পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্য দিয়ে তিনিই হলেন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি কোনও অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন। আসন্ন নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এমন রায় ঘোষণা হওয়ায় এবার জনমনে প্রশ্ন উঠছে—দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন ট্রাম্প? চলমান নির্বাচনি প্রচারের জন্যে আদালতের ঐতিহাসিক এই রায়ের অর্থ তাহলে কী হতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে বৃহস্পতিবার (৩১ মে) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ।
সাড়ে নয় ঘণ্টা ধরে আলোচনা করার পর বৃহস্পতিবার সর্বসম্মতিক্রমে নিউ ইয়র্কের একটি জুরি নির্বাচনি জালিয়াতির জন্য ব্যবসায়িক রেকর্ড জালিয়াতির মামলায় ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এই বিষয়ক ৩৪টি মামলাতেই ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
২০০৬ সালে পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে মুখ না খুলতে স্টর্মিকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার ঘুষ দেওয়া হয়। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে স্টর্মির হাতে এ অর্থ তুলে দিয়েছিলেন তার আইনজীবী মাইকেল কোহেন। তবে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প কি এখনও প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে পারবেন?
হ্যাঁ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে এখনও লড়তে পারবেন ট্রাম্প। মার্কিন সংবিধানে প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য হতে যে তিনটি শর্ত রয়েছে, এর মধ্যে দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর বিষয়ে কিছু বলা নেই। শর্তগুলো হলো:
প্রথমত, প্রার্থীদের অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রার্থীর বয়স ৩৫ বছরের বেশি হতে হবে এবং তৃতীয়ত, প্রার্থীকে কমপক্ষে ১৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে।
এলএ টাইমসকে প্রগতিশীল কনস্টিটিউশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি সেন্টারের সভাপতি এলিজাবেথ ওয়াইড্রা বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় কারাগারে থাকলেও প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এবং নির্বাচিত হতে কোনও কিছুই তাকে বাধা দিতে পারবে না।’
ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে এক বছর বা তারও বেশি সময় সাজাপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কারাগারে থাকা অবস্থায় ট্রাম্প নির্বাচন করলে কী হতো?
এই প্রশ্নটি বেশ জটিল। কেননা, প্রথমত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর ট্রাম্পকে কারাগারে পাঠানো হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
দোষী সাব্যস্ত হওয়া নিউ ইয়র্ক রাজ্যের ই-শ্রেণির অপরাধ, যেটি অঙ্গরাজ্যটিতে অপরাধের সর্বনিম্ন স্তর। এই শ্রেণির অপরাধীদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত সাজা হয়ে থাকে।
ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সাজা প্রদানের সময় বিচারককে তার বয়স বিবেচনায় রাখতে হবে। কেননা, তার বয়স এখন ৭৭ বছর। এছাড়া, আগের অপরাধগুলোতেও তিনি দোষী সাব্যস্ত হননি এবং এই মামলাটি একটি অহিংস ধরনের অপরাধ।
এমনকি বিচারক হুয়ান মার্চান যদি তাকে হেফাজতে রাখার সাজাও দিতে চান তবে দোষী সাব্যস্ত হওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। আর এমনটি হলে সেই আপিলের শুনানি পর্যন্ত ট্রাম্প জামিনে থাকবেন, এমনটা আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া, এই প্রক্রিয়াটি আপিল আদালতে যেতে পারে এবং তা কয়েক মাস দীর্ঘ সময় নিতে পারে। এমনকি সেটি নভেম্বরের নির্বাচনকেও পার করতে পারে।
তবে সাজার সময়কালের মধ্যেই যদি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। এমনকি সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না।
চলতি বছরের শুরুতে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ এরউইন চেমেরিনস্কি বলেছিলেন, ‘এটি শুধু্ই একটি অনুমান। যা কিছু ঘটেছে আমরা সেসব থেকে অনেক দূরে সরে গেছি।’
ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে কি ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাত্ত্বিকভাবে, ট্রাম্প যদি কারাবাসেও থাকেন তবু তাকে ক্ষমতা গ্রহণে বাধা দেওয়ার কিছু নেই।
একটি বিধান রয়েছে, যেখানে মার্কিন সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী অনুসারে, প্রেসিডেন্ট ‘তার অফিসের ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালনে অক্ষম’ হলে ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে তা হস্তান্তর করার একটি প্রক্রিয়া রয়েছে।
তবে এমন কিছু হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প সম্ভবত তার মুক্তির জন্য মামলা করতে পারেন অথবা তাকে শাসন করার অনুমতি দেওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতে পারেন।
দোষী সাব্যস্তের রায় নির্বাচনে কেমন প্রভাব ফেলবে?
বৃহস্পতিবারের রায়ের আগে করা জনমত জরিপগুলোতে দেখা গেছে, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘোষণাটি ট্রাম্পের জন্য একটি মারাত্মক রাজনৈতিক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এপ্রিলে করা এক জরিপে প্রতি চার জনের মধ্যে একজন রিপাবলিকান জানিয়েছেন, অপরাধমূলক বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না তারা।
একই জরিপে স্বতন্ত্রদের ৬০ শতাংশ জানিয়েছিলেন, দোষী সাব্যস্ত হলে তারাও ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না।
সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
রিপাবলিকান পোলস্টার হুইট আইরেস বলেছিলেন, রিপাবলিকানদের এক-চতুর্থাংশই ট্রাম্পকে এড়িয়ে যাবে বলে সন্দেহ করেছিলেন তিনি। আইরেস বলেছিলেন, এমনকি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণে অল্প সংখ্যক সদস্যও যদি তার দিক থেকে মুখ ফেরায়, তবে আসন্ন নির্বাচনে তা জো বাইডেনের লড়াইকে আরেকটু সহজ করে দেবে।
দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায় ট্রাম্পের ওপর মানসিক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছিলেন রিপাবলিকান কনসালট্যান্ট ট্রিসিয়া ম্যাকলাফলিন। কেননা, ট্রাম্প হারতে অপছন্দ করেন।
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প অবশ্যই আপিল করবেন।
দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায় প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতায় উল্লেখযোগ্য কোনও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষক বিল গ্যালস্টন। তিনি ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্টের নির্বাচনি প্রচারে কাজ করেছেন। গ্যালস্টন বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত, এটি যৌনতা সম্পর্কে মিথ্যা বলার সমান। আমি মনে করি, বেশিরভাগ আমেরিকানই মনে করেন, প্রত্যেকেই যৌনতা নিয়ে মিথ্যা বলেন।’
এর আগেও কি সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরা প্রেসিডেন্ট পদে লড়েছেন?
ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া অন্তত দুই প্রার্থী এর আগে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে সফলতার মুখ দেখেননি তারা।
১৯২০ সালে কারাগার থেকে প্রসিডেন্ট পদে লড়েছিলে ইউজিন ডেবস। তখন তিনি প্রায় ১০ লাখ ভোট পান।
এরপর, ১৯৯২ সালে কারাগার থেকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়েছিলেন লিন্ডন লারুচে। তখন তিনি মেইল জালিয়াতির জন্য ১৫ বছরের সাজা ভোগ করছিলেন। নির্বাচনে প্রায় ২৬ হাজার ভোট পেয়েছিলেন তিনি।
ট্রাম্পের সামনে আরও পরীক্ষা
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে করা চারটি ফৌজদারি মামলার মধ্যে প্রথমটির বিচারকার্য ছিল এটি। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন।
তবে নভেম্বরের নির্বাচনের আগে বাকি তিনটি মামলার বিচার হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।