গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘে ভোটের অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্রের

গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘে ভোটের অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্রের

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গাজা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনায় এর আগে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এবার খসড়া ওই পরিকল্পনার ওপর নিরাপত্তা পরিষদে ভোট আয়োজনের অনুরোধ করেছে দেশটি। রোববার মার্কিন প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। তেমনি যুদ্ধবিরতির আশায় মধ্যপ্রাচ্য সফরের শুরুতে গতকাল কায়রোতে পৌঁছেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।

মার্কিন প্রতিনিধিদলের মুখপাত্র ন্যাট ইভান্স বলেন, ‘আজ যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে প্রস্তাবিত গাজা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার ওপর ভোট আয়োজনের উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ করেছে।’ তবে কবে নাগাদ ভোটের আয়োজন হতে পারে, সে বিষয়ে তিনি কোনো ধারণা দেননি।

গত ৩১ মে বাইডেন প্রশাসন নতুন একটি গাজা যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা ঘোষণা করে। বাইডেন নিজে এ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। তিন স্তরের এ পরিকল্পনায় গাজায় চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিসমাপ্তি, সেখানে পুরোদমে ত্রাণ সরবরাহ শুরু, হামাসের হাতে বন্দীদের মুক্তি, এ উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার ও হামাসমুক্ত ফিলিস্তিন ভূখণ্ড পুনর্গঠনের কথা বলা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, ইসরাইল এ পরিকল্পনা ‘মেনে নিয়েছে’। গাজার ফিলিস্তিনিদের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস এখন মেনে নিলেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যদিও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বরাবরের মতো এবারো জোর দিয়ে বলেছিলেন, গাজায় ‘নিজেদের লক্ষ্য (হামাসকে নির্মূল) অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত’ যুদ্ধ চলবে। বাইডেন তার যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি এ বিষয়ে কাতারের আমিরের সাথে কথা বলেছেন বলে হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছিল।

এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত গাজা যুদ্ধবিরতির জন্য একটি আঞ্চলিক সফরের শুরুতে সোমবার মিসরে পৌঁছেছেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে দেখা করতে জেরুসালেমে যাওয়ার আগে ব্লিনকেন কায়রোতে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির সাথে রুদ্ধদ্বার আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

মিসর প্রথম আরব রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৯ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হয়। মিসর দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে। সিসি ও ব্লিনকেন মিসর ও গাজার মধ্যে অবস্থিত রাফা সীমান্ত ক্রসিং আবার চালুর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ক্রসিংটি অবরুদ্ধ অঞ্চলে সহায়তা প্রবেশের মূল পয়েন্ট। ইসরাইলি সেনারা এর ফিলিস্তিনি অংশ দখল করার পর থেকে একমাস ধরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

গত অক্টোবরের শুরুতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই অঞ্চলে শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিকের অষ্টম সফর এটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ৩১ মে ঘোষিত একটি প্রস্তাবের সমর্থন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি সফর করছেন। প্রধান মধ্যস্থতাকারী যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতার যুদ্ধবিরতির জন্য কয়েক মাস ধরে আলোচনায় নিযুক্ত রয়েছে। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে এখন পর্যন্ত শুধু নভেম্বরে এক সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি পালিত হয়েছে। সেই সময় প্রায় ১০০ বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়। এদের বেশির ভাগই ইসরাইলের কারাগারে বন্দী ২৪০ ফিলিস্তিনির বিনিময়ে মুক্তি পেয়েছে।

সর্বশেষ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইসরাইল গাজার জনবহুল এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে এবং হামাস প্রাথমিক ছয় সপ্তাহের জন্য যুদ্ধ থামিয়ে বন্দীদের মুক্তি দেবে। পাশাপাশি আলোচনাকারীরা শত্রুতার স্থায়ী অবসানের জন্য যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাবে। হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে এই পরিকল্পনায় সাড়া দেয়নি। সেই সাথে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এ আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ইসরাইলে থাকাকালে ব্লিনকেন মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদ বেনি গ্যান্টজের সাথেও দেখা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে, যিনি রোববার নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন। এরপর আরো আলোচনার জন্য ব্লিনকেন জর্দান ও কাতারে যাবেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুসারে, ৭ অক্টোবর ইসরাইলের আক্রমণে গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। নিহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।
গাজা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ‘যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা দেখতে না পেয়ে’ ইসরাইলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন দফতরবিহীন মন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ। তেল আবিবে রোববার সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ভারাক্রান্ত হৃদয়ে’ তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, নেতানিয়াহু আমাদেরকে সত্যিকারের বিজয়ের দিকে যেতে বাধা দিচ্ছেন, যা চলমান বেদনাদায়ক সংঘাতকে সমর্থন করছে।”
বেনি গ্যান্টজকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী পদের সম্ভাব্য দাবিদার হিসেবে দেখেন কেউ কেউ। পদত্যাগের পর তিনি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন নেতানিয়াহুর প্রতি। এর প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু এক্স পোস্টে লিখেছেন, “বেনি, যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়ার সময় এখন নয়, যোদ্ধা হিসেবে যোগ দেয়ার সময় এটা।” নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বেনি গ্যান্টজ ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সের সাবেক চিফ অব স্টাফ।

২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের আগ পর্যন্ত তার মধ্যপন্থী দল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি বিরোধী দলে ছিল। ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর তিনি নেতানিয়াহুর সাথে যুদ্ধকালীন সরকার গঠনে সায় দেন। যুদ্ধকালীন সরকারে ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির পাঁচজন মন্ত্রী আছেন। গ্যান্টজের সিদ্ধান্তকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক’ বলে বর্ণনা করেছেন বিরোধী দলীয় নেতা জাইর লাপিদ।

বেনি গ্যান্টজের পদত্যাগের ঘোষণার পরপরই মন্ত্রিসভায় জায়গা চেয়েছেন উগ্র ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-জিভিয়ার। ডানপন্থী জোট সরকারের এই শরিক নেতা এর আগে হুমকি দিয়েছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সায় দিলে তিনি পদত্যাগ করবেন এবং জোট সরকার ধসিয়ে দেবেন।

গ্যান্টজ গত মাসেই বলেছিলেন, ছয়টি ‘কৌশলগত লক্ষ্য’ অর্জনে ৮ জুনের মধ্যে গাজার জন্য একটি যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা ঠিক না করলে তিনি পদত্যাগ করবেন। ওইসব লক্ষ্যের মধ্যে গাজায় হামাসের শাসন অবসান ঘটিয়ে সেখানে একটি বহুজাতিক বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিও ছিল। নেতানিয়াহু এসব মন্তব্যকে ‘অর্থহীন কথা’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এর অর্থ হবে ‘ইসরাইলের জন্য পরাজয়’।

প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল ও নেতানিয়াহুর সমালোচক গ্যান্টজকেও যুদ্ধকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সরকারে গ্যান্টজের যে প্রভাব, সেটা নেতানিয়াহুর জোট সরকারে ডানপন্থীদের কর্মকাণ্ডে ‘ভারসাম্য’ রাখছিল বলে বিবেচনা করা হচ্ছিল। সংবাদ সম্মেলনে গ্যান্টজ বলেন, তিনি কেবল সরকার থেকে পদত্যাগ করছেন না, ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির প্রধানের পদও ছেড়ে দিচ্ছেন।

হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার কথা বলেছেন তিনি। ওই হামলার পর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আভি রোজেনফেল্ডই প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রথম যোদ্ধা, যিনি পদত্যাগ করলেন।

ইসরাইলি কমান্ডারের পদত্যাগ : এদিকে হামাসের হামলা থেকে নিজ দেশের জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইসরাইলের গাজা ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এভি রোজেনফিল্ড রোববার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এভি রোজেনফিল্ড বলেন, গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা সীমান্তে ইসরাইলি এবং ইহুদি বসতকারীদের নিরাপত্তা দিতে না পারার ব্যর্থতায় আমি পদত্যাগ করছি। তিনি বলেন, প্রত্যেকেরই নিজের কাজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ১৩৪তম ডিভিশন অর্থাৎ গাজা ডিভিশনের প্রধান হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব এড়াতে পারি না। সেদিন হামাসের ওই ভয়াবহ হামলা ঠেকাতে না পারার ব্যর্থতাকে নিজের কাঁধে নিয়ে আমি পদত্যাগের গোষণা দিচ্ছি। এর আগে গত এপ্রিলে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান আহারোন হালিভাও ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন।

সূত্র: এএফপি

Related Articles