পবিত্রময় পাঠ ‘জ্যোতির্ময় এক আশ্চর্য মুখফুল’

পবিত্রময় পাঠ ‘জ্যোতির্ময় এক আশ্চর্য মুখফুল’

  • য. সামনূন

মাকে নিয়ে বাংলাভাষা ও বিশ্বসাহিত্যে কম কিছু লেখা হয়নি। কিন্তু মা-কে নিয়ে গাঁথা কাব্য-গদ্য হাজারবার পড়লেও তৃষ্ণা মেটে না কখনও; বাঙালি ‘কালচারাল মধ্যবিত্ত’ পরিবারের বসার ঘরের কাঁচ ঘেরা বুকশেলফের ভেতর থাকা জঘন্য অনুবাদে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ হাতে যে পাঠের শুরু। সন্তান–মায়ের প্রথম বিচ্ছেদ আঁতুড়ঘরে ধারালো কাঁচির আঘাতে দৃশ্যমান হলেও আদতে অদৃশ্য নাড়ি যে আমৃত্যু রয়ে যায়, আনিসুল হকের ‘মা’ এক বুক দুঃখ নিয়ে একসময় আমাদেরকে দেখিয়ে দেয়। আবার মায়ের জবানীতে মা-কে, মা-সন্তানের সম্পর্ককে আমরা দেখতে পাই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’-তে।

‘জ্যোতির্ময় এক আশ্চর্য মুখফুল’ গ্রন্থটির নাম চোখে পড়তেই তা আমাদের জানিয়ে দেয়, এটি মাকে নিয়ে গর্বিত পুত্রের মুগ্ধ বয়ান। ‘আশ্চর্য মুখফুল’ কন্যা, সহোদরা, প্রেয়সীর হতে পারলেও ‘জ্যোতির্ময়’ তা যে কেবলই মায়ের, জান্নাত পদতলে রাখা এক জননীর।

তবে বইটি হাতে তুলে নিলে দেখতে পাই, এটি একটি গদ্য সংকলন। ফলে আমরা একে একে আরও পাই বাবাকে নিয়ে লেখকের হৃদয়চেরা সংলাপ ‘শৈশবের খুব চেনা ফটোফ্রেম’, মুর্শিদনামা ‘আদিম আশেকের প্রেমের তাসবি দানা’, প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুলের প্রতি একটু ভিন্ন সুরে ফিচারধর্মী রচনায় তথ্যবহুল শ্রদ্ধানিবেদন ‘চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ’, নিজেকে খুঁজে ফিরে দেখা ‘বৃষ্টির অদৃশ্য জাদুর স্পর্শে’ বা ‘শিশির ধোয়া রূপার থালা’ —মোট ১৬টি গদ্য পাঠককে নিয়ে যাবে অনুভুতির এক দিগন্ত থেকে অপর দিগন্তে।

‘আমার’ মায়ের মতো করে; দুধসাদা কোমল পায়েসের গায়ে আলতো করে বাতাম কুঁচি আর একটুখানি জাফরান ছড়িয়ে দেয়ার মতো করেই পুরো বইটির সৌন্দর্য এসে যেন ধরা দিয়েছে ‘আমার নবীজী, আমার মুহাম্মদ’ গদ্যটিতে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘সম্বোধন’ করে নিজেকে এখানে প্রকাশ করেছেন লেখক। তিনি বলছেন, আপনার নামের জন্য আমি যে—কুরবান হতে চাই। কী আনন্দ! কী আনন্দ লাগে! যখন আপনার জীবনী পড়ি, আপনার কথা ভাবি, আপনাকে নিয়ে লিখি। মনে হয়—আমার আত্মার ঘর আলোকিত জান্নাতি বাগান। আমি আপনার আদর্শে উজ্জীবিত এক পুষ্প।

শুধু মুমিনজনের পরমতম প্রিয়তমের প্রতি আবেগ–ভালোবাসার অসীম প্রকাশই নয়, তত্ত্ব ও তথ্যও তুলে ধরছেন লেখক এখানে। তিনি বলছেন, পৃথিবীর সব মহাপুরুষের সকল মহৎ গুণাবলি আপনার মাঝে এককভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। ফলে আপনি যেকোনো বিবেচনায় জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ। এমনই একজন মহামানব—যে বিশ্বসাহিত্যে আদর্শ ও ব্যক্তি চরিত্রের বিচারে সবচাইতে বেশি স্মরণীয়।….যার জন্য আপনার মহান জীবন চরিত্র বিশ্ববাসীর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক জীবন্ত উৎস।

লেখকের মনন ও ভাবনার উপস্থাপনায় দেখি পেশাদারিত্বের ছাপ; আর হবেই না কেন, এটি আদিল মাহমুদের পঞ্চসহস্র খসড়ার পথ পেরিয়ে প্রকাশিত হওয়া পঞ্চম গ্রন্থ। দৃশ্যপটের প্রলম্বিত বিবরণ দেখি, কিন্তু শব্দের পরতে পরতে চিত্রশিল্পীর সতর্কতায় সযতনে গড়া বাক্যগুলো পাঠককে মায়াজালে আটকে রাখবে। ভাব-বিহ্ববলতায় মোড়া গদ্যগুলো কখনো কখনো পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিবে আত্ম ও আত্মার প্রতিবিম্বের সম্মুখে। পাঠকের অব্যক্ত কথাগুলো তার হয়ে ব্যক্ত করে দেয়া, কথাশিল্পীর এই তো কাজ, নয় কি?

লেখক যদিও আমাদেরকে পাঠযাত্রার প্রারম্ভে আবেগের করুণতা মাখা বইটিতে কোনো শিক্ষনীয় বিষয় বা জ্ঞানের আলাপ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তথাপি এই ছোট্ট ছোট্ট গদ্যগুলোর মধ্য দিয়ে একটা শিক্ষা, একটা অনুভূতি আমি পাতায় পাতায় পেয়েছি, একাকিত্বের রূপ ও বাসনা।

আদিল আমাদেরকে দেখিয়েছেন, দৈনন্দিন জীবনের মুখর-বহমান প্রবল স্রোতে থেকেও কীভাবে শূণ্যতা, প্রিয়জনের অনুপস্থিতি আমাদের আচ্ছন্ন করে, আমাদেরকে গ্রাস করে। এই শূণ্যতা জীবনভর কালে কালে কেবলই বৃদ্ধি পেয়ে যায়। এক সময় তাই প্রজন্মান্তরে মায়ের মতো করে ভালোবাসতে কাউকে পেতে চায় মানুষ, শূণ্যতার বর্ধন ঠেকাতে তাই বলে উঠে—

দূর্বাঘাসে শিশির ফোঁটায় যেমন এক ধরণের সতেজ শ্যামলিমা চকচক করে—তেমনই এক ধরণের স্নিগ্ধ সতেজতা ঝলমল করছিল তোমার ঠোঁটে। যেনো সৌন্দর্যের ফুল ফুটেছে ওখানে। আমার যৌবনের অগোছালো হৃদয়—আশ্চর্যরকম উচ্ছল বিস্ময় নিয়ে দেখছিলো এই আলো-ছায়ার খেলা। ভাবছিলো, এই দুপুরে ঝমঝমিয়ে ঈগল ডানায় ভর করে এসেছে তার ভালোবাসা…

 

গ্রন্থ : জ্যোতির্ময় এক আশ্চর্য মুখফুল
লেখক : আদিল মাহমুদ
প্রকাশনী : চৈতন্য ( বইমেলা ২০২৩, স্টল নং ৪৭–৪৮ )
মুদ্রিত মূল্য : ২২০/-
অনলাইনে অর্ডার করতে : রকমারি ডট কম

 

লেখক: (স্বীয় বর্ণনায়) সেকালের সর্বভুক, একালের ২০০টি বই হাতে নিয়ে ১৯৯টি ‘আবর্জনা’ বলে ফেলে দিতে বাধ্য হওয়া একজন দুঃখী পাঠক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *