পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম:কক্সবাজার থেকে নৌপথে মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করা জ্বালানি ও ভোজ্য তেল। মেরিন ড্রাইভ থেকে এক লিটার অকটেন পাচারকারীর নৌকায় তুলে দিতে পারলে লাভ মিলছে নগদ ১৬৫ টাকা। কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন সাগর থেকে মিয়ানমার উপকূলে পৌঁছলে সেই অকটেন প্রতি লিটারে লাভ ৩০০ টাকা।
কক্সবাজার দিয়ে মিয়ানমারে তেল পাচারর্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫ সূত্র বলছে, বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে কক্সবাজার থেকে সাগরপথে মিয়ানমারে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাচার হচ্ছে। নগদে বেশি টাকা প্রাপ্তির সুযোগে উপকূলীয় এলাকার অনেকে এই অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
র্যাব-১৫-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (ল অ্যান্ড মিডিয়া) ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাবের একটি দল গত শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের দরিয়ানগর সেতুর ওপর বিশেষ অভিযান চালায়। এ সময় টেকনাফ অভিমুখী দুটি পিকআপ ভ্যান আটক করা হয়।
পিকআপ থেকে ৬৯টি প্লাস্টিক কনটেইনারে থাকা দুই হাজার ৯০০ লিটার অকটেন জব্দ করা হয়। এ সময় পাচারকারী সন্দেহে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। আটক করা ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে র্যাব সূত্র জানায়, উখিয়ার একটি তেলের পাম্প থেকে এই অকটেন প্রতি লিটার ১৩৫ টাকা করে কিনে মিয়ানমারে পাচারের জন্য নেওয়া হচ্ছিল।
আটক করা ছয়জন হলেন উখিয়ার জালিয়া পালং ইউনিয়নের সোনারপাড়ার বাসিন্দা মো. আয়াছ ওরফে রিয়াজ (২২), মো. জসিম উদ্দিন (২০), আলী আকবর (৩৮), মো. সোহেল (১৯), মো. এহাছান উল্লাহ ওরফে রহমত উল্লাহ (২৩) ও রামুর হিমছড়ির বাসিন্দা মো. দেলোয়ার (২৪)।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আটক করা সন্দেহভাজন পাচারকারীরা বলেছেন, পরস্পরের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি তেল মিয়ানমারে পাচার করে আসছিলেন তাঁরা। বিভিন্ন পেট্রাল পাম্প থেকে পাইকারি দামে অকটেন কিনতেন তাঁরা। আটক ছয়জন র্যাব হেফাজতে রয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে রামু থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
টেকনাফ থানার ওসি মো. ওসমান গণি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল মিয়ানমারে পাচার হয়ে আসছে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমাদের পুলিশ দুই দফার অভিযানে মিয়ানমারে পাচারকালে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের চালান জব্দ করেছে।’ ওসি জানান, জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাচার রোধে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে।
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন জানান, চট্টগ্রামের উপকূল দিয়ে গভীর সাগরপথেও মিযানমারে সরাসরি জ্বালানি পাচার হচ্ছে। এ ব্যাপারে তাঁর কাছে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
তিনি জানান, মেরিন ড্রাইভে বসে এক লিটার অকটেন মিয়ানমারগামী নৌযানে তুলে দিতে পারলেই ১৬৫ টাকা নগদ লাভ আসে। এসব কারণে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাচারে জড়িয়ে পড়ছে এলাকার অনেকে।
বাহারছড়া ইউনিয়নের চৌকিদার শহিদুল্লাহ বলছেন, ওই এলাকার বড় ডেইল, শীলখালী, জাহাজপুরা, হাজমপাড়া, মারিশবুনিয়া, নোয়াখালীপাড়া, মহেশখালীয়াপাড়া, হাবির ছড়া, করাচিপাড়াসহ আরো বিভিন্ন স্থান দিয়ে নৌপথে জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের চালান মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাহারছড়ায় পুলিশের একটি তদন্তকেন্দ্র বা ফাঁড়ি থাকলেও কেন্দ্রটির পুলিশ পাচারের কোনো চালান আটক করতে পারেনি। এ বিষয়ে তদন্তকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক মশিউর রহমান বলেন, তিনি পাচার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন।
সীমান্ত এলাকায় সম্প্রতি অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান গৃহযুদ্ধে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমনকি পশ্চিম আরাকানের (রাখাইন রাজ্য) বন্দর শহর মংডুর সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় শহর আকিয়াব এবং রাজধানী ইয়াংগুনের যোগাযোগ রক্ষাকারী সড়কও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এসব কারণে পণ্যসামগ্রী পরিবহনে সর্বত্র গুরুতর সংকট দেখা দিয়েছে। পশ্চিম আরাকানসহ আকিয়াব, ভুচিদং, রাশিদং ও মংডু এলাকায় নিত্যপণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া।
গতকাল শনিবার সকালে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মংডুুর ব্যবসায়ী আবুল কালাম জানান, বাংলাদেশের এক টাকার পরিমাণ এখন মিয়ানমারের ২৭.৫০ কিয়েত। মংডু শহরে ৫০ কেজির এক বস্তা পুরনো চালের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় এখন আট হাজার ৯২৮ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম ১৭৮ টাকা। প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের দাম এক হাজার ৪৫০ টাকা, প্রতি লিটার অকটেনের দাম ৬০০ টাকা, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৪০০ টাকা।
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের পেট্রল পাম্পের মালিক রাশেদ মাহমুদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতি লিটার অকটেন ১৩৫ টাকা ও ডিজেল ১১১ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি কিনে মিয়ানমারে পাচারে অধিক মুনাফা পাচ্ছে পাচারকারীরা। তিনি বলেন, এখানে মুশকিল হলো, পাচারের জন্য কেউ জ্বালানি কিনছে কি না, তা বোঝার উপায় নেই।