ্রমণপিয়াসীরা দল বেঁধে আনন্দ করছে সেই দ্বীপে। মাঝিগণ ডাকাডাকি করছে। ওপাড়ে পার করিয়ে দেবে। বিনিময়ে ৩০ খানা টাকা দিতে হবে। আমার ইচ্ছে ছিল আগে বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত দৃশ্যপট স্বীয় চর্মচক্ষে অবলোকন করে প্রশান্তির বারিধারায় সিক্ত করব হৃদয়কে। পরে অন্যসব। তাই অন্য দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সীমান্তের দিকেই অগ্রসর হলাম। অবশেষে পৌঁছে গেলাম সীমান্তের নিকটবর্তী স্থানে। কিন্তু সেখান থেকে পুরোটা সীমান্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

ভ্রমণপিয়াসীরা দল বেঁধে আনন্দ করছে সেই দ্বীপে। মাঝিগণ ডাকাডাকি করছে। ওপাড়ে পার করিয়ে দেবে। বিনিময়ে ৩০ খানা টাকা দিতে হবে। আমার ইচ্ছে ছিল আগে বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত দৃশ্যপট স্বীয় চর্মচক্ষে অবলোকন করে প্রশান্তির বারিধারায় সিক্ত করব হৃদয়কে।

ভালো করে দেখতে হলে আমাকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অনেক কষ্টে হাত পা ভাঙার রিস্ক নিয়ে পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। সুবহানাল্লাহ!! কি অপরূপ সৌন্দর্য। আকাশচুম্বী পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে। স্বচ্ছ, পরিষ্কার ঝর্ণার পানি। ওপারে ভারতের লোকজনের হাঁটা চলার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আরো দেখা যাচ্ছে দালানকোঠা, বাড়িঘরের মনোরম দৃশ্যপট। ভারতের নাগরিকরা পাহাড় থেকে গাছ কাটছে। সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টা ভালো লাগল, পাহাড়ের কোল ঘেষে মেঘের ভেলা ছুটে চলার অপরূপ দৃশ্য। নিজেকে অনুভব করলাম এক স্বর্গীয় রাজ্যে। মালিকের মহান কিবরিয়াই আযিম শক্তিমত্তার সামনে শ্রদ্ধায় বিনয়াবনত হলাম। মস্তক ঊর্ধ্বগামী করে অবনমিত স্বরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। সুবহানাল্লাহ! সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কত সুন্দর!! না জানি তিনি কতো সুন্দর!!!।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *