বিন্দু বিন্দু জলে অথৈ সাগর : একজন দেওবন্দী আলেমের বিশ্বযাত্রা

বিন্দু বিন্দু জলে অথৈ সাগর : একজন দেওবন্দী আলেমের বিশ্বযাত্রা

ধারাবাহিক রচনার ১ম পর্ব

যারওয়াত উদ্দীন সামনূন : আজকাল অনেকের বিনিদ্র রজনী কাটছে এ চিন্তায় যে, কেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা. বা. সর্বমহলে সমাদৃত। তিনিই কেন পোপের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার আমন্ত্রন পান, তিনিই কেন নিমন্ত্রিত জাতিসংঘে?
এমন একটা বিষয় নিয়েও লিখতে হবে ভাবিনি। তবে এখন দেখছি এসবের পেছনে অনেক বড় ষড়যন্ত্র কাজ করছে। টেরও পাচ্ছেন না আপনাদের দুটো সমর্থন সূচক লাইনের কারণে কত ভয়াবহ ভবিষ্যতের ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে। লিখতে গিয়ে দেখলাম অনেক কিছুই চলে আসছে এবং সম্ভবত এই শেষবারের মত আমি এসব নিয়ে লিখছি। তো চলুন কিছু কারণ নির্ণয় করা যাক কেন মাওলানা ফরীদ সাহেবই, কেন মৌলবী কলিমুদ্দি নয়।

এক. ইতিহাস

এই ইতিহাস মানে ব্যক্তির কর্মজীবনের ইতিহাস। কি কাজ করেছেন আপনি আপনার অবস্থান থেকে দেশ ও জাতির জন্য? কি অর্জন আছে আপনার? কাজ ছাড়া কোনদিনও রাষ্ট্র ও সমাজের কোথাও আপনি সমাদৃত হবেন না। যতই আপনি জ্ঞানের হিমালয় হন, সেই জ্ঞানেরও প্রকাশ থাকতে হবে।

একমাত্র ব্যতিক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। কিন্তু এখানেও যার একাধিক পিএইচডি বা ডজন খানেক রিসার্চ পেপার আছে, তার মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে হাত গুটিয়ে বসে থাকা জনের চেয়ে। একারণেই জাতীয় অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাকের মত বিরাট বিশাল মহীরূহের কোন পাবলিকেশন নেই কেন সেই ব্যাখ্যাও দিতে হয় বহু কসরত করে। তাও আবার এ কাজটা করেন আহমদ ছফার মত কাউকে পাত্তা না দেয়া লোকটি।

যে কোন ক্ষেত্র হোক, কাজ থাকা চাই যদি সর্বমহলে মান্যবর হতে হয়। সুদি মহাজন ড. ইউনুসকে নোবেল পাওয়ার পরও ব্যাপক দুয়োর মুখে রাজনীতি করার খায়েশ ত্যাগ করতে হয়েছে। কারণ, দেশ ও জাতির কোন বিপদে তাকে পাশে পাওয়া যায় না। আবার নোবেল পাওয়ার কারণে তার ঠিকই একটা সামাজিক মূল্যায়ন রয়েছে। অর্থাৎ কোথাও কোথাও তিনি সমাদৃত হলেও দেশের সর্বমহলে তার সমাদর নেই।

কাজ থাকলে কি হয় দেখুন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে শহীদ করে, আওয়ামীলীগকে নেতৃত্বহীন করে, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন করার পরও আজ ঠিকই আওয়ামীলীগ তার ইতিহাসের স্বর্ণকাল অতিক্রম করছে।
যে যে ময়দানের লোকই হোক, দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে হবে। লেখক হুমায়ুন আহমেদ, ৭১ এর রাজাকারদের যখন ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছিল, তখন তিনি পুরো দেশকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছেন বহুব্রীহির তোতাপাখির মুখে ‘তুই রাজাকার’ স্লোগান তুলে দিয়ে। এই বই প্রকাশের প্রায় দুই দশক পর ঠিকই একদিন ‘তুই রাজাকার’ স্লোগানে ত্রিশলাখের বেশি শহীদের রক্তের দায় মোচনের শুভসূচনা হয়েছে।

আক্ষেপের বিষয়, আমাদের হুযুরদের কোন কাজ নেই দেশ ও জাতির জন্য। একান্তই ধর্মীয় কোন ইস্যু হাজির হলে সেটা নিয়ে কিছুদিন তর্জন-গর্জন চলে, তারপর আবার দীর্ঘ শীতনিদ্রার বিরতি।কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে যখন মাঠ খুব গরম ছিলো, মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সেই বিখ্যাত মহাসমাবেশের প্রস্তুতি মূলক মুরুব্বী আলেমদের এক বৈঠকে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা. বা. কথা প্রসঙ্গে আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমাদের এই এক সমস্যা কিছুদিন এর পিছে কিছুদিন ওর পিছে, কোন বাতিল ফেরকাকে একেবারে নিকেশ করার মত স্থিতিশীল পরিকল্পনা আমরা গ্রহণ করি না। এক কথায় দুই কথায় তারপর তিনি বলেন, ঠিক আছে আমি জামায়াতকে ধরলাম, আপনারা একেকজন একেকটা ফেরকা কে ধরুন।

অতঃপর আজ, নিজের জানমাল, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, সম্মানহানির ঝুঁকি, সবকিছু বাজি রেখে জেল-জুলুম সয়ে অবশেষে দীর্ঘ পরিক্রমায় আজ তিনি সফল। কোথায় আজ জামায়াতে ইসলামী? যারা একদিন জাতীয় পতাকা উড়িয়ে পথ চলেছে, ত্রিশ লাখের বেশী শহীদের রক্তের ঋণ আমরা আদায় করেছি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। জামায়াতের কোন নেতা আজ নির্বাচনে দাঁড়ালে জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। বাংলাদেশে আর কোনদিন জামায়াতের উত্থান সম্ভব হবে না ইনশাআল্লাহ। আমার ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র পড়াশোনায় দেখেছি, যে কোন গোষ্ঠীকে উপড়ে ফেলতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কুরবানী লাগে। কাউকে না কাউকে নিজেকে উৎসর্গ করতেই হবে। অন্যরা যখন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহু তা’আলা যদি নিজেকে উৎসর্গ না করতেন, তবে আরো কয়েক শতাব্দি তারা দুনিয়ার বুকে রাজত্ব চালাতো।

মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা. বা. কীভাবে জামায়াতকে ধরেছিলেন, এর একটা মাধ্যম কেবল উল্লেখ করি। যে কোন জায়গায় যেকোন বিষয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। মুখ খুললেই তাঁর জবান থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা উচ্চারিত হতো। অবাক লাগে, কোন কোন প্রবীণ আলেমের মুখেও আমি শুনেছি তাঁর সম্পর্কে বলতে যে, এখানে কেন জামায়াতের বিরুদ্ধে বলতে হবে! এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কেন জামায়াতকে টেনে আনতে হবে ইত্যাদি। আর তাঁরা এসব না করে কি পেয়েছেন? শাপলা চত্বরের ধোঁকা আর নানা ইস্যুতে বিরাট বিরাট একেকটা অশ্বডিম্ব।

প্রতিরোধের এই পদ্ধতিটা তিনি মূলত পেয়েছেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বীরসেনানী শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু থেকে। তিনি যেখানেই যে প্রসঙ্গেই কথা বলতেন, তাতে বৃটিশদের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু থাকতোই। এমনকি শাইখ যাকারিয়া রহ. আপবীতীতে উল্লেখ করেছেন, শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ. গিয়েছেন তাঁর খান্দানের একটি বিয়ে পড়াতে। সেখানেও সেই বিয়ের খুতবার আগে তিনি বৃটিশদের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে নিয়েছেন। আরেকটি পদ্ধতিও তিনি শাইখুল ইসলাম রহ. থেকে নিয়েছেন। দু-চারজন লোক জমা হলেই সেখানে তাদের জামায়াত সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। লোকসংখ্যার আধিক্যের জন্য কখনো অপেক্ষা করেননি। ফলাফল, বৃটিশরা পালিয়েছে, জামায়াত নির্মূল হয়েছে, আর আমাদের হুযুরদের কোল জুড়ে এসেছে ফুটফুটে একটি অশ্বডিম্ব।

সে যাক, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা. বা. কি কাজ করে এসেছেন এর সংক্ষিপ্ত মন্তব্যসহ টাইমলাইন দেখে আসা যাক।

১৯৭১ – দেশের সিংহভাগ আলেমরা যখন নিশ্চুপ ছিলেন, তখন তিনি দেশের স্বাধীনতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। এটাকে আমি কোন এচিভমেন্ট হিসেবে দেখতে নারাজ। কারণ এটাই তো করার কথা, এটাই তো স্বাভাবিক। একজন ধার্মিক মুসলিমের যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সাধারণ ব্যাপার, এটাও তেমনি।

১৯৭৮ – দেশের কওমী মাদরাসা ছাত্রদেরকে অনাগত একটি ফিতনা থেকে বাঁচাতে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা হিসেবে আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু’র নেতৃত্বে ‘লাজনাতুত তলাবা বাংলাদেশ’ গঠন। মাদরাসা ছাত্রদের যোগ্যতর করে তুলতে যুগপৎ কর্মসূচী ‘লাজনা’ দেয় এবং অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। এই যে এতোগুলো বছর পর এসে স্বীকৃতিপ্রাপ্তি, যদিও তিনি এর পেছনে সরাসরি কাজ করেছেন বলে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে, আরো যারা কাজ করেছেন তাঁদের শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু কাজী সাব হুযুরের নেতৃত্বে ‘লাজনা’ যে বিপ্লব তৈরী করেছিলো বিশেষত মাতৃভাষা চর্চায়, সেটা না হলে স্বীকৃতির দাবি মুখে আনাটাই তখনকার প্রেক্ষিতে বোকামী হতো। আহা, দুই পাতা বাংলা লিখতে পারে না, দুই মিনিট বাংলায় উপস্থিত বক্তৃতা দিতে পারে না – এই প্রস্তরযুগের গুহাবাসী লোকদের কীভাবে আপনি শিক্ষিত বলবেন? এটা সৌদিও না, ভারতও না, এটা বাংলাভাষার বাংলাদেশ।

লাজনার কাজ এতোই বিস্তৃত ছিলো যে, এর উদাহরণ কেবল সূর্য দিয়ে হতে পারে। আশেপাশে যেদিকেই তাকান, কওমী মাদরাসা কেন্দ্রীক যে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে লাজনার অবদান আছে। কওমী মাদরাসার প্রতিটা অণু-পরমাণু ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ‘লাজনা’ দ্বারা উপকৃত হয়েছে।

১৯৯৪ – যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনরুত্থান ঘটলে এদের প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

১৯৯০ থেকে ৯৭ – দেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান হয়। একটি গোষ্ঠী কওমী মাদরাসাগুলোকে এর সাথে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তিনি এর বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেন। আমার পর্যবেক্ষণে এই সময়টাতেই তিনি সবচেয়ে বেশী সমালোচনার শিকার হন, এই সময়ই তাঁকে সবচেয়ে বেশী ভুল বুঝা হয়। অতঃপর কিছুদিনের মাথায় সমকালীন আলেমগণ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। তাঁর বিরুদ্ধাচারণের ভুল শোধরাতে এযাবৎকালের সর্ববৃহত সাহু সেজদাটা তারা সেবারই দিয়েছিলেন। তাঁর এই সাফল্যের দরুণ এরপর আর কোনদিন কওমী মাদরাসার দিকে জঙ্গিবাদীরা তাদের কালোহাত প্রসারিত করার সাহস পায়নি, আলহামদুলিল্লাহ।

১৯৯৮ – জামায়াতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই ঘোষণা করেন। এদেশ থেকে জামায়াতকে বিলুপ্ত করার সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

১৯৯৯ – ফিদায়ে মিল্লাত নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু’র নির্দেশে সেবামূলক সংস্থা ইসলাহুল মুসলিমীন পরিষদ গঠন। দেশের যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুল সহায়তা নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটি সবধর্মের সবধরনের মানুষের পাশে থাকে। এছাড়া বছরজুড়ে নির্দিষ্ট সেবামূলক কর্মসূচি তো রয়েছেই।

২০০২ – ইসলাম বিদ্বেষী জামায়াত; সরকারের অংশীদার হয়ে ক্ষমতায় গেলে সরকারী চাকরী থেকে প্রতিবাদমূলক স্বেচ্ছা-অবসর গ্রহণ করেন। ততোদিনে দাপ্তরিক সমস্ত কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয়ে গেলেও তিনি হাতে লিখে দুইপৃষ্ঠার একটি অবসরপত্র জমা দেন। যেখানে তিনি দেশ ও ইসলামের বিরুদ্ধে জামায়াতের কার্যকলাপ উল্লেখ করে সুস্পষ্ট ভাষায় যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের বিরোধীতায় নিজের অবস্থান তুলে ধরেন এবং জামায়াতের অংশীদারী সরকারের অধীনে চাকরী করতে অসম্মতি ঘোষণা করেন।

দেশের মিডিয়াতে বিষয়টা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কারণ উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরির সম্মান-মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ছাড়াও ক্ষমতাসীন একটি দলের বিরুদ্ধে এতো বড় পদক্ষেপ, যেটা সরাসরি লড়াইয়ের আহ্বান জানাচ্ছে, এর পরিণাম কি হতে পারে জানার পরও একজন কতটা দৃঢ়চেতা হলে এটা করতে পারেন! এক কথায়, এটা একেবারেই নজীরবিহীন ও চোখ কপালে তুলে দেয়ার মত সিদ্ধান্ত ছিলো।

এমন কঠিন চপেটাঘাতের মধ্য দিয়ে তিনি জানান দিলেন তিনি কি করতে চলেছেন। নিজের একার সীমিত শক্তিসামর্থ্যে দেশের প্রতিটা জনপদে জামায়াতের বিরুদ্ধে দুর্বার জনমত গড়ে তোলা শুরু করলেন।

২০০৩ – দেশের মাটিতে ক্ষমতাসীন জামায়াতের ছত্রছায়ায় আবার জঙ্গিবাদের উত্থান শুরু হতে থাকায় শান্তির পক্ষে নানা ধরণের পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। এর মাঝে খুবই প্রভাবক একটি ছিলো ফিদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আস’আদ মাদানী নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু কে প্রধান অতিথি করে নানা মত ও পথের বুদ্ধিজীবি ও সামাজিক-সাংবাদিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেল শেরাটনে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন৷ যেটা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা পালন করে। ফিদায়ে মিল্লাত নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু অসুস্থ থাকায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বড় ছেলে হযরত মাওলানা সায়্যিদ মাহমুদ আস’আদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুমকে প্রেরণ করেন। সমকালীন আলিমগণ দুঃখজনক ভাবে নিরবতা পালন করছিলেন।

২০০৫ – জামায়াতের বিরুদ্ধে তাঁর অব্যাহত সংগ্রামে দিন দিন জামায়াতের অবস্থান টালমাটাল হয়ে উঠতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা তাঁকে কারাগারে বন্দি করে রাখে। বন্দি থাকা অবস্থায় তাঁকে এবং তাঁর অসহায় পরিবারকে নানা ধরণের প্রলোভন সহ একাধিকবার আপোসরফার প্রস্তাব দিলেও তিনি ও তাঁর অকুল পাথারে নিমজ্জিত পরিবার তা বিনা বাক্যব্যয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর হাতে জামায়াতের পতন যে অনিবার্য হয়ে উঠেছে, তখনই তা স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে।

২০০৭ – জামায়াত ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কে সাথে নিয়ে দেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব জাগরণ তৈরী করতে সামর্থ্য হন। দূর্গম পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া এমন কোন জনপদ বাংলার মাটিতে সম্ভবত বাকি ছিলো না যেখানে তিনি এই দাবি নিয়ে যাননি।

বাংলাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ ও অর্থনৈতিক উৎস তথা ব্যাংক-বীমা, হাসপাতাল প্রভৃতিকে জাতীয়করণের দাবি উত্থাপন করেন।

২০১৩ – জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠলে তিনি তাঁর এতোদিনের পরিশ্রমে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের যে কফিনে পুরে ফেলেছিলেন, সেই কফিনের শেষ পেরেকটি ঠুকে দিতে হাজির হন গণজাগরণ মঞ্চে। ইসলাম বিদ্বেষীদের যে অপপ্রচার ছিলো কওমী আলেমদের মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশদ্রোহীতা নিয়ে, চিরতরে সে অপবাদ মিটিয়ে দিতে তিনি সক্ষম হন। আজ আর কেউ আলেমদের উপর ‘রাজাকারীর’ তকমা এঁটে দেয়ার সাহস রাখে না।
২০১৪ – যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের দোসরদের দ্বারা দেশব্যাপী অরাজকতা ও পেট্রোল বোমাবাজির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। সারাদেশে ‘শান্তির অন্বেষা’ শিরোনামে একটি কর্মসূচী পালন করেন। দেশের প্রত্যেকটি জেলা শহরে তিনি নিজে উপস্থিত হয়ে সবধরণের সহায়তা নিয়ে পেট্রোলবোমায় আহতদের পাশে দাঁড়ান।

২০১৬ – পুনরায় দেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটতে শুরু করলে; বিশেষত এবার যখন তারা পূর্ণ ধর্মীয় ছদ্মাবরণে একটা বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের প্রচারণা চালানো শুরু করে, তখন তিনি এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এক লাখের অধিক আলেম, মুফতি ও ইমামগণের সাক্ষর সম্বলিত ‘মানব কল্যাণে শান্তির ফতওয়া’ শিরোনামে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ফতওয়া প্রকাশ করেন।

২০১৭ – এই ফতওয়া প্রকাশ হলে জঙ্গীরা তাদের গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ক্ষেপে উঠে এবং তাঁর উপর প্রাণঘাতী হামলা চালায়। একজন সাধারণ নাগরিক ও দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হলেও আল্লাহ তা’আলার অশেষ কৃপায় তিনি বেঁচে যান। সমকালীন বৈরী আলেমগণ ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ থুক্কু প্রদান করেন।

লক্ষ্য করে দেখুন, হুট করে একদিনে তিনি বিশ্বমঞ্চে উপস্থিত হন নি। প্রথমে একেবারে নিজের অঙ্গনে কাজ করেছেন। তারপর একজন ধর্মীয় ব্যক্তি হিসেবে ধর্মসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে কাজ করেছেন। তারপর জাতীয় ইস্যুগুলোতে নিজের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে কাজ করা শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় একসময় জাতীয় ক্ষেত্রে নিজের অঙ্গনের বাইরের জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে কাজ করেছেন। অতঃপর জাতীয় ক্ষেত্রে সরাসরি কাজ করেছেন। সবশেষে বৈশ্বিক ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করেছেন। তখন না গিয়ে জাতিসংঘের আমন্ত্রণ এসেছে।

দুনিয়ার সমস্ত নেতারাই এভাবেই উঠে আসেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখুন, কিভাবে ধীরে ধীরে কর্মী থেকে নেতা হয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন। মহাত্মা গান্ধীকে দেখুন, কোত্থেকে কোথায় এসেছেন। আর কানসাটের গোলাম রব্বানীর মত যাদের ইস্যুভিত্তিক উত্থান ঘটে, ইস্যু শেষ হয়ে এলে তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায় না।

দশ জনের সাথে কাজ করবেন। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো একশ জনের সাথে। জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় আর অভিজ্ঞতায় এভাবেই ঋদ্ধ হতে হতে একসময় জাতীয় আর বৈশ্বক পর্যায়ে কাজ করবেন। এভাবেই না এক সময় জাতিসংঘ আপনার পদধূলিতে সম্মানিত হবে!

আর তাঁর বিপরীতে সিংহভাগ সমকালীন আলেমদের কি অর্জন? জন্মেছেন, আলেম হয়েছেন, আরো আলেম জন্ম দিয়েছেন, অতঃপর হিংসা বিদ্বেষের উর্ধে উঠে শান্তির শয়ন নিয়েছেন। ( যারা স্বেচ্ছায় এ জীবন বেছে নিয়েছেন তাঁদের সম্মান করি। কিন্তু যারা ঘরের খিল এঁটে বসে থাকবেন, আর নাঁকিকান্না জুড়ে দেবেন অন্যের কর্মময় জীবনের প্রাপ্তিদর্শনে, তাঁদের প্রতি আমার একরাশ করুণা) তো কীভাবে আশা করেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা. কে ডিঙ্গিয়ে মৌলবী কলিমুদ্দি জাতিসংঘে যাবেন?

কথায় আছে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। আর তাঁর সমকালীন আলেমদের দেশ ও জাতীর জন্য কিছু করার সর্বোচ্চ মাধ্যম রাজনীতি। এই রাজনীতিতে তাঁদের সর্বোচ্চ কি অর্জন? আরো একখান অশ্বডিম্ব৷ সর্বসম্মতিক্রমে গোমরাহ ও বাতিল ফিরকা; দেশদ্রোহী জামায়াতের সাথে আপোস করে, বিএনপির ঘাড়ে ভর করে সংসদে যাওয়া। জাতির তরে কোন কাজ না থাকায় জোট করার পরেও, শরীকদলগুলোর ভোটব্যাংক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকার পরও নিজের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারেন না। শরীক দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হয় তাঁদের। এভাবে মেরুদণ্ডহীন সংসদযাত্রার ফল হচ্ছে এই, জাতীর জন্য কিছু করা তো হলোই না, নিজেদের অঙ্গনের স্বীকৃতিটা পর্যন্ত পাইয়ে দেয়া গেল না।

ক্ষমতায় এসেছিলেন তাঁরা মূলত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহীদদের রক্তের বিনিময়ে। এই ‘বিনিময় মূল্য’ সম্পূর্ণ অপরিশোধিত রেখেই বিদায় নিয়েছেন। নিয়তের উপর আঙুল তোলার মত ঘৃণ্যকাজ কমই আছে। অথচ ভবিষ্যত ইতিহাসবেত্তাগণ এই কাজটা করতে বাধ্য হবেন। কারণ যে রক্ত বিক্রি করে তাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই রক্তেই তাঁদের হাত রাঙা হয়েছে।

হ্যাঁ, আমি মালিবাগ শহীদী মসজিদের কথা বলছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো তাও প্রশাসন ছিলো, প্রশাসন কখনোই কোন দলের হয় না। যে পুলিশ সদস্যটি একদিন আপনার গায়ে হাত তুলেছিলো, তাকেই হয়ত কয়েক বছরের পালাবদলে দেখা যাবে আপনার গায়ে যেন ফুলটোকা না পরে সে জন্য নির্ঘুম চোখে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু মালিবাগে তাঁদের ক্ষমতার অংশীদার বিএনপির কর্মীরাই গুলি চালিয়েছিলো। বিচার তো হয়ই নাই, কোন আন্দোলন পর্যন্ত দানা বাঁধতে দেয়া হয়নি। এমনকি, প্রতিবাদ জানাতে চৌধুরী পাড়া নূর মসজিদের সামনের রাস্তা বন্ধ করে জানাযা পড়ার সিদ্ধান্তে পর্যন্ত বাঁধা দিয়েছেন সেই আলেমেদ্বীন। জানাযার কিছুক্ষণ আগেও সবাই জানত যে রাস্তা বন্ধ করে প্রতিবাদ জানানো হবে, অথচ মন্ত্রী মির্জা আব্বাসকে সাথে নিয়ে তিনি উপস্থিত হয়ে এই সামান্য প্রতিবাদটুকু করতে দেন নি। এভাবেই টুঁটি চেপে রাখা হয়েছিলো। যতদিন কওমী মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা বিএনপির মত দল বা মাহমুদুর রহমানদের মত লোকদের ‘ইসলামের সিপাহসালার’ ভাববেন, ততোদিন এভাবেই অশ্বডিম্বের গর্বিত জন্মদাতা হয়ে রইবেন।

তুলনা করার মত একটি বাজে আচরণ ও বোকামীতে আপনারাই আমাকে নামিয়েছেন। একথা প্রচার করছেন যে, আমিও আলেম, অমুকও আলেম, মাওলানা ফরীদ সাহেবও আলেম, পার্থক্য কোথায়? কেন তাঁর সর্বমহলে এই সমাদর? প্রকারন্তরে একটি অত্যন্ত নোংরা প্রশ্ন করছেন। কোন মুসলমান সম্পর্কে এর চেয়ে ভয়ানক প্রশ্ন আর কিছুই হতে পারে না। সূর্যের সাথে চন্দ্রের তুলনা করতে আমাকে আহবান জানানো হলে অবশ্যই আমাকে বলতে হবে সূর্যের আলো ছাড়া চন্দ্রের মূল্যহীনতার কথা। দেখাতে হবে আমাবস্যার অন্ধকার রাতগুলো। চিহ্নিত করতে হবে চাঁদের সেই কলঙ্ককে।

কাউকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দুটি মাধ্যম আছে। হয় নিজেকে তাঁর চেয়ে যোগ্যতর করে তোলা, নয়ত তাঁকে নিজেদের স্তরে নামিয়ে আনা। যেহেতু একজন ফরীদ মাসঊদ হওয়া আপনাদের সামর্থ্যের বাইরে, তাই আপনারা দ্বিতীয়টি বেছে নিলেন।

আর সব যুগসংস্কারকদের মত তিনিও যেন মুন্তাখাব ছিলেন। সবকিছু যেন তাঁর জন্য প্রস্তুত ছিলো। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ও পড়ুয়া পরিবারে। দান করেছেন অসম্ভব প্রতিভা আর তুখর মেধা। গড়ে তুলেছেন সময়ের শ্রেষ্ঠ একদল নক্ষত্র মনীষাদের তত্ত্বাবধানে। চিন্তা-চেতনা বিশুদ্ধ করে নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন কাজী সাব হুযুরের সাহচার্যে। ইলমের আত্মিকশক্তি অর্জন করিয়েছেন দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে। কর্মক্ষেত্র বাস্তব দুনিয়ার অভিজ্ঞতা পেতে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিযুক্ত করেছেন। (এটা ২০১৮ সাল, যে দুনিয়ায় কাজ করবেন সেটা কীভাবে চলে তা না জানলে কিছুই করতে পারবেন না।) শাইখ যাকারিয়া-ফিদায়ে মিল্লাত- শাইখ আলী নদভী রাহিমাহুমুল্লাহ দের সংস্পর্ষ দিয়েছেন নিজ কওম ও জাতির জন্য কাজ করার হাতে কলমে দীক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনে। এতোসব সৌভাগ্য কেবল সাধারণ তাকদীরের বন্টনে নয়, পেতে হলে হতে হয় নির্বাচিত।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, হুট করে ২০১৬ তে এসে যে তিনি শান্তির আহবানে কাজ করা শুরু করেছেন বিষয়টা মোটেও এমন নয়। অথচ কেউ কেউ নিতান্তই অজ্ঞতার কারণে বিষয়টাকে এভাবে দেখাতে চাচ্ছেন। ইসলাম শান্তির ধর্ম – এই শিক্ষাটা তো ছোটবেলার। আর এ শিক্ষার উপরই তিনি সারা জীবন কাজ করে চলেছেন। যখনই ইসলামকে বিকৃত করে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলেছে, তখনই তিনি সেটা প্রতিহত করেছেন। নানা পন্থায় নানামুখী কাজ করেছেন। বৈচিত্রময়তার উদাহরণ দেখুন, ২০০৬ সালে যখন ইকরা মাল্টিমিডিয়া গঠন করলেন তখন এর মটো রাখলেন ‘বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায়’। কলরবকে সাথে নিয়ে যখন দেশের এযাবতকালের সর্ববৃহত আন্তর্জাতিক হামদ-নাত মাহফিলের আয়োজন করেন, তখন এর স্লোগান দিলেন একই ‘বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায়’। সমাজের প্রতিটা স্তরে; শাখাপ্রশাখায়, প্রতিটা মাধ্যমে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।

আরেকটি বিষয় দেখুন, সেই ২০০৩ সাল থেকেই তিনি মাঠ পর্যায়ে বিশ্বশান্তি নিয়ে কাজ করছেন। (এর আগেও তাঁর কিছু অংশগ্রহণ ছিলো, সেটা যথাস্থানে বিবৃত হবে) প্রথমে ছোট আকারে শুরু করেছেন, পরে সেটা বড় ক্যানভাসে অঙ্কিত হয়েছে। বুখারীর দরসে হুদায়বিয়ার সন্ধি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ইসলাম শান্তিতে দূর্জয়’। পুরো আলোচনাটা যদি শুনাতে পারতাম, তবে চিরকালের মত এ ব্যাপারে আপনার শরহে সদর হয়ে যেতো। তাঁর শ্রেষ্ঠকর্ম ‘ইসলাম সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা’ বইয়ের কয়েকটি প্রবন্ধ তাঁর আনুমানিক ১৮-২০ বছর বয়সে লেখা। তাঁর জীবনে কোন থুক্কু নেই, ১৮তে যা বলেছেন, ৬৮তে এসেও তাই বলে যাচ্ছেন।

আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই, পোপের অনুষ্ঠান ছিলো আন্তঃধর্মীয় সম্প্রতির আহবানে। মাওলানা ফরীদ সাহেব ছাড়া আর কোন আলেম কোন দিন দেশের জাতীয় পর্যায়ের বিধর্মী ধর্মগুরুদের সাথে দু’টো কথা বলেছেন? আপনারা তো এমনকি ইমরান সরকারের মত ইস্যু ভিত্তিক পুঁচকে নেতার সাথেই বসতে চাননি। হয়ত আল্লামা আহমদ শফী সাহেব দা.বা. এর মুখোমুখি হলে তার জীবন পরিবর্তন হয়ে যেত, কিন্তু আপনাদের বাঁধার মুখে সেটা হলো না। হিদায়াত তো আল্লাহ তা’আলার হাতে, আপনারা ওসীলা। অথচ আপনারা খোদার উপর খোদাগীরি করে তাকে হিদায়াতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে বাঁধা দিলেন। হিদায়াত পাবে না মর্মে ওহী নাযিল হওয়ার পরও যে নবী মেহনত করে গেছেন, কোন মুখে নিজেদের সে নবীর ওয়ারীস দাবি করেন! ভাগ্যিস আপনারা সাহাবা যুগে ছিলেন না, থাকলে এই বাংলায় বসে হয়ত খলীফায়ে মাদানী আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. কে বেদ্বীন-ঈমানহীন নাস্তিক হয়ে জাহান্নামীমৃত্যু গ্রহণ করতে হতো।

বক্তৃতা করাতেই আপনাদের এই অবুঝ সমালোচনা, তবে যে রোহিঙ্গা মুসলিম ব্যক্তিটি পোপকে নিয়ে মুনাজাত করেছিলেন তাঁকে কি বলবেন? নাস্তিক-মুরতাদ? অথচ অন্যভাবে দেখলে ব্যপারটা কত চমৎকার, আমি যে সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের উপর-যে নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ হওয়ার উপর ঈমান রেখে দু’আ করছি, সেই দু’আয় এর উপর বিশ্বাস না রাখা একজন শরীক হচ্ছে, হিদায়াতের এতো বড় একটি ওসীলা হতে পারাটা তো চিরকাম্য। এই বিংশশতাব্দীতে এসেও যে ছোট্ট ছোট্ট ছুঁতোয় আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে ঈমান নসীব করেন, এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে ভারতের মাওলানা কলীম সিদ্দীকীর দা.বা. জীবন জুড়ে।

আর সব যুগসংস্কারকের মত তাঁর জীবনেও কোন ব্যার্থতা নেই। হয়ত সময় লেগেছে, কিন্তু সফলতা অবশ্যই ধরা দিয়েছে। লিল্লাহিল হামদ, এখানে তাঁর কোন ঐচ্ছিকতা নেই, আল্লাহ তা’আলা দান করেছেন, ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ দান করবেন।
২০১৩ সালে তাঁর তৈরী করা কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের খসড়া হয়ত বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু অপেক্ষায় থাকুন, যারা বলেছিলেন লাখ লাখ লাশ পড়বে, তাঁদের ওয়ারিসরাই একদিন হয়ত এর পক্ষে বলবে। পরিবর্তন আসবেই, এটা হবেই, এ স্রেফ অবশ্যম্ভাবী। নিতান্তই মূক ও বধির না হলে কেউ এই বাস্তবতা অস্বীকার করবে না। এটা বুঝতে ফিরাসাত লাগে না। যেমনটা লাগতো না মাতৃভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে। যে মাদরাসা থেকে লাজনা করার কারণে উস্তাযদের বিদায় নিতে হয়েছিলো, ছাত্ররা হয়েছিলো নিষ্পেষণের শিকার, সেই মাদরাসায় আজ একটি নয় দুই দুইটি বাংলা দেয়ালিকা ঝুলে। নয়া যামানার এই ডাক বুঝতে খোদাপ্রদত্ত্ব মানুষের সাধারণ বুদ্ধিমত্তাই যথেষ্ঠ। দেখা যাচ্ছে আমাদের আপামর কওমী সন্তানদের সিংহভাগের গড়বুদ্ধি মানুষের এভারেজ বুদ্ধিমত্তার নিচে বাস করে৷ খুলাফায়ে রাশেদীনের যমানা হলে হয়ত তাঁদের উপর হাদীসের ব্যাখ্যা আর ফতওয়া প্রদানে নিষেধাজ্ঞা থাকতো।

তাঁর কাজগুলো বুঝতে আপনার শুধু ব্যাপক বিস্তৃত সুগভীর পড়াশোনা আর অতুলনীয় মেধা-প্রতিভা থাকলেই হবে না, এর সাথে সাথে আপনার উরুজও হতে হবে। এরপর আবার নুযুলও হতে হবে। যখন খালিকের দৃষ্টিতে মাখলুককে দেখতে শিখবেন, তখনই কেবল একজন ফরীদ মাসঊদ কে বুঝার ক্ষমতা তৈরী হবে।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

মাবি/৩০১

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *