আরবের দিনলিপি | | পর্ব- ২৬

আরবের দিনলিপি | | পর্ব- ২৬

  • কাউসার মাহমুদ

‘মায়া কী? টান কাকে বলে? বন্ধন কী?’ সুদীর্ঘ আঠাশ বছরের জীবনে এই প্রথম বোধকরি এর পরিপূর্ণ উপলব্ধিটি আমার হলো। বুঝি এই প্রথম কোথাও কোনকিছুর জন্য এত কাঁদলাম। বুঝলাম, ভ্রাতৃত্ব কী? প্রাণে প্রাণে যে বন্ধন হয়, ভাইয়ে ভাইয়ে যে ডালে ডালে পত্রের মতই মায়ায় মায়ায় জড়িয়ে থাকে, তারই বোধ হল এবার। এমন ক্রমাগত বেদনা, এই দীর্ঘশ্বাস, এই হাহাকার, এই ফিরে যাওয়ার তাড়না—কোনদিন কোনকালেই তো ছিল না আমার। এমনকি এমনটা যে ঘটতে পারে, সে কল্পনাই তো করিনি কোনদিন। কিন্তু যখনই সেই ক্রূর সময়টা এল, যখনই আমরা তিনটা ভাই তিন জায়গায় পড়ে রইলাম, একজনকে ফেলে দুজন দু’প্রান্তের দিকে ছুটলাম, তখন বুঝলাম মায়া কী। মমতার রূপটা কেমন হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে ভালোবাসা কী!

আমার হৃদয়টা এখন কেবল ওই কূল ভাঙা নদীটার সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে। ক্রমাগত ঢেউয়ের আঘাতে যার পাড়ের মাটিগুলি বিদীর্ণ হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ে।

আজ আমার ভাই দুটি থেকে বহুদূরে নতুন কর্মস্থলের নির্জন এক রুমে, যখন বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে এই লেখা লিখছি, তখন মনে হচ্ছে আমার হৃদয়টা এখন কেবল ওই কূল ভাঙা নদীটার সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে। ক্রমাগত ঢেউয়ের আঘাতে যার পাড়ের মাটিগুলি বিদীর্ণ হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ে। হায়! আজ হতে হতে সাতটা দিন হয়ে গেলে ছেড়ে এসেছি ওদের। অথচ, একটি মুহুর্তের জন্যও মনটা স্থির হচ্ছে না।

নিদ্রা, আহারবিহার, হাঁটাচলা, নির্জনতা—যেখানেই নিজেকে ব্যস্ত বা সমর্পণ করছি না কেন, ভাইদের স্মৃতিগুলিই আমাকে ক্ষণে ক্ষণে তাড়িত করছে। সেই তাড়না ও দুঃখগুলি কেমন যেন অদ্ভুত! যেন দিগন্তহীন মরুভূমির শূন্যতা বুকের ভেতর এসে জড়ো হয়েছে। না অর্থ, না ঐশ্বর্য না অন্যকিছুর জন্য এই শূন্যতা নয়। বরং সমস্ত সময় শুধু ওদের স্মৃতি আর পুরাতন সে জায়গার স্মরণই আমার চোখের ওপর দিয়ে হাঁটাচলা করছে। এখানে অনেক অনেক আনজান মানুষদের ভিড়ে যে কারো দিকে তাকালেই নিজেকে বড় অসহায় লাগছে। কারো কোনো কথা কিংবা আচরণ যদি একটুও মিলে যায়, মনে হয়, আমার ভাইয়েরাও আমার সঙ্গে এরূপ করত। তখন কী ভীষণ মনোবেদনায় যে নিপতিত হই, তা ভাষার ব্যক্ত করার শক্তি আমার নেই। ভাবি, যা হওয়ার হয়েছে। চাকুরিটাতে রিজাইন দিয়ে সোজা এক ছুটে পূর্বের সে ক্লান্তিকর কায়িক শ্রমিকের জীবনেই ফিরে যাই৷ কিন্তু তা কি আর সম্ভব! যেহেতু দু বছরের একটি চুক্তিতে নতুন এ জীবন শুরু করেছি, চাইলেই তো আর যেতে পারি না। মূলত এ বিষয়টিই আরো সন্ত্রস্ত, আরো করুণ, আরো বিষণ্ন করে তুলছে আমায়।

হ্যাঁ! এ সত্যি এখনও নানাভাবে নিজেকে একটি কথাই বোঝাচ্ছি যে, ‘তোমার বর্তমান এ জীবন পূর্বের তুলনায় অধিক সহজ। অধিকতর সম্মানজনক। অধিক স্বচ্ছলতার। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে মনেরই সামনে আরেকটা মন এসে বলে, না এসবের কিচ্ছুটির দরকার নেই। তুমি তোমার আগের জায়গাতেই ফিরে যাও৷ এখানে সবকিছু নতুন। অনেক অনেক মানুষ। তুমি যে অন্তর্মুখী আর আর্দ্র মনের, এসবের ভিড়ে নিজেকে মানাতে পারবে না। এজাতীয় মানসিক পীড়নের মধ্যে কীভাবে যে কী করি, ঠাহরই করতে পারছি না। কিন্তু জীবনই তো এই৷ যে জীবনের জন্য এদ্দিন হাহাকার করেছি, তা পেয়ে এখন তাতে বসেই প্রত্যাবর্তনের রোদন করছি।

ফলে আমার রবের অশেষ কৃপার কাছে সর্বাবস্থার মত এখনও আমি আনতই হয়ে আছি। বিশ্বাস করি, আমার প্রভুই উত্তম ফয়সালাকারী। তাঁর উপরই আমার সকল আস্থা। তিনিই একমাত্র ভরসার অধিকারী।

মূলত এ মাসের সাত তারিখ একটি কোম্পানিতে জয়েন করি আমি। বন্ধু ঔপন্যাসিক সাইফুদ্দীন রাজীব ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমার জন্য যথেষ্ট সম্মানজনক এই চাকুরিটির বন্দোবস্ত হয়। পাঠক জানেন, এ রচনার পূর্বের পর্বগুলোয় ধারাবাহিক আমি আমার যে জীবন ও যাপনের কথা বলেছি এবং ভবিষ্যতে একটি পর্যাপ্ত সময় ও সম্মান আছে এমন কাজের আকাঙ্ক্ষা করেছি—বর্তমান চাকুরিটা তা-ই। ফলে আমার রবের অশেষ কৃপার কাছে সর্বাবস্থার মত এখনও আমি আনতই হয়ে আছি। বিশ্বাস করি, আমার প্রভুই উত্তম ফয়সালাকারী। তাঁর উপরই আমার সকল আস্থা। তিনিই একমাত্র ভরসার অধিকারী। এ দৃঢ় মনোবল নিয়েই নিজের নতুন এ কর্মের দিকেই এগিয়ে চলছি আমি।
এতদসত্বেও ক্ষণে ক্ষণে মনটা বিমর্ষ হয়ে পড়ে।

এর সূচনাটি সেদিন বিকেল থেকেই হয়েছিল, যেদিন সামান্য কিছু আসবাব আর প্রয়োজনীয় বইপত্র নিয়ে নতুন এ জায়গার অভিমুখী হই। তারপর দরব,শিকিক, আল-বাহা ও নাম না জানা আরো বহু জায়গা ঘুরে অবশেষে এই আবহাতেই এসে আপাতত বসেছি। আমার পুরনো জায়গা থেকে এর দূরত্ব আনুমানিক প্রায় একশে ত্রিশ কিলো। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে আপাতত এই কাছাকাছি থাকার বিষয়টাই প্রবোধ হিসেবে গ্রহণ করেছি। সেইসাথে কদ্দিন এখানে থাকা যায়—সে ভয়টাও আছে মনে।

নতুন এ জায়গায় বড় একটা ভবনের পুরো নিচতলা নিয়ে নিয়েছে কোম্পানি। সেখানের একদম একটি কোণার রুমে আমরা চারজন কলিগ থাকছি। পাশেই ম্যানেজার সাহেবের রুম। এছাড়া বাকি রুমগুলিতে আপাতত সকল কর্মীরা মিলেমিশে থাকছে। ওদের সঙ্গে কাজের সময়টুকুতেই কদাচিৎ দেখা হচ্ছে আমাদের। যেহেতু কোম্পানির আওতাধীন নতুন প্রজেক্টগুলি এখনও শুরু হয়নি, তাই আবাসস্থলের জায়গাটুকু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের ক্ষেত্রেই তদারকি করছি ওদের। এই কাজে প্রথমদিনেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। খেয়াল করে দেখেছি, এদের মাঝে অনেকেরই কাজ ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা আছে। এদের মাঝে বুড়োরাই বেশি। তরুণরা চটপট। কিছু বললে করে ফেলতে চায়। দ্বিধা প্রকাশ করে না। কিন্তু যারা বয়স্ক, তারা ঈষৎ দোনোমোনো করে। একে তো প্রথম দিন, তার ওপর আমি নতুন, অভিজ্ঞতাহীন, বয়সও দেখতে কম (তাদের চোখে) তাই তাদের আর কিছুই বলিনি। তবে আশাকরি খুব দ্রুতই বিষয়গুলি বুঝে সকলকেই যথাযথভাবে কাজে লাগাত পারব। এটুকু আত্মবিশ্বাস আমার আছে।

মূলত একসাথে দুটি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে আমার। এক তো নিজের সাথে, অন্যটি নতুন চাকরি। ফলে বুঝতেই পারছি, এদ্দিন যে মানসিকতা ও চৌহদ্দির ভেতর ছিলাম, তা থেকে বেরিয়ে বিস্তৃত এক জায়গায় আসা হয়েছে। এখানে বিবিধ দেশের, বিভিন্ন ভাষার, বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। সুকৌশলে তাদের দ্বারা কাজ করাতে হবে। সেইসাথে নিজের দক্ষতাও বাড়াতে হবে। কেননা, পাঠ্যজ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা বড় আলাদা জিনিস। বইয়ের সঙ্গে এতকাল ধরে আমার যে সখ্যতা, এবার তার সাথে মানুষের সখ্যতাও যোগ করতে হবে। নিশ্চিত জানি, ক্ষেত্রবিশেষ বইয়ের জ্ঞান কোনো কাজেই আসে না। এমন অসংখ্য লোকের মুখোমুখি হতে হবে,যারা বড় একগুঁয়ে। তাদেরকে নীতিকথা নয় বরং যথোপযুক্ত আচরণের মাধ্যমেই শান্ত রাখতে হবে।

এইভাবে নিজের কর্মপরিকল্পনার কথাগুলি ভাবতে ভাবতে আবার হঠাৎ মেঘের মত, হৃদয়ের এককোণে সেই ভাই দুটোর কথাই এসে জড়ো হয়। ভাবি, ছোট ভাইটা গেল জেদ্দা শহরে। বড় ভাই আছেন আবহাতেই আমার এখান থেকে একশ ত্রিশ কিলো দূরে। এই বিচ্ছিন্নতা কি আদৌ কাটবে আর। আমার তো বোধকরি আর সুযোগ নেই। কিন্তু শাওন কি বড় ভাইয়ের কাছে ফিরবে! আমার মনে হয়, ফেরাই ভালো। কেননা, ফোনে যখনই ওর সঙ্গে কথা বলছি ওর অস্বস্তি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। খাওয়া-দাওয়ার ভীষণ সমস্যা হচ্ছে। যে পাকিস্তানিদের রুমে গিয়ে উঠেছে, ওরা না-কি বলেছে, শুধু সবজি খেলে রুমে রান্না করে খেতে পারবে। অন্যথা মাছ মাংস হলে, বাহিরে হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসতে। তদুপরি তিনবেলা ওরা খায় রুটি। ফলে আমার ভাইটা যে শোচনীয় অবস্থায় আছে, তা আমি যথেষ্ট উপলব্ধি করতে পারছি। যদিও বারংবার ওখানে যেতে বারণ করেছিলাম আমি। কিন্তু না! আমি চলে এসেছি বিধায় ওর মনটাই টিকলো না আর। ও নতুন একটা কাজে গেল। কিন্তু এখন আমাদের তিন ভাইয়ের অবস্থাই এক। তিন জন তিন জায়গায় বসে বসে কাঁদি আর সমস্ত সংকট শেষ করে আবার একদিন পুনর্মিলনের অপেক্ষা করছি।

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles