থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে চাই সচেতনতা

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে চাই সচেতনতা

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে চাই সচেতনতা

মুহাম্মদ ফয়সুল আলম : থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত ত্রুটি, বংশগত রোগ। এই রোগে ‘এডাল্ট হিমোগ্লোবিন’ পরিমাণমতো তৈরি হতে পারে না। শিশুর এই অসুখের জন্য মা ও বাবা সমান অংশে দায়ী। মা এবং বাবা দু’জনের বৈশিষ্ট্যগুলো ‘জিন’ নামক এককের সাহায্যে সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হয়। মা এবং বাবা প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রাপ্ত অসুস্থ ‘জিন’ নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুটি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে।

রাজু ও শারমিন দম্পতির একমাত্র সন্তান সিয়াম। ক’দিন ধরেই সিয়াম অসুস্থ। কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। খেলেই বমি করে। পেটের ভিতর কি যেন ফুলে আছে। দিন দিন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। ছয়মাস বয়সের বাচ্চার এমন কিছু হলে মা বাবার মাথাতো আর ঠিক থাকার কথা নয়। তেমনি আকাশ ভেঙে পড়ল রাজু আর শারমিন দম্পতির মাথায়। দু’জনই শিক্ষিত তাই ডাক্তারের কাছে যেতে দেরি হলো না। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা দিলেন। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার দ্রুত রক্তরোগের ডাক্তারের কাছে যেতে বললেন। সেখানেই রাজু আর শারমিন প্রথম শুনলেন থ্যালাসেমিয়া নামের রোগ হয়েছে ওদের বাচ্চার।

জন্মের সময় শিশুটি সুস্থই থাকে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ার প্রকাশ তীব্রতা ভেদে ৪-৬ মাস হতে ৩-৪ বছরবয়সের মধ্যে হয়ে থাকে। এই সময়ের মধ্যে শিশুটি ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তার কর্মচাঞ্চল্য কমতে থাকে এবং ৬-৭ মাস বয়স থেকে শিশুটির প্লীহা ক্রমশ বড়ো হতে থাকে। ঠিকমতো চিকিৎসা শুরু না করলে চেহারার মধ্যে একটু একটু পরিবর্তন আসে। কপালের সামনে ও মাথার দু’পাশে খানিকটা উঁচু দেখায়। হাড়পাতলা হয়ে যেতে পারে। চেহারায় একটা হলদেভাব দেখা যায়। শরীরের ডিফেকটিভ লোহিত কণিকাগুলো অত্যধিক হারে ভেঙে গিয়ে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবার কারণে কখনো কখনো জণ্ডিস দেখা যায়। থ্যালাসেমিয়া কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। তবে আক্রান্ত শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকমতো হয়না।

থ্যালাসেমিয়া প্রধানত দু ধরনের হয়ে থাকে- আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। পৃথিবীতে ২৫০ মিলিয়ন এর অধিক মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসেব মতে, বাংলাদেশের শতকরা ১০-১২ ভাগ মানুষই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ লাখের বেশি শিশু এই রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি বছর গড়ে ৭ হাজার শিশু জন্ম নেয় থ্যালাসেমিয়া মেজর ও ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। এসব শিশুদের প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ পরপর রক্ত নিতে হয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে দেশে এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। বিয়ের আগে সচেতন হলেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি আরেক বাহককে বিয়ে করেন, তাহলে তাদের প্রতিটি সন্তানের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৫ শতাংশ। এ ধরনের পরিবারে একাধিক সন্তান থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হবার নজিরও রয়েছে। তবে রক্তের গ্রুপের সঙ্গে থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। মা সন্তানসম্ভবা হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ‘প্রিনটাল’ নামক পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভের সন্তান থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কিনা সেটা বোঝা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত সন্তান থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয় মাকে।

শিশুর রক্তশূন্যতা বা শিশু ফ্যাকাশে হয় বলে রক্ত বাড়ানোর চেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের আয়রন সিরাপ বা অনেকের কাছে রক্তের সিরাপ বলে বিবেচিত শিশুকে খেতে পরামর্শ দেওয়া হয় যা থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্য মারাত্মক রকমের ক্ষতিকর। এ রোগে আক্রান্ত শিশুকে আয়রনসমৃদ্ধ কোনো খাবার খেতে দেওয়া যাবে না। যেমন-কলিজা, মাংস, কলা ইত্যাদি। শিশুকে রং চা খেতে দেওয়া যায়। বিশেষ করে আহারের পর পর। কেননা, বারংবার রং-চা কিংবা কফি শরীরে লোহা শোষণে বাধা দেয়। ফলিকএসিড ও জিংক দিতে পারলে ভালো। মাল্টিভিটামিন দেওয়া যেতে পারে। শিশুকে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। কারণ এসব শিশুকে প্রায়ই রক্ত নিতে হয় এবং কিছুদিন অন্তর অন্তর রক্ত নেওয়াই এ রোগের প্রধান চিকিৎসা। সাধারণভাবে ৮/১০ সপ্তাহ পর পর রক্তের সঞ্চালন করে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৮-১০ গ্রাম এর ওপরে রাখতে হয়। এভাবে চেহারার পরিবর্তন হওয়া, প্লীহা ও যকৃত অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়া থেকে রোধ করা যায়।

রক্ত দেওয়ার ব্যাপারে কতগুলি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন প্রফেশনাল রক্তদাতার কাছ থেকে রক্ত দেওয়া উচিত নয়। হেপাটাইটিস-বি ও এইডস জীবাণুমুক্ত প্যাকসেল রক্ত যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে দেহে প্রবেশ করাতে হবে। হার্টফেলিওর এর আশঙ্কা থাকলে আস্তে আস্তে ট্রান্সফিউশন দেওয়া দরকার।

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হচ্ছে এ রোগের সম্পূর্ণ নিরাময়কারী নির্দিষ্ট চিকিৎসা। শিশুকে রক্ত দেওয়ার পূর্বে তা করা হলে ৫০/৭০ ভাগ ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া যায়, তবে আমাদের দেশে তা এখনো সাধ্যাতীত রয়ে গেছে। সফল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ব্যতীত অন্যান্য ব্যবস্থাপনার সাহায্যে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুকে ফলোআপ চিকিৎসা ও সঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন, শরীরে লোহার পরিমাণ সঠিক রাখলে এসব রোগীরা দীর্ঘজীবন লাভ করে।

২০২৮ সালের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য স্থির করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর এজন্য বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। রক্ত পরীক্ষা করে যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক চিহ্নিত করা যায় সেক্ষেত্রে তাদের কাউন্সেলিং ও গর্ভস্থ ভ্রুণ পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৭ লাখ বিয়ে হয় এবং এর ৯০ শতাংশই রেজিস্টার্ড। সে হিসেবে এই ৩৪ লাখ নারী-পুরুষকে বিয়ের আগেই স্ক্রিনিং করা গেলে থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কমে যাবে। ২০২৮ সালের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাও সহজতর হবে।

থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এজন্য সন্তানের জন্মের পর থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা করিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করার চেয়ে অনেক বেশি শ্রেয় এরকম একটি শিশুর জন্ম না হতে দেওয়া। অসুখটি নতুন নয়, শুধু সামাজিক সচেতনতার সাহায্যে ভাবী পিতামাতারা এগিয়ে এলেই এ রোগে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমিয়ে আনা সম্ভব।

সরকার দেশের চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চালু হচ্ছে বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহসহ ব্লাড ট্রান্সফিউশন এবং থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় কার্যক্রম। এছাড়াও থ্যালাসেমিয়ায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। হাসপাতালে রোগ নির্ণয়, ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও ঔষধ সরবরাহ আলাদা আলাদা জায়গায় হবে না, এক স্থানে হবে। এই ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে ভোগান্তি কমবে।

থ্যালাসেমিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই রোগের প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্যাপক জনসচেতনতা। এই রোগ প্রতিরোধের জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায় পর্যন্ত এ রোগের সেবা পৌঁছে দিতে পারলেই নির্মূল করা সম্ভব। তাছাড়া স্কুল পর্যায়ে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জানাতে পাঠ্য বইয়ে একটি সংযোজন রাখা যেতে পারে যেভাবে অটিজম রাখা হয়েছে। থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কঠোরভাবে মানার ব্যবস্থা করতে হবে।

মনে রাখা জরুরি থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা রোগী নয়। তারা আপনার আমার মতোই সুস্থ। যদি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যে কোনো একজন বাহক হয় তাহলে তাদের সন্তানেরা বাহক হিসেবে জন্মাতে পারে কিন্তু কেউ রোগী হয়ে জন্মাবে না। একটু সচেতনতাই পারে আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ জীবন উপহার দিতে। আসুন আমরা সবাই মিলে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নিজেরা থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জানি ও অন্যদের জানাই।
লেখক : কলামিস্ট
১৬.০৭.২০১৯

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *