প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক যুবতিকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বললেন ট্রিবিউন ক্লেভিয়াস, ওহে! শোন একটু। আমি তোমাদেরই বলছি, বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রিবিউন মেরুলাসকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। যুবকটিকে দেখিয়ে তিনি জানতে চাইলেন মেয়েটির কাছে, ও তোমার কে হয়?
কথা শুনে লজ্জা পেল মেয়েটি, বলল, আজ্ঞে ও আমার স্বামী।
ক্লেভিয়াস জানতে চাইলেন, কোথা থেকে আসছ তোমরা?
ভয়ে ভয়ে যুবকটি উত্তর দিল, গ্রাম থেকে আসছি আমরা।
তা সেখানে কাজ-কম্মো কিছু করা? জিজ্ঞেস করলেন ক্লেভিয়াস।
উৎসাহিত হয়ে যুবকটি জবাব দিল, আজ্ঞে, গ্রামে আমার কামারশালা আছে, আমি তার দেখাশোনা করি।
চাপা গলায় তাকে ধমকে বললেন ক্লেভিয়াস, সাত-সকালে কাজ-কম্মো ছেড়ে বউকে নিয়ে এতদূর এসেছি কেন? আবার দুজনের হাতেই দেখছি সাজিভরা ফুল। তা কোন দেবতার চরণে দেবে এগুলি?
যুবতি বউটি হেসে জবাব দিল, জুলিয়াস সিজারকে। শুনেছি। অনেক দেশ জয় করে ফিরে আসছেন সিজার। একটু বাদেই নাকি তিনি রথে করে এপথ দিয়ে যাবেন। তাকে দেবার জন্যই গাছের এই সামান্য ফুলগুলি নিয়ে এসেছি আমরা।
ট্ৰিবিউন মেরুলাস বললেন, শুধু এরাই নয়, আরও শত শত মানুষ সে উদ্দেশে এখানে এসেছে, সে তো আপনি নিজের চোখেই দেখলেন।
চাপা গলায় বললেন ফ্লেভিয়াস, সিজারকে দেবে বলে এনেছ? তোমরা কি খোঁজ রাখি যুদ্ধে সিজার কাকে হারিয়েছেন?
হ্যাঁ জানি— জবাব দিল যুবকটি। যুদ্ধে পরাজিত করে পম্পিকে হত্যা করেছেন সিজার। তাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি এখানে।
এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন ফ্লেভিয়াসের সঙ্গী ট্রিবিউন মেরুলাস। দু-জন গ্ৰাম্য যুবক-যুবতির সঙ্গে এত কী কথা থাকতে পারে ফ্লেভিয়াসের—একথা জানার কৌতূহল চাপতে না পেরে পায়ে পায়ে তিনি এগিয়ে এলেন তাদের দিকে। তাকে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন ফ্লেভিয়াস —এবার আপনিই দেখুন ব্যাপারটা! যুদ্ধে পম্পিকে হারিয়ে তাকে মেরে ফেলেছেন সিজার–এ খবর শুনে ওদের আর আনন্দের সীমা নেই। সিজার এদিক দিয়ে ফিরবেন শুনে সাত-সকলে গা ছেড়ে ওরা চলে এসেছে এখানে। এপথ দিয়ে যাবার সময় ওরা ফুল দিয়ে সিজারকে অভ্যর্থনা জানাবে।
ট্ৰিবিউন মেরুলাস বললেন, শুধু এরাই নয়, আরও শত শত মানুষ সে উদ্দেশে এখানে এসেছে, সে তো আপনি নিজের চোখেই দেখলেন।
আক্ষেপ করে বললেন ফ্লেভিয়াস, তাই তো দেখছি। যে পম্পিকে যুদ্ধে হারিয়ে তাকে হত্যা করেছেন সিজার, সেই পম্পিকে সম্মান জানাবার জন্য একদিন রোমের রাজপথে ভিড় জমাত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা! আমি নিজে দেখেছি পম্পিকে সম্মান জানানোর জন্য দুধের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ফুলের সাজি হাতে যুবতিরা সকাল-সন্ধে অপেক্ষা করেছে। অদৃষ্টের পরিহাসে সে ছবিটা আজ পুরোপুরি পালটে গেছে। পম্পির হত্যাকারীকে সম্মান জানাতে তারা সব কাজ-কর্ম ফেলে দলে দলে ছুটে আসছে। যে গ্ৰাম্য-দম্পতিকে উদ্দেশ করে এসব কথা বলা, তারা তো অনেক আগেই চলে গেছে। তবুও ভিড়ের মাঝে অনেকেরই কানে এল ফ্লেভিয়াসের আক্ষেপ।
ভিড়ের মাঝে সমবেত লোকদের লক্ষ্য করে আপন মনে বলতে লাগলেন ফ্রেভিয়াস, এই সেদিন পর্যন্ত রোমের নিয়ন্ত্রক ছিলেন সেনাপতি পম্পি! আশ্চর্য! তোমরা কিনা এত সহজে তাকে ভুলে গেলে? সিজারের সাথে যুদ্ধে পম্পি হেরে যাওয়ায় আজ তোমরা সিজারের গুণ-গান করছা! পম্পির উপকারের কথা তোমরা এত সহজেই ভুলে গেলে? তোমরা নিশ্চয়ই জান উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে না সে অকৃতজ্ঞ ছাড়া আর কিছু নয়। যাও, চলে যাও তোমরা। বাড়ি গিয়ে দেবতার সামনে হাঁটু গেড়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর তোমরা। নইলে দেবতার রোষে ধ্বংস হয়ে যাবে রোম।
কানুন, যার বলে তারা অসীম ক্ষমতার অধিকারী। রোমের সাধারণ মানুষেরা মনে করে তারা গরিব জনসাধারণের প্রতিনিধি। তাই ট্রিবিউন ফ্রেভিয়াসের ধমক খেয়ে আস্তে আস্তে ভিড় ফাকা হয়ে গেল। যারা সিজারকে সম্মান জানাতে এসেছিল, ফ্লেভিয়াসের ধমক খেয়ে মুখ কালো করে তারা সবাই ফিরে গেল। সাধারণ মানুষ মোটেও ভাবে না পম্পি বা সিজারকে তাদের জন্য কী করেছে। যে সব উচ্চাভিলাষী তাদের পথের বাধা দূর করে তাঁর তর করে এগিয়ে যেতে পারেতাকে নিয়েই মাতামাতি করে লোকেরা, মাথায় তুলে নাচে, ফুল দিয়ে সংবর্ধনা জানায় তাকে।
প্রায়-দু-হাজার বছর ধরে রোমের বীর সেনাপতিরা দুৰ্দান্ত লড়াই করে একের পর এক নতুন রাজ্যের সৃষ্টি করেছেন। এমনই এক বীর সেনাপতি ছিলেন পম্পি। এই সেদিন পর্যন্ত রোমের প্রতিটি মানুষ তাকে দেশের ভাগ্য-নিয়ন্তা বলে মানত। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হবার পর সিজার নিজ হাতে হত্যা করেন পম্পিকে। আজকে আমরা যাকে ফ্রান্স ও ব্রিটেন বলে জানি, সেখানে তারা পরিচিত ছিল গল ও ব্রিটানি নামে। ওই দুটি রাজ্যে পাকাপাকিভাবে রোমান শাসন প্রবর্তন করে বহুদিন বাদে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে আসছেন সিজার।
রোমে এমন বহু লোক এখনও আছে যারা পম্পি মারা যাবার পরও তাকে সমর্থন করে জুলিয়াস সিজারকে ভাবে দেশের শত্রু। অন্য দল মনে করে সিংহাসনে বসলে প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হবেন সিজার। দেশ ও দশের পক্ষে তা মোটেই কল্যাণকর নয়। এই দ্বিতীয় দলের মধ্যে রয়েছে অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষ যারা আবার সিজারের বন্ধুও বটে। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো যোদ্ধা। — তারা মনে করেন সুযোগ এবং ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন হলে তারা অনেকেই সিজারের মতো কৃতিত্ব দেখাতে পারতেন। দিন দিন যে ভাবে জুলিয়াস সিজারের ক্ষমতা বেড়ে চলেছে তা দেখে অনেকের চোখের ঘুম উবে গেছে। সিজারকে ক্ষমতাচুৰ্যত করার সংকল্প নিয়ে তারা একজোট হয়েছেন। তারা আপ্ৰাণ চেষ্টা করছেন দেশের জনমত যাতে সিজারের বিরুদ্ধে যায়–তারা চাইছেন দেশের মানুষকে সিজারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে। কিন্তু জয়ের আনন্দে ডুবে থাকা সিজার এ ষড়যন্ত্রের বিন্দুমাত্ৰ আভাসও পাননি। শুরুতে আমরা ফ্লেভিয়াস আর মেরুলাস নামে যে দুজন ট্রিবিউনকে দেখতে পেয়েছি তারা উভয়েই সিজারবিরোধী। তাদের কথাবার্তাই এর প্রমাণ।
জনতার ভিড় ফাঁকা হয়ে যেতে সহযোগীর দিকে তাকিয়ে বললেন ট্রিবিউন ফ্লেভিয়াস, তাহলে মেরুলাস, আপনি রাজধানীর দিকেই যান।
মেরুলাস বললেন, সে না হয় যাচ্ছি। আপনি তো ধমক দিয়ে সবাইকে বাড়ি পাঠালেন। এবার কী করবেন। আপনি?
ফ্লেভিয়াস উত্তর দিলেন, আমি শুনেছি কিছু লোক নাকি শহরের মধ্যে সিজারের একটা মূর্তি বসিয়ে তাকে ফুল-মালায় সাজিয়েছে। আমি চাই মূৰ্তিটা খুঁজে বের করে সেটা ভেঙে দিয়ে আসতে।
যাই করুন না কেন, সেটা চিন্তা-ভাবনা করে করবেন, তাকে সাবধান করে বললেন মেরুলাস, আজ আবার লুপারকাল উৎসবের দিন। শহরের সব বাড়িতেই ভালোমত খানাপিনা হবে।
সে যাই হোক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না, বললেন ফ্লেভিয়াস, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি। রোমের রাস্তা-ঘাটে সিজারের মূর্তি দেখতে পেলে আমি তা ভেঙে গুড়িয়ে দেব। আমি চাই আপনিও তা করুন। সিজারের সম্মানের জন্য কোথাও সাজ-সজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে দেখলে আপনি তা টেনে ছিড়ে ফেলে দেবেন। সিজারের বড় বড় বেড়েছে। ওর ক্ষমতা বেড়ে যাবার আগেই ধ্বংস করতে হবে তাকে। নইলে ঝামেলায় পড়ে যাব আমরা। এসব কথা বলতে বলতে দু-জন দু-দিকে চলে গেলেন।
রাজধানী রোম শহরের মধ্যে সাধারণত যে জায়গায় সভাসমিতি হয়, জুলিয়াস সিজার চলে এলেন সেখানে, সাথে পত্নী কালফুর্নিয়া, মার্ক অ্যান্টনি, ব্রুটাস, ক্যাসিক, সিসেরো ও ডেসিয়াস। সিজারের পেছন পেছন এল জনতার এক বিশাল বাহিনী। তাদের মধ্যে ছিলেন দুই ট্রিবিউন ফ্রেভিয়াস আর মেরুলাস। সেই সাথে ছিল ভবিষ্যৎবক্তা এক জ্যোতিষী।
স্ত্রীকে ডেকে সিজার বললেন, কালফুর্নিয়া! তুমি গিয়ে সোজাসুজি দাঁড়াও অ্যান্টনির যাবার পথে। আর অ্যান্টনি! তুমি কিন্তু ভুলে যেও না যাবার পথে কালফুর্নিয়াকে একবার ছুঁয়ে যেতে। কিন্তু দুজনের কেউ বুঝতে পারল না একথা বলার মানে কী। তারা অবাক হয়ে চেয়ে রইল সিজারের দিকে।
মৃদু হেসে বললেন, বুঝতে পারছি না, তাই না? পুরনো দিনের লোকেরা বলতেন লুপারকাল উৎসবের তারিখে যাবার পথে যদি কোনও বীর যোদ্ধা বন্ধ্যা নারীকে ছুঁয়ে দেয়, তাহলে সে নারী গৰ্ভবতী হয়ে ওঠে।
সিজারের আদেশ শুনে অ্যান্টনি বললেন, আমি অবশ্যই আপনার কথা মনে রাখব। সিজার। সে সময় ভিড়ের মাঝ থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠল। সেই ভবিষ্যৎবক্তা জ্যোতিষী, মহামান্য সিজার। আইডস অব মার্চ (১৫ মার্চ) দিনটা আপনার পক্ষে অশুভ! আগে থেকেই আপনি সে ব্যাপারে সাবধান হবেন।
কে বলল কথাটা? জানতে চাইলেন সিজার। আজ্ঞে, ও একজন জ্যোতিষী, জবাব দিলেন ব্রুটাস, ও বলছে আইডস অব মার্চ দিনটি আপনার পক্ষে অশুভ। তাই আগে থেকে ও ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছে সে।
সিজার আদেশ দিলেন, যাও, লোকটাকে ধরে নিয়ে এস আমার সামনে। আমি দেখতে চাই তাকে সিজারের কথা শেষ হতে না হতেই ভিড়ের মাঝ থেকে লোকটাকে টানতে টানতে সিজারের সামনে এনে হাজির করল কাসকা।
সিজার বললেন, তুমি জ্যোতিষী? আবার বল তো কিছুক্ষণ আগে তুমি আমায় যা বলছিলে।
জ্যোতিষী বলল, গণনায় দেখতে পাচ্ছি। আইডস অব মার্চ দিনটি আপনার পক্ষে অশুভ। তাই সাবধান হতে বলেছি আপনাকে।
ভালোভাবে লোকটির মুখখানা দেখে সিজার বললেন, বেচারা বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। যাই হোক আমি এখন যাচ্ছি। উৎসবের যেন কোনও ত্রুটি না হয়।
কথা শেষ হবার পর পত্নী কালফুর্নিয়া আর মার্ক অ্যান্টনিকে সাথে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন সিজার। শুধু ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল সিজারকে নিয়ে।
এবার ব্রুটাসের দিকে তাকিয়ে বললেন ক্যাসিয়াস, যাও হে, উৎসবের বাকিটুকু দেখে এস।
নিষ্পৃহ গলায় উত্তর দিল ব্রুটাস, না ভাই, ও সব হইচই খেলাধুলা, অ্যান্টনির ভালো লাগতে পারে, ওতে আমার কোনও উৎসাহ নেই। তুমি যা বলতে চাও, এইবেলা বলে ফেল। আমায় আর উৎকণ্ঠার মাঝে রেখা না। এখন আমায় বাড়ি যেতে হবে।
কাতর স্বরে বলল ক্যাসিয়াস, আজি-কাল দেখছি তুমি আমায় দেখতে পেলেই বেশ গভীর হয়ে যাও। আরও লক্ষ করেছি আমার প্রতি তোমার স্নেহ-ভালোবাসাও সেরূপ নেই। দয়া করে এর কারণটা বলবে কি?
অবাক হয়ে বলল ব্রুটাস, কী বলছি তুমি? তোমায় দেখলে আমি গভীর হয়ে যাই? নিশ্চয়ই তুমি আমায় ভুল বুঝেছ ক্যাসিয়াস।
তোমাকে দেখে গম্ভীর হবার কোনও কারণ এখনও ঘটেনি। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে মনের ভেতর যে অন্তৰ্দ্ধন্দ্ব হচ্ছে তাতেই ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি আমি। এসব নিয়ে এত বিব্রত আমি যে কোনও বন্ধুর সাথে দেখা হলেও বন্ধুসুলভ আচরণ করা হয়ে ওঠে না তার সাথে।
মানসিক অস্তদ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত ব্রুটাস? এতো সোনায় সোহাগা! যে বিষয়ে আলোচনা করতে চায় ক্যাসিয়াস, তার দরজা নিজেই খুলে দিল ব্রুটাস। হঠাৎ বলে উঠলেন ক্যাসিয়াস, আচ্ছা! ব্রুটাস, তুমি কি নিজের মুখ নিজে দেখতে পাও?
পালটা প্রশ্ন করলেন ব্রুটাস, তা কী সম্ভব? আরসি ছাড়া কি নিজের মুখ দেখা যায়?
সায় দিয়ে ক্যাসিয়াস বললেন, এবার একটা খাঁটি কথা বলেছ তুমি। এমন কোনও আরসি। নেই যার মধ্যে তুমি দেখতে পাবে তোমার ভেতরের যোগ্যতা আর গুণাবলি। আমি নিজে দেখেছি এই শহরে সিজার ছাড়া বহু নামি লোক আছেন যাদের মুখে অহরহ শোনা যায় ব্রুটাসের নাম। তারা সবাই মানসিক-দ্বন্দ্বের শিকার। এতে কোনও দ্বিরুক্তি নেই যে ব্রুটাসের মন জয় করার উদ্দেশ্যেই এ সব কথা বলছে ক্যাসিয়াস।
স্পষ্ট করে বল তো ক্যাসিয়াস, কী বলতে চাও তুমি? জানতে চাইল ব্রুটাস, কেন তুমি বলছি আমার গুণাবলির দিকে নজর দিতে?
ক্যাসিয়াস বলল, তাহলে শোন তুমি, এবার থেকে আমি হব সেই আয়না যার মধ্যে ফুটে উঠবে তোমার গুণাবলি–– যার সম্বন্ধে কোনও কিছুই জানা নেই তোমার। তার কথা শেষ হতে হতেই কানে এল বহু মানুষের কোলাহল, আনন্দ আর জয়ধ্বনি।
ক্যাসিয়াস! ও কীসের জয়ধ্বনি? জানতে চাইল ব্রুটাস; তাহলে কি সবাই মিলে রাজা বানিয়ে দিলে সিজারকে?
ব্রুটাসকে একটু খোঁচা দেবার লোভ সামলাতে না পেরে ক্যাসিয়াস বললেন, মনে হচ্ছে সিজার রাজা হোক এতে তোমার আপত্তি আছে।
আপত্তি আছেই তো! বললেন ব্রুটাস, তা সত্ত্বেও সিজারকে আমি ভালোবাসি, সে কথা মনে রেখা তুমি। আমি আবারও বলছি সত্যি করে বল তো আমার কাছে কী চাও তুমি! যদি জনসাধারণের কল্যাণমূলক কিছু বলতে চাও, তাহলে নিৰ্ভয়ে বলতে পার তুমি। যদি তার সাথে সম্মান এবং মৃত্যু–দুটোই জড়িত থাকে, তাহলেও তা নিয়ে মাথা ঘামাব না আমি।
যাক, এতক্ষণে তুমি আঁচ করতে পেরেছ আমার বক্তব্যের কিছুটা, বললেন ক্যাসিয়াস, তুমি ঠিকই বলেছ ব্রুটাস, আমি যা বলতে যাচ্ছি তার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের মানুষের মঙ্গল এবং মর্যাদার প্রশ্ন! তুমিই ভেবে দেখ না কেন আমরা উভয়েই ছোটোবেলা থেকে যা খেয়ে বড়ো হয়েছি, সেই খাবার সিজােরও খেয়েছে। সিজারের চেয়ে বেশি ছাড়া কম শক্তিধর নই আমরা। এই সেদিনের কথাই ধরনা কেন, বর্ষায় ফুলে ফেপে ওঠা টাইবার নদীর সামনে গিয়ে সিজার আমাকে বলল, এই নদীতে ঝাপ দিতে পারবে তুমি? তার কথার উত্তর না দিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। সাথে সাথে সিজারও নেমে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরে বেশ ভালোভাবে সাঁতার কেটে চলেছি আমরা, এমন সময় কানে এল সিজারের আর্ত কণ্ঠস্বর, আমায় বাঁচাও ক্যাসিয়াস! জলে ডুবে যাচ্ছি আমি। জল থেকে সেদিন তাকে না তুললে নদীর অতলে তলিয়ে যেত সিজার। পম্পিকে হত্যা করে রোমের মানুষের কাছে সেই সিজার। আজ দেবতা। আর তাকে প্ৰাণে বঁচিয়েও এই হতভাগা ক্যাসিয়াস আজও সেই ক্যাসিয়াসই রয়ে গেল। সিজারের কথা রোমের মানুষের কাছে আজ দৈববাণী স্বরূপ। তুমি কি জান সিজার একজন মৃগী রোগী? প্রচণ্ড জুরের ঘোরে মৃগীরোগের তাড়নায় বেঙ্কুশ হয়ে থারথার করে কঁপিছে তার দেহ–সিজারের এরূপ অবস্থা আমি নিজের চোখে দেখেছি! আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছি কীভাবে সেই লোকটা এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠল।
ক্যাসিয়াসের কথা শেষ হতে না হতেই পুনরায় শোনা গেল সিজারের নামে জনতার জয়ধ্বনি।
ব্রুটাসের গলায় আশঙ্কার সুর ফুটে বলল। সে বলল, মনে হয় রোমের লোকেরা নতুন কোনও সম্মানে ভূষিত করছে সিজারকে। তাই বারবার জয়ধ্বনি দিচ্ছে তার নামে।
সম্মানের কথা কী বলছি ব্রুটাস! বললেন ক্যাসিয়াস, এই মুহূর্তে রোমে সিজার ছাড়া অন্য কেউ নেই যে এরুপ নাগরিক সংবর্ধনার যোগ্য। কী আশ্চর্য দেখ, এই লোকটা কীভাবে পুরো দেশটা শাসন করছে। আগে কখনও এমনটি দেখেছ? অথচ ভেবে দেখ সিজারের মধ্যে এমন কী আছে যা তোমার নেই। তুমি কি জান ব্রুটাস নামে তোমার এক পূর্বপুরুষ তার বীরত্ব ও দেশপ্রেমের জন্য লোকের কাছে কত আদরণীয় ছিলেন? দেশের সম্মান রক্ষা করার জন্য তিনি শয়তানের সাথে লড়তেও রাজি ছিলেন। ভাব তো সে সব কথা! আজি কিনা সিজারের মতো লোক দেশের রাজা হতে চলেছে? আর ব্রুটাস তুমি, সেই ব্রুটাসই রয়ে গেলে। এখন আমার প্রশ্ন এসব কি ঠিক হচ্ছে, আর কেনই বা এসব হতে দেব?
ক্যাসিয়াসের দিকে চেয়ে ব্রুটাস বললেন, আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। এবার আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি তুমি আমায় দিয়ে কী করাতে চাও। তবে এ ব্যাপারে এখনই আমি কিছু বলব না, যা বলার তা পরে বলব। তুমি আজ বাড়ি চলে যাও। পরে এ ব্যাপারে তোমার সাথে আলোচনায় বসব আমি।
ব্রুটাসের কথা শেষ হতে না হতেই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ফিরে এলেন সিজার। ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসকে দেখতে পেয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন তাদের দিকে। তারপর গলা চড়িয়ে বললেন, মার্কাস অ্যান্টনিয়াস!
সিজারের আহ্বানে অনুগত ভূত্যের মতো তার সামনে এসে দাঁড়াল মার্ক অ্যান্টনি।
সিজার বললেন, দেখ অ্যান্টনি, কয়েকজন মোটাসোটা সরল মনের লোকের প্রয়োজন আমার। তুমি সেরূপ কয়েকজন লোককে পাঠিয়ে দেবে। দেখবে লোকগুলো যেন ক্যাসিয়াসের মতো লিকলিকে না হয়। ক্যাসিয়াসের যেমন হাড়-জিরজিরে চেহারা, তেমনি কোটরে বসা ওরা দুচোখের চাহনি কত তীক্ষ আর জোরালো। মনে হয় ও খুব চিন্তা-ভাবনা করে, মাথা ঘামায়। এসব লোক কিন্তু খুবই বিপজ্জনক।
অ্যান্টনি বললেন, না মহামান্য সিজার, ক্যাসিয়াসকে আপনি সেরূপ লোক ভাববেন না। দেখতে রোগ হলেও উনি একজন সৎ এবং মহান রোমান।
সিজার বাধা দিয়ে বললেন, অ্যান্টনি! তোমার কথা সঠিক নয়। আমি আবারও বলছি ক্যাসিয়াস একটু মোটা হলে ভালো হত। ভুলে যেওনা ও প্রচুর পড়াশুনো করে। সবকিছু খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রয়েছে ওরা। তোমার মতো ক্যাসিয়াসও খেলাধুলা, গানবাজনা কিছুই ভালোবাসে না–এমনকি প্ৰাণ খুলে হাসতেও জানে না। যারা প্ৰাণ খুলে হাসে তাদের ও ঘেন্না করে। এসব লোক যখন দেখে তাদের পরিচিত কেউ অনেক উপরে উঠে গিয়েছে, তখন তারা হিংসায় জুলেপুড়ে মরে। এদের থেকে যতটা সম্ভব ব্যবধান রেখে চলা উচিত। তাই বলে ভেব না যেন আমি এদের ভয়ে ভীত। আমি জুলিয়াস সিজার–কাউকে ভয় পাই না আমি।
অ্যান্টনির সাথে কথা বলতে বলতে সিজার অন্যদিকে চলে গেলেন তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে।
ক্যাসিয়াসের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের একজন ক্যাসকা। তার কাছ থেকে ব্রুটাস শুনতে পেলেন উপস্থিত জনতার সামনে অ্যান্টনি একটা রাজমুকুট পরিয়ে দিতে গিয়েছিল সিজারের মাথায়। কিন্তু পরপর তিনবারই সিজার অ্যান্টনির হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। তা দেখে সবার ধারণা হয় সিজার রাজমুকুট পরতে চান না। অর্থাৎ রাজা হবার কোনও বাসনা নেই তার! এসব দেখে-শুনে ক্যাসকার মনে হয়েছে জনতার কাছে মহৎ সাজার জন্যই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঐ রাজমুকুট ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন সিজার। নইলে রাজমুকুট পরার সাধ তার খুবই ছিল। ক্যাসিয়াসও সায় দিল সে কথায়।
সে রাতে ক্যাসিয়াস তার মতাবলম্বী আরও কয়েকজনকে বাড়িতে ডেকে এনে গোপনে নানারূপ আলোচনা করলেন। এভাবেই শুরু হল সিজারকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র। বহুদিন হল রাজাকে উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের মানুষ— কায়েম হয়েছে জনগণের শাসন। একের পর এক যুদ্ধে জিতে আর দেশ জয় করে উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে সিজার। রাজমুকুট মাথায় না। পড়লেও সিজার যে রাজা হতে চান সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু রোমের শাস্তিকামী জনগণ কিছুতেই রাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে রাজি নয়।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে ব্রুটাসের বাড়িতে নিয়ে এলেন ক্যাসিয়াস। রোমের সবাই জানে ক্যাসিয়াস লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। তাকে চিনতে ভুল হয়নি সিজারের। কিন্তু ক্রটাস এক বুদ্ধিজীবী লোক, ব্যক্তিগতভাবে তাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন সিজার। এ ধরনের লোককে দলে ভেড়াতে না পারলে সিজারকে হঠাবার চক্রান্ত মোটেই সফল হবে না। কাজেই সবার সম্মুখে রোমের স্বাধীনতা রক্ষায় ব্রুটাসের সাহায্য চাইলেন। প্রয়োজন হলে দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করতে হবে–বেশ নাটকীয় ঢং-এ সবার সামনে একথাটা বললেন ক্যাসিয়াস।
ব্রুটাস সবাইকে জানালেন রাতের অন্ধকারে কে বা কারা তার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে প্রচুর চিঠি ফেলে রেখে গেছে। সব চিঠিরই বক্তব্য মোটামুটি একই রকম–রোমের মানুষ প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে ব্রুটাসকে। সেই সাথে সিজারের উচ্চাভিলাষের উল্লেখও রয়েছে সে সব চিঠিতে। ব্রুটাস জানালেন দেশের মানুষ যে তাকে এত ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে তা তিনি জানতেন না। ব্রুটাসের কথা শুনে মনে মনে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন ক্যাসিয়াস, কারণ বুদ্ধিটা তারই। নানা লোককে দিয়ে চিঠিগুলো লিখিয়ে রাতের অন্ধকারে নিজেই সেগুলি ফেলে দিয়েছিলে ব্রুটাসের ঘরে। চিঠিগুলো পড়েই পালটে গেছে ব্রুটাসের মন। সিজারকে উৎখাত করার কথা দানা বাঁধতে শুরু হয়েছে তার মনে।
এবার চালে বাজিমাত করলেন ক্যাসিয়াস–সফল হল তার উদ্দেশ্য। স্পষ্ট ভাষায় ব্রুটাস জানিয়ে দিলেন সিজারকে হাঁটাবার চক্রান্তে তিনিও সামিল আছেন এবং সে ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। তিনি, কারণ সিজারের চেয়ে দেশ তার কাছে অনেক বেশি দামি। নিজের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে সিজার যদি রোমের মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতে চান, তাহলে তাকে হটিয়ে দিতে পেছপা হবেন না তিনি।
অনেক রাত ধরে সবাই আলোচনা করলেন কীভাবে হটানো যায় সিজারকে। এ বিষয়ে সবাই একমত হলেন যে সিজারকে হটাতে হলে তাকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। কিন্তু সমস্ত সৈন্যরা সিজারের অনুগত, দেশের প্রধান সেনাপতি তিনি। দেশের মানুষদের অধিকাংশই তার সমর্থক। স্বার্থের সংঘাত বেধে গেলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে, কেউ তা রোধ করতে পারবেনা। একবার যুদ্ধ বেধে গেলে ক্যাসিয়াস ও তার সহযোগীরা সবাই কচুকাটা হবে সিজারের সেনাবাহিনীর হাতে। কাজেই যুদ্ধ বেঁধে যাবার আগেই হত্যা করতে হবে সিজারকে। এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সেই ১৫ মার্চ। রোমের সেনেটের সদস্যরা সে দিন এক বিশেষ অধিবেশন ডেকেছেন আর তাতে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান হয়েছে সিজারকে। চারদিকে কানায়ুষো শোনা যাচ্ছে সেনেটের সদস্যরা নাকি সিজারের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান দেশে। সাথে সাথে এও শোনা যাচ্ছে জনতার কাছে মহান হবার জন্য তিনবার রাজমুকুট ফিরিয়ে দিয়েছেন সিজার। কিন্তু এবার সেনেটররা তার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিলে সানন্দে তিনি তা গ্রহণ করবেন। এদিকে ক্যাসিয়াস-ব্রুটাস চক্রও কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। তারা সংকল্প করেছে সেনেটের ভেতর মাথায় রাজমুকুট পরার আগেই তারা হত্যা করবে সিজারকে।
ঘটনার আগের দিন রাতে ঘুমের ঘোরে বারবার দুঃস্বপ্ন দেখেছেন সিজার পত্নী কালফুর্নিয়া। ঐ দিন শুধু সেনেটে যাওয়া নয়, রাজপ্রাসাদ থেকে বেরুতেও নিষেধ করেছেন স্বামীকে।
কিন্তু সেই বীর জুলিয়াস সিজার, যার জীবনের প্রায় অর্ধেক কেটে গেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ করতে করতে— সে ভয় পায় না। দুঃস্বপ্নে। তার মতে ভীরুরা বারবার মরে, আর বীর একবারই মরে। কিন্তু স্ত্রীর কথায় কিছুটা বিচলিত হলেন তিনি। তিনি স্থির করলেন আজ সেনেটে যাবেন না, প্রাসাদেই কাটাবেন কালফুর্নিয়ার সাথে, যড়যন্ত্রকারীদের কাছে যথাসময়ে খবর পৌঁছে গেল। আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও আজ সেনেটে যাবেন না সিজার। ষড়যন্ত্রকারীরা দেখল সিজার সেনেটে না গেলে তাদের এতদিনের মতলবটো ভেস্তে যাবে। ডেসিয়াস ব্রুটাস ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের একজন। ক্যাসিয়াস তাকেই দায়িত্ব দিলেন ভুলিয়ে-ভালিয়ে সিজারকে সেনেটে নিয়ে আসার।
ক্যাসিয়াসের নির্দেশে সিজারের প্রাসাদে গেল ব্রুটাস ডেসিয়াস সিজার তাকে বললেন গতরাত ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখেছে তার স্ত্রী। তাই তিনি স্থির করেছেন আজ সেনেটে যাবেন না।
ডেসিয়াস ব্রুটাস বললেন, আপনার স্ত্রী কি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তা কি আমায় শোনাবেন?
সিজার বললেন, নিশ্চয়ই শোনাব। কাল রাতে আমার স্ত্রী স্বপ্ন দেখেছে যে আমার প্রতিমূর্তির মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরুচ্ছে এবং রোমের বিশিষ্ট নাগরিকরা হাসিমুখে সেই রক্ত দিয়ে তাদের হাত ধুয়ে নিচ্ছেন। স্ত্রীর মতে এই স্বপ্ন আমার জীবন সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই স্থির করেছি আজ আর বের হব না।
ডেসিয়াস ব্রুটাস বলল, মাননীয় সিজার! আপনার স্ত্রীর প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা উনি দিয়েছেন তা ঠিক নয়। বরঞ্চ উনি যে স্বপ্ন দেখেছেন তা সব দিক দিয়েই সৌভাগ্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আপনার প্রতিমূর্তির মুখ দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে রক্ত বেরুচ্ছে আর সেই রক্তে বিশিষ্ট রোমান নাগরিকরা হাত ধুচ্ছেন-এর অর্থ নানা দেশের রক্ত সংগ্রহ করে রোমের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনবেন আপনি। আর এ কাজে রোমের বিশিষ্ট নাগরিকরা সাহায্য করবেন। আপনাকে। আপনি কেন এই সুলক্ষণযুক্ত স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বলে ধরে নিচ্ছেন মাননীয় সিজার?
তাহলে তুমি আমার স্ত্রীর স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা করছ? বললেন সিজার, আসলে এভাবে আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি।
ব্রুটাস ডেসিয়াস বললেন, এবার আমার কথা শুনুন মহামান্য সিজার। আজ সেনেটেররা আপনার মাথায় রাজমুকুট পরাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি না গেলে হয়তো তাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তনও হতে পারে। ভুলে যাবেন না, আপনার স্ত্রী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন বলে আপনি সেনেটে যাবেন না, তাহলে সেনেটরদের কাছে আপনার মান-মর্যাদা থাকবে কি? আপনি তাদের কাছে কাপুরুষের পর্যায়ে পড়ে যাবেন।
মনে মনে স্ত্রীর কথা ভেবে বললেন সিজার, কালফুর্নিয়া! দুঃস্বপ্ন দেখে যে ভয় তুমি পেয়েছ তা নিছক ভিত্তিহীন— এতে কোনও সন্দেহ নেই আমার। ওহে কে আছ! আমার সেনেটে যাবার পোশাকগুলো এনে দাও।
ডেসিয়াস চলে যাবার আগেই একে একে সেখানে এলেন ক্যাসিক, সিন্না, মেটেলাস, লিগারিয়াস, ট্রোবনিয়াস এবং ক্যাবলিয়াস।
তাদের সবাইকে দেখে অবাক হয়ে বললেন সিজার, কী ব্যাপার! তোমরা সবাই এসে হাজির হয়েছ আমার বাড়িতে? তোমাদের সবাইকে জানাই সুপ্ৰভাত। ঠিক সে সময় এসে হাজির মার্ক অ্যান্টনি।
তাকে দেখে হেসে বললেন সিজার, কী ব্যাপার অ্যান্টনি! অনেক রাত অবধি ফুর্তি করেও এই সাত সকালে এসেছ তুমি?
সিজারকে হাসিমুখে অভিবাদন জানিয়ে অ্যান্টনি বললেন, সুপ্ৰভাত সিজার।
এক এক করে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন সিজার, এসো, ভেতরে গিয়ে আমার সাথে সামান্য মদ্যপান করবে। তারপর আমরা সবাই একসাথে সেনেটে যাব।
এদিকে আর্তেমিদোরাস নামে এক গ্রিক অধ্যাপক কোনওভাবে জানতে পেরেছিলেন সিজারকে হত্যার চক্রাস্তের কথা। তিনি সিজারকে উদ্দেশ্য করে চক্রান্তকারীদের সবার নাম জানিয়ে একটা চিঠি লিখলেন। যেদিক দিয়ে সিজার সেনেটে ঢুকবেন তিনি তার একাধারে চিঠিটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন যে জ্যোতিষী ১৫ মার্চের ব্যাপারে সিজারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনিও এসে দাঁড়ালেন অধ্যাপকের পাশে। জ্যোতিষীকে দেখে সিজার বললেন, আরে, ১৫ মার্চ তো এসে গেছে। আজই তো সেই দিন!
সিজারের প্রবল আত্মবিশ্বাস দেখে জ্যোতিষী বললেন, হ্যাঃ সিজার! আজই। ১৫ মার্চ। দিনটা সবে শুরু হয়েছে, শেষ হতে এখনও বাকি। জ্যোতিষীকে পাত্তা না দিয়ে সিজার এগিয়ে যাবেন এমন সময় অধ্যাপক আর্তেমিদোরাস তার লেখা চিঠিটা সিজারের হাতে দিয়ে বললেন, মহামান্য সিজার! দয়া করে আমার আবেদনটা পড়ে দেখুন। সিজারের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের অন্যতম মেটেলাস ট্রোবনিয়াসও তার আবেদনপত্রটি এগিয়ে দিলেন সিজারের দিকে। সেটি পড়ে দেখার জন্য ডেবিয়াস ব্রুটাস অনুরোধ জানালেন সিজারকে। এইসব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে গ্রিক অধ্যাপক বললেন, মাননীয় সিজার! আমার আবেদনের সাথে জড়িয়ে আছে আপনার স্বার্থ। অনুগ্রহ করে ওটা আগে পড়ুন।
সিজার বললেন, না, তা হয় না। আপনার আবেদনের সাথে যদি আমার ব্যক্তিগত বিষয় জড়িয়ে থাকে, তাহলে সেটা সবশেষে পড়া হবে।
ব্যস্ত হয়ে অধ্যাপক বললেন, এ নিয়ে আপনি আর দেরি করবেন না সিজার। দয়া করে এটি এখনই পড়ে ফেলুন।
লোকটার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, বললেন সিজার। তারপর অধ্যাপককে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, আমি আপনাকেই বলছি, যদি আপনার কোনও আবেদন থাকে, তাহলে সেটা রাস্তায় নয়, সেনেটে এসে আমায় দেবেন।
সবাইকে নিয়ে সেনেটে ঢুকে তার নির্দিষ্ট আসনে বসলেন সিজার। তার বিশ্বস্ত বন্ধু মার্ক অ্যান্টনি কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। কৌশলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন ক্যাসিয়াসের বন্ধু ট্ৰেবোনিয়াস।
এবার চক্রান্তকারীরা এগিয়ে গেল তাদের পরিকল্পিত পথে। প্রথমে সেনেটর মেটেলাস নতজানু হয়ে হাতজোড় করে বললেন, মাননীয় সিজার! অনুগ্রহ করে আপনি আমার নির্বাসিত ভাইকে দেশে ফেরার অনুমতি দিন।
তা হয় না মেটেলাস, বললেন সিজার, তোমার ভাই অপরাধী। বিচারে তার অপরাধের উপযুক্ত সাজা পেয়েছে সে। সে সাজা মকুব করার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। আর তা তুলে নেবার অধিকারও আমার নেই। আর যাই হোক, দেশের আইন-কানুন ছেলেখেলার বিষয়বস্তু নয়।
ব্রুটাস এগিয়ে এসে সিজারের হাত চুম্বন করে বললেন, আপনি যদি মেটেলাসের ভাইকে মুক্তি দেন, তাহলে খুবই ভালো হয়। সিজার স্বপ্নেও ভাবেননি ব্রুটাসের মতো একজন ন্যায়পরায়ণ লোক এরূপ অন্যায় অনুরোধ করতে পারে। ব্রুটাসের পরপর একই আবেদন জানালেন ক্যাসিয়াস। কিন্তু তাকে ওই একই জবাব দিলেন সিজার। তিনি জানালেন কাউকে অনুনয়। যেমন তার পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনি অন্যের অনুরোধ তিনি গ্রাহ্যের মধ্যেও আনবেন না। তাতে যদি তারা বলেন যে পাইলিয়াসকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া অন্যায় হয়েছে, তাহলেও সে নির্বাসন দণ্ড রদ করবেন না তিনি।
সিজারের কথা শুনে সমস্বরে বলে উঠল। সবাই, হে সিজার! আপনি মহান।
কিন্তু তাতে একটুও নরম হলেন না সিজার। এবার চক্রান্তকারীদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল ক্যাসকা। চিন্তা-ভাবনা না করে কোমর থেকে ধারালো ছোরা বের করে আমূল বসিয়ে দিল সিজারের কঁধে। অবাক হয়ে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সিজার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পরনের সাদা পোশাক। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সকালে যারা তার বাড়িতে গিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে এসেছে, এখন তাদেরই সবার হাতে ছুরি, চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে প্রচণ্ড ঘৃণা, আক্রোশ আর প্রতিশোধ–স্পাহা। এরপর ক্যাসিয়াস, মেটেলাস, সিন্না, ডেসিয়াস, ট্ৰেবোনিয়াস, লাইগোরিয়াস — সবাই পরপর এগিয়ে এসে ছুরি বসিয়ে দিল সিজারের বুকে।
টলতে টলতে সিজার এগিয়ে গেলেন বন্ধু ব্রুটাসের দিকে। আগে থেকে ব্রুটাসের হাতে ছিল ছোরা। কিন্তু সে মুহুর্তে ব্রুটাসের বিবেক কেন যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে চোখ বুজে ছোরা বসিয়ে দিলেন সিজারের বুকে।
আর্তনাদের সুরে সিজার বললেন, ব্রুটাস! শেষে তুমিও?? আর কোনো কথা বেরুল না। সিজারের মুখ থেকে। রক্তাক্ত দেহে তিনি লুটিয়ে পড়লেন। সেনেটের শক্ত মেঝেতে।
এবার সমবেতভাবে বলে উঠল চক্রান্তকারীরা, রক্ষা পেয়েছে রোমের স্বাধীনতা। মৃত্যু হয়েছে অত্যাচারী শাসকের। যাও! বাইরে গিয়ে তোমরা জোরালো গলায় এ কথা বল।
সেনেট থেকে বের হয়ে চক্রান্তকারীরা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এবার তাদের ব্যাখ্যা করার পালা কেন তারা বাধ্য হয়েছে রোমের জনপ্রিয় শাসক জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করতে। রোমের স্বাধীনতাকে বীচাবার জন্যই যে তারা একাজ করেছেন সে কথা বুঝিয়ে বলতে হবে সবাইকে। সিজারকে হত্যা করার আগেই তার বন্ধু মার্ক অ্যান্টনিকে সিজারের পাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্ৰেবোনিয়াস। অ্যান্টনি যখন জানতে পারলেন যে সিজারকে খুন করা হয়েছে। তিনি ভয় পেলেন এই ভেবে যে সিজারের বন্ধু হিসাবে হয়তো চক্রান্তকারীরা এবার তাকেও হত্যা করবে। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে সোজা চলে গেলেন নিজের বাড়িতে।
অ্যান্টনি বেশ বুদ্ধিমান লোক। তিনি ভেবে-চিন্তে লোক পাঠালেন ব্রুটাসের কাছে। তার লোক ব্রুটাসকে এটাই বোঝাল যে এখন থেকে ব্রুটাস ও তার সাথীদের নির্দেশমতেই চলবেন অ্যান্টনি।
সিজারের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন অ্যান্টনি। সে বেঁচে থাকলে হয়তো ঝামেলা বাধাতে পারে–এ কথাই ব্রুটাসকে বোঝাতে চাইলেন তার সঙ্গীরা। তাদের অভিমত সিজারের মতো অ্যান্টনিকেও মেরে ফেলা হোক।
তাদের কথায় আপত্তি জানিয়ে ব্রুটাস বললেন, না, তা সম্ভব নয়। সিজারের জীবিতকালে হয়তো অ্যান্টনি তার বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল। কিন্তু এখন সে তো একজন সাধারণ লোক। তাকে ভয় করার কী আছে! অহেতুক রক্তপাত ঘটালে খেপে যেতে পারে রোমের জনসাধারণ। এরপর অ্যান্টনি প্রেরিত লোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি অ্যান্টনিকে বলে দিও যে তিনি স্বচ্ছন্দে দেখা করতে পারেন ব্রুটাসের সাথে। ব্রুটাস ও তার সঙ্গীদের তরফ থেকে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই তার।
ব্রুটাস ও তার সঙ্গীদের মনোভাব অবগত হবার পর আর দেরি না করে অ্যান্টনি গিয়ে দেখা করলেন ব্রুটাসের সাথে। তাকে বন্ধুর মতো খাতির করে বসলেন ব্রুটাস। সিজার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি অ্যান্টনিকে বললেন কেন সিজারকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়েছিল সে কথা তিনি সময় মতো বুঝিয়ে দেবেন তাকে।
সব কথা শোনার পর ব্রুটাসকে অনুরোধ জানিয়ে অ্যান্টনি বললেন, সিজারের মৃতদেহটা আমার হাতে দিন। আমি সেটা সমাধিস্থ করতে চাই। কিন্তু তার আগে সিজারের কীর্তির বিষয়ে কিছু বলতে চাই জনসাধারণের কাছে। আমার মনে হয় তাতে সিজারের আত্মার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শন করা হবে।
এতক্ষণ ধরে ব্রুটাসের পাশে বসে মন দিয়ে উভয়ের কথা শুনছিলেন। ক্যাসিয়াস। এ্যান্টনির প্ৰস্তাব শুনে তিনি ব্রুটাসকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, অ্যান্টনি যদি বলে যে সিজারের সমাধি দেবার আগে জনতার সামনে সে কিছু বলবে, তুমি কিন্তু তাতে রাজি হয়ে না।
পালটা প্রশ্ন করলেন ব্রুটাস, কেন তাতে ভয় পাবার কি আছে? ক্যাসিয়াস যে অ্যান্টনিকে কেন ভয় পাচ্ছে তা বোধগম্য হল না তার।
অ্যান্টনি যাতে শুনতে না পায় এ ভাবে বললেন ক্যাসিয়াস, ব্রুটাস! তুমি এখনও চিনতে পারনি রোমের জনসাধারণকে। তারা এখনও ভালোবাসে সিজারকে। বলা যায় না, হয়তো অ্যান্টনির কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে।
একই স্বরে জানালেন ব্রুটাস, না ক্যাসিয়াস, সে সুযোগ আমি দেব না। অ্যান্টনিকে। আগে আমি জনসাধারণকে বোঝােব কেন হত্যা করা হয়েছে সিজারকে, তারপর আমার অনুমতি নিয়ে অ্যান্টনির যা বলার তা সে বলবে। তবে আপত্তিজনক বা উত্তেজনাকর কিছু বললে সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করব আমি।
ক্যাসিয়াস বললেন, বুঝতে পারছি না। কী হবে। আমার কিন্তু মোটেও ভালো ঠেকছে না। কাজটা বোধহয় ঠিক হল না।
আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে অ্যান্টনিকে বললেন ব্রুটাস, সমাধি দেবার জন্য এবার তুমি নিয়ে যেতে পার সিজারের মৃতদেহ। সিজারের গুণাবলি সম্পর্কে জনতাকে কিছু বলার থাকলে তাও বলতে পার তুমি। তবে আমার বক্তব্য শেষ হবার পরই তোমার যা বলার তা বলবে।
অ্যান্টনি বললেন, বেশ, তাই হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আমি।
বেশ, তাহলে তুমি তৈরি হও আমার পেছন পেছন সিজারের মৃতদেহ নিয়ে যাবার জন্য–বলে ক্যাসিয়াসকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন ব্রুটাস।
সিজারের মৃতদেহ নিয়ে অ্যান্টনি চলে এলেন রোম শহরের মাঝখানে একটা খোলামেলা প্রশস্ত জায়গায়–যেখানে কারও ভাষণ শুনতে বা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে সমবেত হতেন রোমের নাগরিকেরা। সিজারের মৃতদেহ সেখানে নিয়ে যাবার রোমের সাধারণ মানুষ, যারা ভালোবাসতেন অ্যান্টনিকে, তারা দলে দলে এসে সেখানে ভিড় জমাল। ভিড় জমছে দেখে জনতার সামনে এগিয়ে এসে তার ভাষণ শুরু করলেন ব্রুটাস :
হে রোমের অধিবাসীবৃন্দ! তোমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্ন জেগেছে আজ তারই জবাব দিতে এসেছি আমি। তোমরা সবাই জান আমি ছিলাম সিজারের অন্তরঙ্গ বন্ধু–এ বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। সিজারকে আমি যতটা ভালোবাসতাম, তোমরা কেউ ততটা বাসতে না। সিজার ছিলেন একজন খাঁটি রোমান, মহান বীর–তাই আমি তাকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দিনে দিনে তার উচ্চাশা বেড়ে উঠছিল। নিজে রাজা হবার জন্য সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শুরু করছিলেন তিনি। কিন্তু তোমরা জেনে রাখা সিজার আমার যতই প্রিয় হোন না কেন, আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমার জন্মভূমি—রোম। এই রোম থেকে বহুদিন আগে রাজতন্ত্রকে হঠিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি। গণতন্ত্রের। সেই গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন নাগরিক তোমরা। হে আমার বন্ধু রোমানরা! আজ সিজার বেঁচে থাকলে তিনি হতেন রাজা আর স্বাধীনতা হারিয়ে তোমরা হতে তার প্রজা। সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই আমরা বাধ্য হয়েছি সিজারকে হত্যা করতে। এবার তোমরাই বিচার কর, বল আমরা ঠিক কাজ করেছি কিনা?
সে সময় উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একদল লোক জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠল, আপনার যা খুশি তা বলতে পারেন। তবে আগেই জানিয়ে রাখছি ব্রুটাসের নিন্দ বা সমালোচনা সহ্য করব না। আমরা। আমরা মনে করি সিজারকে হত্যা করে ব্রুটাস ও তার সঙ্গীরা ঠিক কাজই করেছেন।
সেখানে উপস্থিত রোমের জনতা সমবেতভাবে বলে উঠল, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তোমরা ঠিক কাজই করেছ ব্রুটাস।
ব্রুটাস বললেন, তোমাদের অভিমত যদি এই হয় তবে তার সাথে আমি একমত। এবার সবাই মন দিয়ে শোন আমার কথা। আমার মতোই মার্ক অ্যান্টনিও ছিলেন সিজারের এক অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সিজারকে সমাধি দেবার আগে তিনি তার সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলতে চান। আমি চাই সিজারের প্রতি সম্মান জানাবার জন্য তোমরা সবাই মন দিয়ে তার কথা শুনবে।
ব্রুটাসের বক্তব্য শেষ হবার পর মঞ্চে এলেন অ্যান্টনি। সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, হে আমার রোমান বন্ধুরা! মাননীয় ব্রুটাস আমায় সুযোগ দিয়েছেন সিজার সম্পর্কে তোমাদের কাছে কিছু বলার। আশা করি তোমরা সবাই মন দিয়ে শুনবে আমার কথা।
সে সময় উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একদল লোক জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠল, আপনার যা খুশি তা বলতে পারেন। তবে আগেই জানিয়ে রাখছি ব্রুটাসের নিন্দ বা সমালোচনা সহ্য করব না। আমরা। আমরা মনে করি সিজারকে হত্যা করে ব্রুটাস ও তার সঙ্গীরা ঠিক কাজই করেছেন।
সে তো নিশ্চয়ই, সায় দিয়ে বললেন অ্যান্টনি, ক্রটাস একজন মহৎ ব্যক্তি, রোমের সবাই জানে সে কথা। কোনও অন্যায় কাজ করতে পারেন না তিনি। আজ আমি এখানে এসেছি সিজারকে সমাধি দিতে, তার প্রশৃংসা করতে নয়। কিছুক্ষণ আগে ব্রুটাস বলেছেন সিজার খুব উচ্চাভিলাষী ছিলেন। ব্রুটাসের অভিযোগ সত্যি হলে বলতেই হবে খুব অন্যায় করেছেন সিজার। আমরা জানি প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু উচ্চাশাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। সেই সাথে আমরা এও জানি উচ্চাশা জিনিসটাই খারাপ। তবে সিজারের উচ্চাশার কোনও প্রমাণ কিন্তু কেউ পায়নি। এই তো সেদিনের কথা তোমরা সবাইজান, আমি নিজে সিজারের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি নেননি। পরপর তিনবার আমার হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এবার তোমরাই বল, এর দ্বারা কী প্রমাণ হয় সিজার সত্যিই উচ্চাভিলাষী ছিলেন?
জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হল অ্যান্টনির কথায়। ব্রুটাসের কথা শুনে যেমন মোহগ্ৰস্ত হয়েছিল জনতা, অ্যান্টনির কথায় সে মোহের ঘোর কেটে গেল। তারা ভেবে দেখল, সত্যিই তো, যে সিজার বার বার রাজমুকুট প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনি কি উচ্চাভিলাষী হতে পারেন? তাহলে কিছুক্ষণ আগে ব্রুটাস তাদের কী বুঝিয়েছেন? স্বভাবতই এ প্রশ্ন জাগল তাদের। জনতার চোখমুখ আর হাবভাব দেখে অ্যান্টনি বুঝতে পারলেন এবার সফল হতে চলেছে তার উদ্দেশ্য। তিনি এমনভাবে সিজারের গুণাবলির বর্ণনা দিতে লাগলেন যা শুনে কিছুক্ষণ আগে হত্যাকারীদের প্রতি যে সামান্য শ্রদ্ধা-ভক্তি জন্মেছিল জনতার মনে, এবার তা কপূরের মতো উবে গেল। ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস, কাসকা ইত্যাদি যারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল সিজারকে, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল জনতার মনে।
আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে অ্যান্টনি জনতাকে পড়ে শোনালেন সিজারের উইল। সেই উইলে সিজার তার নিজস্ব বাগান ও অন্যান্য সম্পত্তির কথা ছিল। সেই বাগানে মানুষ আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারবে। তাছাড়া রোমের সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে তিনি তাদের প্রত্যেককে নগদ পচাত্তর লিরা করে নগদ অর্থ দান করে গেছেন। উইলটা জনতাকে পড়ে শোনাবার পর অ্যান্টনি বললেন, এমনই মহান মানুষ ছিলেন সিজার। এবার আপনারাই বিচার করে বলুন তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন কিনা।
এবার সীমাহীন ক্ৰোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জনতা। তারা চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ওরে বিশ্বাসঘাতক শয়তানের দল! তোদের কাউকে রেহাই দেব না। আমরা। পুড়িয়ে দেব ব্রুটাসের বাড়ি। সিজার হত্যার প্রতিশোধ নেব আমরা। হত্যাকারীদের বধ করে, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেবার সংকল্প নিয়ে দল বেঁধে এগুতে লাগল। জনতা ব্রিটাস আর ক্যাসিয়াস যখন জানতে পারলেন তাদের ধরতে আসছে, তখন তারা যে যার বাড়ি-ঘর ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে বহুদূরে পালিয়ে গেলেন। তাদের যে সব সহযোগী সিজার হত্যার সাথে জড়িত ছিল, জনতা তাদের খুঁজে বের করে বিনাবিচারে মেরে ফেলল, পুড়িয়ে ছাই করে দিল তাদের ঘর-বাড়ি। এবার ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস বুঝতে পারলেন দেশে ফিরে গেলে জনতার হাতে মৃত্যু হবে তাদের। আর যদিও বা জনতার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যায়, তাহলেও মার্ক অ্যান্টনির হাত থেকে রক্ষা নেই তাদের। অ্যান্টনির হাত থেকে বাঁচতে হলে লড়াইয়ের প্রয়োজন। তাই তারা প্রচুর টাকাকড়ি খরচ করে লড়াইয়ের জন্য অস্ত্ৰ-শস্ত্র এবং সৈন্যর জোগাড় করতে লাগলেন। এরইমধ্যে রোমে এসে পৌঁছালেন সিজারের ভাইপো অক্টেভিয়াস। তিনি বয়সে অ্যান্টনির চেয়ে ছোটো হলেও ভালো যোদ্ধা এবং যথেষ্ট রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন লোক। তাছাড়া রোমের এক শাসক মার্কাস এমিল লেপিডাসকেও বন্ধু হিসেবে পেলেন তিনি। তারা উভয়ে যোগ দিলেন অ্যান্টনির সাথে। অ্যান্টনি অক্টেভিয়াসকে জানালেন যে যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছেন ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস। এবার তারাও তৈরি হতে লাগলেন শত্রুর সাথে মোকাবিলার জন্য।
সিজারকে হত্যার প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে তার সেনাবাহিনীর কয়েকজন অভিজ্ঞ সেনানীও যোগ দিলেন মার্ক অ্যান্টনির সাথে। সামান্য কয়েকদিন বাদেই যুদ্ধ বেধে গেল দু-পক্ষের মধ্যে। যুদ্ধ চলাকালীন ব্রুটাসের পত্নী সোফিয়া আত্মহত্যা করলেন বিষ খেয়ে। পত্নীর শোকে মুহ্যমান হয়ে গেলেন ব্রুটাস। ইতিমধ্যে বিবেকের দংশনে অস্থির হয়ে গেছেন তিনি। ক্যাসিয়াসের বুদ্ধিতে সিজার হত্যার চক্রান্তে যোগ দিয়ে তিনি যে মোটেই ভালো কাজ করেননি, সে কথা এতদিনে উপলব্ধি হল তার। যুদ্ধ চলাকালীন মাঝে মাঝেই তার সাথে ঝগড়া ও কথা-কাটাকাটি হতে লাগল ক্যাসিয়াসের। কিন্তু অন্যায়ের সাহায্য নিতে রাজি নন। ব্রুটাস। অথচ অর্থ এবং সৈন্য সংগ্রহের জন্য যে কোনও নীচ কাজ করতে সবসময় তৈরি ক্যাসিয়াস। একদিন তাদের বিবাদ চরমে উঠে গেল। বুদ্ধিমান ক্যাসিয়াস নিজেকে সামলে নিলেন, নইলে হয়ত সেদিন উভয়ের মাঝে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেত। সেদিন রাতে তাঁবুর ভেতর ব্রুটাসের সামনে আবির্ভূত হলেন জুলিয়াস সিজারের প্ৰেতাত্মা। যাবার আগে সেই প্ৰেতাত্মা বলে গেলেন, আবার দেখা হবে ফিলিগির যুদ্ধক্ষেত্রে।
সিজারের প্ৰেতাত্মা দেখা দিলেও ফিলিগির যুদ্ধে শত্রুসৈনের হাতে পরাস্ত হলেন ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস। ধরা পড়লে অ্যান্টনি তাদের প্রাণদণ্ড দেবেন। তাই ধরা পড়ার আগেই প্রাণদণ্ডের বিকল্প হিসাবে সম্মানজনক মৃত্যুর আশ্রয় নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলেন তারা। যে ছুরি একদিন সিজারের বুকে বসিয়েছিলেন ক্যাসিয়াস, সেই ছুরি বিশ্বস্ত ভূত্য জিন্ডারাসের হাতে দিয়ে তাকে আদেশ দিলেন সে যেন ছুরিটা তার বুকে বসিয়ে দেয়। চোখের জল ফেলতে ফেলতে প্রভুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল জিন্ডারাস। এবার ব্রুটাসও তার তলোয়ার ভৃত্য স্ট্র্যাটোর হাতে গুজে দিয়ে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সে তলোয়ারের উপর। গোটা তলোয়ারটাই ঢুকে গোল তার হৃৎপিণ্ডে।
সিজারের আত্মার শান্তি হোক — শুধু এইটুকু বলে রক্তাক্ত দেহে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ব্রুটাস।
ইশারায় ব্রুটাসের মৃতদেহকে দেখিয়ে যুবক অক্টেভিয়াসকে বললেন অ্যান্টনি, সবদিক দিয়েই উনি ছিলেন একজন খাঁটি রোমান। সিজার হত্যার চক্রান্তকারীদের একজন হলেও তিনি একজন মহান লোক —প্ৰয়াত সিজারের বিশিষ্ট বন্ধুদের অন্যতম। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে অন্যান্য সব চক্রান্তকারীরা হত্যা করেছে সিজারকে। একমাত্র উনিই দেশ ও দশের মঙ্গলের কথা ভেবে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সাথে।