পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : আজ পহেলা আষাঢ়। শুরু হলো বৃষ্টির দিন। নদীমাতৃক বাংলার নদীনালা, খাল-বিলসহ সব জলাশয় পানিতে ভরে উঠবে। তাতে ফুটবে শাপলা-পদ্ম আর শত অনামি জলজ ফুল।
পথিকের চোখ আটকে যাবে কদম ও চালতার স্নিগ্ধ সোনালি সবুজে। গ্রামবাংলার দিগন্তরেখায় জলভারানত মেঘের গর্জন রাখালবালককে ব্যস্ত করে তুলবে। বটের নিচের মুদি দোকানে গালগল্পে মাতবে বৃষ্টিবন্দি বুড়োর দল।
শহরের বর্ষায়ও মূল চরিত্র বৃষ্টিই। ছাদের একচিলতে রোদে শুকাতে দেওয়া কাপড়চোপড় ঝমাঝম ভিজিয়ে দেবে হঠাৎ বর্ষণ। গৃহকর্ত্রী ডাল আর চালের মিশ্রণে রাঁধবেন সুস্বাদু খিচুড়ি। নদী-হাওরের বধূরা অপেক্ষায় থাকেন বর্ষার জল ভেঙে নৌকায় বাপের বাড়িতে নাইয়র যেতে।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী আষাঢ়ের পয়লা দিন থেকে বর্ষাকাল শুরু হলেও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসেই বৃষ্টির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে যায় আমাদের। কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির জল ঝাপটা মারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলা ঋতুও খামখেয়ালিপনা দেখাচ্ছে আজকাল।
তবে এ দেশে এখনো আশি শতাংশ বৃষ্টিই হয় আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসে, অর্থাৎ বর্ষায়। বৃষ্টির যে রূপ এ দেশের কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পজনকে মোহিত করে আসছে যুগ যুগান্তর ধরে, তার দেখা পাওয়া যায় বর্ষাকালেই। চলাফেরাসহ জীবনযাত্রায় নানা ব্যাঘাতের বিরক্তি ছাপিয়ে বর্ষার মন জয় করে নিতে দেরি হয় না।
রাজধানী ঢাকায় কয়েক দিন ধরে গ্রীষ্মের খরতাপে প্রাণ আইঢাই করলেও গতকাল সান্ধ্য বাতাসের শীতল স্পর্শ বুঝিয়ে দিয়েছে আষাঢ় আসন্ন। শিগগিরই ঘনঘোর বর্ষণে শীতল হয়ে আসবে সব কিছু। তবে এক সপ্তাহ ধরেই রাজধানীর বাইরের অনেক শহর-জনপদের বাসিন্দারা বৃষ্টি দেখছে।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের অনেক জায়গায় চলছে ক্রমাগত বর্ষণ। সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে প্রায় রোজই। কোনো কোনো দিন রীতিমতো মুষলধারায়। গ্রামবাংলার প্রকৃতি এখন সঘন-সজল। অতিবর্ষণ বন্যা ডেকে এনে দুর্ভোগও আনছে অনেকের জন্য।
বর্ষার অনাবিল বৃষ্টিধারায় শিগগিরই আর্দ্র-কোমল হয়ে উঠবে চারপাশ। সতেজ সবুজে স্নিগ্ধ করে তুলবে বাংলার নিসর্গ। বর্ষায় এখনো ব্যাঙের ডাকে মুখর হয়ে ওঠে অনেক গ্রাম। টিনের চালে বৃষ্টির নূপুর রিনিঝিনি সংগীতের সৃষ্টি করবে। সংগীত, সাহিত্য, চিত্রকলায় নতুন করে কেউ এই সৌন্দর্যকে ধরে রাখবেন।
বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্যের পেছনে বড় ভূমিকা এ ঋতুর ফুলের। বর্ষার বৃষ্টিতে চিরসবুজ চালতা পাতা আরো ঘন ও গভীর সবুজ রূপ পাবে। রবীন্দ্রনাথের গানের কারণেই কি না জানি না, বর্ষা মানেই আমাদের কাছে প্রিয় ফুল কদম। হয়তো এই বর্ষাতেই কোনো প্রেমিক তার প্রিয় মানুষের হাতে তুলে দেবে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’। শুধু ডাঙাতেই নয়, বর্ষার জলেও বসে জলজ ফুলের মেলা। বিলজুড়ে শাপলা মুগ্ধ করে সৌন্দর্যপিয়াসীকে। এখন শুধু বৃষ্টি দেখতে দেশের এদিক-ওদিক ছোটে হাজারো পর্যটক।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানে আমাদের বর্ষাকালের রূপ ও কবির মনের অবস্থা বেশ ভালোভাবে ধরা পড়ে। কবি লিখেছেন, ‘রিমি ঝিম্ রিমি ঝিম্ ঐ নামিল দেয়া/শুনি’ শিহরে কদম, বিদরে কেয়া/ঝিলে শাপলা কমল/ওই মলিল দল/মেঘ-অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া/বারি-ধারে কাঁদে চারিধার/ঘরে ঘরে রুদ্ধ দুয়ার/তেপান্তরে নাচে একা আলেয়া/কাঁদে চখাচখি, কাঁদে বনে কেকা/দীপ নিভায়ে কাঁদি আমি একা/আজ মনে পড়ে সেই মন দেয়া-নেয়া।’
কদম, কেয়া, শাপলা-কমলের এই ঘনঘোর বর্ষায় সময়-সুযোগ থাকলে দরজায় খিল দিয়ে অলস ঘুম দেওয়াই যায়। এ সময় মন দেওয়া-নেওয়ার কথাও স্মরণে এসে যেতেই পারে। ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, বলেছেন না রবীন্দ্রনাথও!