পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন থাকবে বা আগামী নির্বাচন কবে হবে এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হলেও, উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হলেও এ নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর আগে রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকার যাতে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে আঠারো মাসের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হয়, সেজন্য তাদের দৃঢ় সমর্থন দেয়ার কথা জানান বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে ধরে নিলে কি বলা যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে ১৮ মাস? এমন প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, ‘সেটা আপনি ইচ্ছা করলে ধরতে পারেন। কিন্তু সেটা তো সরকারের মতামত না। সরকার তো কোনো মত দেয়নি এ পর্যন্ত। কাজেই সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে সেটা সরকারকেই বলতে হবে। সরকার না বলা পর্যন্ত তো সেটা সরকারের মেয়াদ হচ্ছে না।’
বিষয়টি পরিষ্কার করে প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘আমাদেরই বলতে হবে। আমাদেরকেই বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন তখন সেটাই হবে তারিখ।’ তিনি বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা তার সরকারের মূল লক্ষ্য।
হাসিনা পতনের পর ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটি দৃশ্যমান টানাপড়েন লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত, গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে ইউনূস বলেন, এটি একটি আইনগত বিষয় এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে। ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দুই দেশেরই স্বার্থ হলো যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা। মাঝে মাঝে কতগুলা প্রশ্ন এসে যায় যেখানে সম্পর্কে একটু চিড় ধরে। যেমন, সীমান্তে গুলি করল, শিশু মেয়ে মারা গেলো, শিশু ছেলে মারা গেলো, এগুলো মনে কষ্ট দেয়।…এটাতে আমরা মনে করি না যে, ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে। যে সব কারণে এসব ঘটে, সেসব কারণ যেন আমরা উৎখাত করতে পারি, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, যাতে নিরাপদে মানুষ জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে।’
বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল ছাত্ররা। অন্তর্বর্তী সরকারেও ছাত্রদের প্রতিনিধি রয়েছে। তবে সরকারের বাইরে যারা আছে এমন অনেক ছাত্রকে দেশের নানা ক্ষেত্রে, নানা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে শিক্ষার্থীরাই কি দেশ চালাচ্ছে? এর জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘চালানো উচিত বলছি। চালাচ্ছে বলছি না। চালানো উচিত। তরুণদের হাতেই সব ছেড়ে দেয়া, আমি বরাবরই বলে এসেছি, এখানে এ দায়িত্ব পালন করার আগে থেকেই বলছি যে তরুণদের হাতে দায়িত্ব দেয়া উচিত। কারণ তারাই তাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে।’
বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ে আপনার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী? এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনি পুরনো দিনের কথাবার্তা বলছেন। এরমধ্যে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেছে, আপনার মনে হয় স্মরণে নেই। নতুন যা হচ্ছে সেটা আপনাকে দেখতে হবে তো। কত ছেলে প্রাণ দিলো সেটা নিয়ে আপনার প্রশ্ন নাই। শিক্ষার্থীরা বলেছে, আমরা রিসেট বাটন পুশ করেছি। অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে। এখন নতুন ভঙ্গিতে আমরা গড়ে তুলব। এর জন্য আমাদের সংস্কার করতে হবে।’
ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় দেড় মাস পরে, এই সময়ে সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসারদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন কেন? জবাবে ড. ইউনূস জানান যে, গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের হত্যা করাসহ পুলিশের গণবিরোধী ভূমিকায় জনগণের মধ্যে পুলিশের ব্যাপারে অনেক নেতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি হয় সবার মধ্যে। সে কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবল ভেঙে যাওয়ায় তাদের দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যাচ্ছিল না। এ কাজে আনসার নিয়োগ করেও ফল আসেনি। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে দু’মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘নানা রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, সমাবেশ হচ্ছে। তাতে বিশেষ করে আমাদের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের অসন্তোষ দেখা গেলো। সেগুলো নিয়ে মনে করলাম যে, এভাবে চলতে দিলে তো বাড়তে আরম্ভ করবে, তখন এ প্রসঙ্গ উঠল যে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়ার জন্য।…তারা বলছে আমরা তো আছিই কিন্তু, আমাদেরকে তো কেউ পরোয়া করছে না। কারণ আমাদের তো কোনো ক্ষমতা নেই। আমাদের একটা ক্ষমতা থাকলে তারা হয়তো আমাদের গণ্য করবে…তখন আমরা তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিলাম।’
হাসিনা সরকারের পতনের পর সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো, বিশেষ করে পুলিশ হত্যার ঘটনাগুলোর বিচার করা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে যেখানে অপরাধ করছে তার বিচার করা হবে। তা না হলেতো বিচার সম্পন্ন হবে না। আমরা যদি একপক্ষীয় বিচারে ফিরে যাই তাহলে তো আর গণ-অভ্যুত্থানের মানে হলো না।’
সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান সরকারের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, সার্ক পুনরায় কার্যকরভাবে চালু করার ব্যাপারে পাকিস্তান, নেপাল, ভূটানের সাথে জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনের ব্যস্ততার ফাঁকে আলোচনা করা, সংবিধান সংস্কারসহ নানাক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়ে তার সরকারের উদ্যোগ ও অগ্রগতি, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশী নাগরিকদের সাথে বাঙালিদের সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ও সহিংসতা, রোহিঙ্গা সঙ্কট ইত্যাদি বিষয়েও কথা বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে ইউনূস বলেন, ‘এইতো আসলাম মাত্র। এত বছরের একটা সমস্যা, আপনি দু’দিনে আমাদের দিয়ে সমাধান করে দিবেন বা আমরা একটা সমাধান নিয়ে আসব এটা আশা করা তো ঠিক হবে না। একটা শান্তি চুক্তি হয়েছে, সে শান্তি চুক্তি বহু বছরের চেষ্টায় হয়েছে। সেই শান্তি চুক্তি বহাল করা যাচ্ছে না। মান্য করছে না। এখন কি সে শান্তি চুক্তি আবার নতুন করে করতে হবে? সেটা আমাদের সরকার পেরে উঠবে না। এটা পরে নির্বাচিত যে সরকার আসবে, তারা করবে।’
নতুন করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে সে ব্যাপারে তার সরকারের সিদ্ধান্ত কী হবে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা যদি আসতে চায়, আমরা তাদের আসতে দেবো। আমরা তাদের গ্রহণ করব।’