দুর্দান্ত সুমন খান

দুর্দান্ত সুমন খান

দুর্দান্ত সুমন খান

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : বড় মঞ্চে জ্বলে উঠলে তাঁর দিকে সবার আলাদা একটা আগ্রহ তৈরি হবেই। সুমন খান সে কারণেই কি বেছে নিয়েছেন বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপের ফাইনাল!

না, মাহমুদউল্লাহ একাদশের তরুণ পেসার শুধু ফাইনালেই ভালো বোলিং করেছেন, তা নয়। পুরো সিরিজেই নিজেকে চিনিয়েছেন, নিয়েছেন ৯ উইকেট। তবে ফাইনালে তিনি আলো ছড়িয়েছেন সবচেয়ে বেশি।

মজাটা হচ্ছে, যে দলের বিপক্ষে কাল তোপ দাগলেন সুমন, সিরিজের আগে এই দলেরই স্ট্যান্ডবাই খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। মাহমুদউল্লাহ একাদশের হাসান মাহমুদের হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট তাঁকে সুযোগ করে দেয় সিরিজটা খেলার। আর নিজের আগের দল নাজমুল একাদশকে গুঁড়িয়ে মাহমুদউল্লাহ একাদশের শিরোপা জয়ে রাখলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রসঙ্গটা তুলতেই হাসলেন সুমন, ‘হ্যাঁ, সবাই কাল এটাই বলছিল।’

৩৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ফাইনালের সেরা বোলার হয়েছেন। ম্যান অব দ্য ফাইনালের পুরস্কারও উঠেছে তাঁর হাতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পেসারদের সিরিজে সুমন নিজেকে চিনিয়েছেন আলাদাভাবে। কাল বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান সিরিজের প্রাপ্তি বলতে গিয়ে আলাদাভাবে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন। অথচ এই সুমনের ক্রিকেটারই হওয়ার কথা ছিল না!

সকালে মুঠোফোনে সে গল্প শোনালেন সুমন, ‘ছোটবেলায় ক্রিকেটে খুব বেশি ঝুঁকে ছিলাম, তা না। খেলাধুলা করতাম। তবে পেশাদার ক্রিকেট বা এটাতে ক্যারিয়ার গড়ব এমন কোনো ভাবনা ছিল না। ভেবেছিলাম ভবিষ্যতে যদি কখনো আসা যায়, আসব। কিন্তু কঠিন এই পথ পাড়ি দেব কীভাবে, তেমন কিছু ভাবিনি। পড়াশোনাতে ভালো ছিলাম। বাসা থেকে তাই প্রত্যাশা ছিল পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি-বাকরি করব।’

পরিবারের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যেই এগোচ্ছিলেন মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে উঠে আসা সুমন। ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ২০১৫ সালে ভর্তি হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএতে। বিবিএ শেষ করে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকরি করবেন-এই ছিল তখনকার লক্ষ্য। পারিবারিক প্রত্যাশা পূরণে এগোতে থাকা সুমনের হঠাৎই মনে হলে নিজের স্বপ্নটাকে এভাবে শেষ হতে দেওয়া যাবে না! নাম লেখান বিসিবির পেসার অন্বেষণ কর্মসূচিতে। ২০১৬ সালের পেসার হান্টে (যেটিতে ইবাদত হোসেন প্রথম হয়েছিলেন) সুমন বাদ পড়ে যান ফিটনেসের কারণে।
বিপ টেস্টে পেয়েছিলেন ৮.৯। ফিটনেসে এভাবে পিছিয়ে থাকলে যে ভালো পেসার হওয়া যাবে না, তখনই উপলব্ধি হয় তাঁর। সেই অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে সুমন ফিরে গেলেন চার বছর আগে, ‘তখন ফিজিও বলছিলেন, তোমার ভেতর ট্যালেন্ট আছে কিন্তু এই ফিটনেস নিয়ে বেশি এগোতে পারবে না। তখন থেকেই জেদ চাপে নিজেকে আরও ফিট করব। সেখান থেকেই নিজের ভেতর বিশ্বাস জন্মেছে, কষ্ট করলে, কঠোর পরিশ্রম করলে ভালো ফল অবশ্যই পাওয়া যাবে।’

সুমন ফল পেয়েছেন। চার বছর আগে বিপ টেস্টে যাঁর ফল ছিল ৮.৯। এখন সেটি উন্নীত করেছেন ১২.৯ কিংবা ১২.১১-এ। ২০১৬ সালে পেসার হান্ট থেকে বাদ পড়ার পরই আসলে সুমনের বড় বাঁক বদল। ওই বছরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নর্থ সাউথের বিবিএ রেখে বিকেএসপিতে স্নাতক করবেন। বাধা এল পরিবার থেকে। বাবা কিছুতেই রাজি নন।

কীভাবে এই বাধা টপকেছেন, সুমনের কাছেই শুনুন, ‘নর্থ সাউথ থেকে বেরিয়ে ভালো জায়গায় চাকরি করব এটাই ছিল তাঁদের চাওয়া। বাবাকে বোঝাই, আমার যে স্বপ্ন, সেটা পূরণের এটা একটা বড় ধাপ। তিনটা বছর বিকেএসপিতে একটা চেষ্টা করতে চাই। বাবা বললেন, তোমার জীবন, তোমার সিদ্ধান্ত। তবে তুমি যে ভুল করেছ, তিন বছর পর সেটা যেন আমাকে দেখতে না হয়। বরং আমি ভুল, সেটা তোমাকে প্রমাণ করতে হবে।’

সুমন সেটা প্রমাণ করতে পারলেন কিনা, সময় বলে দেবে। তবে চ্যালেঞ্জটা জিততে তিনি যে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন, তা দেখাই যাচ্ছে। বিকেএসপির হয়ে খেলেছেন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট, প্রিমিয়ার লিগ। ২০১৯ প্রিমিয়ার লিগে ১১ ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়ে বিসিবির হাইপারফরম্যান্স দলে সুযোগ পান। বিপিএল, বিসিএলের পর এই তিন দলের সিরিজ-সুমন এগিয়ে চলেছেন ভালোভাবেই।

বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপে এক সঙ্গে প্রায় সব পেসারই জ্বলে উঠেছেন। তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেন, সাইফউদ্দিন, আল আমিনের মতো প্রতিষ্ঠিত পেসাররা যেমন ভালো করেছেন; ভালো করেছেন তরুণ পেসাররও। তারকা পেসারদের ভিড়ে কীভাবে সম্ভব হলো নিজেকে আলাদা করে চেনানো-সুমন সেটি বিশ্লেষণ করলেন এভাবে, ‘যখন সিনিয়ররা ভালো করেন, তাঁদের পেছনে থাকা সবাই একটা অনুপ্রেরণা পায় যে, না আমাদের বড় ভাইয়েরা ভালো করেছেন, আমাদেরও করতে হবে। এই টুর্নামেন্টে রুবেল-তাসকিন-আল আমিন ভাই সবাই আসলে ভালো করেছেন। তখন ভেবেছি তাঁদের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে আমাকেও ভালো করতে হবে।’

সুমনকে অনুপ্রাণিত করেছে মাহমুদউল্লাহ একাদশের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর কথাও, ‘টুর্নামেন্ট শুরুর আগে রিয়াদ ভাই (মাহমুদউল্লাহ) একদিন টিম মিটিংয়ে বলছিলেন, জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা তো আছেই। তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য এই সিরিজটা খুব ভালো প্ল্যাটফর্ম। সাত মাসের বিরতিতে খেলা শুরু হচ্ছে। সবার মনোযোগ থাকবে এটাতে। এটাই ভালো সুযোগ অল্প সময়ে নিজেকে চেনানোর। সুযোগটা সবাই কাজে লাগাও।’

সুমন সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন। এবার তাঁর লক্ষ্য, নভেম্বরের পাঁচ দলের টুর্নামেন্টে ভালো করা। দেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে তিনি আদর্শ মানেন। তবে বোলিংয়ে অনুসরণ করেন জিমি অ্যান্ডারসনকে। জিমির অ্যাকশন-সুইং ভীষণ মুগ্ধ করে বলে নিজের বোলিংয়েও সেটির প্রতিফলন দেখাতে চান। ভালো লাইন-লেংথে ধারাবাহিক বোলিং আর সুইং তাঁর মূল শক্তি। এ শক্তি কাজে লাগিয়ে ধারাবাহিক ভালো করতে চান সুমন, ‘সিরিজ-টুর্নামেন্ট ধরে ধরে এগোতে চাই। স্বপ্ন তো সবার বড়ই থাকে। এটা উপলব্ধি করি, ধারাবাহিক হতে হবে। এক ম্যাচে ভালো খেললাম, এমন না। ধারাবাহিক ভালো করতে চাই।’
ধারাবাহিক ভালো করে সুমন পা রাখতে চান জাতীয় দলেও-এটিই তাঁর স্বপ্ন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *