মাসউদুল কাদির : আখেরি চাহার শোম্বা কী? এ প্রশ্ন অনেককেই করতে দেখা যায়। মুসলমানদের একটি খুশির দিন হিসেবে এই আখেরি চাহার শোম্বাও আলোচিত। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের আগে এ দিনে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করেছিলেন। এ জন্যই মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত ভাবমর্যাদাপূর্ণ স্মারক দিবস হিসেবে পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হয়ে আসছে।
ফারসি শব্দ চাহার শোম্বা মানে বুধবার। এই বুধবারই তিনি রোগমুক্তি লাভ করেছিলেন। এ দিনটিকে অনেকে শুকরিয়া দিবসও আখ্যা দিয়ে থাকে। মুসলমানরা নফল ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে দিবসটি কাটান। তাই উম্মতে মুহাম্মদীর আধ্যাত্মিক জীবনে আখেরি চাহার শোম্বার গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম।
আরবি সফর মাসের শেষ বুধবারকে আখেরি চাহার শোম্বা হিসেবে স্মরণ করা হয়। বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে এই আখেরি চাহার শোম্বা পালন করা হয়। সফর মাস নিয়ে নানা কথা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রচলিত আছে। এইসবের কতটা ভিত্তি আছে তা নিয়ে রীতি মাথা খাটিয়েছেন ঐতিহাসিকগণ।
ইতিহাস পাঠেই জানা যায়, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে। (ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন- নববিয়্যাহ ৪/২৮৯)
আল্লামা ইবনু হাযার আসকালানী সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে এই হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করে বুঝাতে চেয়েছেন এটা সফর মাসের শেষ বুধবার নয়। বরং নবীজীর ইন্তেকালের মাত্র ৫ দিন আগের ঘটনা এটি।
বর্তমান ইতিহাস লেখকরাও এ দ্বন্দ্ব থেকে বের হতে পারেননি। তবে এটা সত্য যে, নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের আগে অসুস্থ হয়েছিলেন। তবে এটা কী সফর মাসের শেষের দিকে নাকি রবিউল আ্ওয়ালের শুরু থেকে তা নিয়ে মতভেদ রয়েই গেছে।
একসময় মুসলিম রাজা বাদশাহগণ এই আখেরি চাহার শোম্বা অর্থাৎ সফরের শেষ বুধবার খুব আড়ম্বরতার সঙ্গে পালন করতেন। তৎকালীন দিল্লির বাদশাহী কেল্লায় এ উৎসব উপলক্ষে বিশেষ দরবার বসত। এতে শাহজাদা ও আমিররা শরিক হতেন (ফারহাঙ্গ-ই-আসফিয়া, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১২৬)।
দ্বিতীয় হিজরির প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি./৭৬৮ খ্রি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে রোগ অবস্থায় ইন্তেকাল করেন সে রোগ শুরু হয়েছিল সফর মাসের কয়েক রাত বাকি থাকতে। (আস সিরাহ আন নববীয়্যাহ : ইবনু হিশাম)। বোখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার ইন্তেকাল করেন।
ইতিহাসবিদদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তাঁর ইন্তেকালের তারিখ সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও ১২ রবিউল আউয়ালের মতটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও প্রসিদ্ধ। হজরত আলী রা. সূত্রে ইন্তেকালের এ তারিখটি বর্ণিত হয়েছে। এরপক্ষে ইমাম আহমদ রেজা বেরলভী রহ. এর ফতোয়া রয়েছে। কারণ হজরত আলী (রা.) নবী পরিবারের এমন এক সদস্য যিনি অসুস্থতাকালীন, অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে যাতায়াতকালীন, ইন্তেকাল পরবর্তী গোসলকালীন এমনকি কবরে শায়িত করার সময়ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সোহবতে ছিলেন।
শুরুতেই বলেছিলাম আখেরি চাহার শোম্বা কী? এটা অনেকের কাছেই বড় প্রশ্ন। আমাদের দেশে রুসমী অনেক আমলের দিনের সঙ্গে রয়েছে মারাত্মক বিদআতের ছড়াছড়ি। কারণ, শরীয়ত কতটুকু পালন করতে বলে তা না জেনেই এখানকার মানুষেরা আমলকে বৃদ্ধি করে দেন। ফলে সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিভ্রান্তির সয়লাব হয়।
নবীজী সকালে একটু সুস্থতা অনুভব করলেও বিকালে কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সকালের খুশিটাকে ধরেই মুসলমানগণ আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে চান। তা কি ঠিক? মৃত্যুর দিনটিই ধরুন, ১২ রবিউল আওয়াল নবীজী জন্মলাভ করেছেন আর ১২ রবিউল আওয়ালে ইন্তেকাল করেছেন তাতে তো আর সন্দেহ নেই। একটা গোষ্ঠী যারপরনাই খুশি হয়ে ১২ রবিউল আওয়াল উদযাপন করেন। সাধারণ মানুষকে বুঝতেই দেয়া হয় না-এই দিনটি আসলে মৃত্যুরও দিন। এই দিনে নবীজী ইন্তেকালও করেছেন।
কী ঘটেছিল সফর মাসের শেষ বুধবারে। বুখারী সংকলিত হাদিসে আয়েশা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমার গৃহে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার উপরে ৭ মশক পানি ঢাল…; যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম…। এরপর তিনি মানুষদের নিকট বেরিয়ে যেয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে খুৎবা প্রদান করলেন বা ওয়াজ করলেন। (সহীহ বুখারী ১/৮৩, ৪/১৬১৪, ৫/২১৬০)
গোসল সেরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবি ফাতেমা ও নাতিদ্বয়কে ডেকে এনে সবাইকে নিয়ে সকালের নাস্তা করলেন। হজরত বেলাল রা. এবং সুফফাবাসী সাহাবিরা এ সংবাদ বিদ্যুতের গতিতে মদিনার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। স্রোতের মতো সাহাবিরা নবীজীর দর্শনের জন্য ভিড় জমায়। মদিনার অলিতে-গলিতে আনন্দের ঢেউ যায়। ঘরে ঘরে শুরু হল সদকা, খয়রাত, দান-সাখাওয়াত ও শুকরিয়া জ্ঞাপন।
সাহাবাগণ ধরে নিয়েছিলেন নবীজী আবারও সুস্থ হয়ে ফিরবেন। আবার মসজিদে নববিতে আল্লাহর বড়ত্বের কথা বলবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। বিকালে আবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থতা আর কমেনি। শেষতক তিনি ১২ রবিউল আওয়াল ইহধাম ত্যাগ করেন।
আখেরি চাহার শোম্বা বলতে এটুকুই। এ দিনে বাড়তি আমলের তেমন কিছু নেই। তবে যারা এ দিবসটিকে কুফা, অশুভ দিবস আখ্যা দেন তা খুবই মিথ্যাচার। শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো দিবসই অশুভ নয়। বরং রোববার আর বুধবারকে শুভ দিন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। কোনো কাজ শুরু করার জন্য বুধবারকে উলামায়ে কেরাম গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
লেখক : ছড়াকার ও আলেম সাংবাদিক