মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ :
বল বীর
চির উন্নত মম শির।
শির নেহারি আমারি
নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
কিংবা
দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
-এই যে অমিত তেজ, সাহস এবং আত্মপ্রত্যয়ের যে স্পর্ধিত, বাংলা সাহিত্যে তা ছিলো অভিনব। আর এই তেজ, এই সাহস যিনি আপন চেতনায়, লেখনীতে ধারণ করেছিলেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম।
বস্তুত ব্রিটিশ বেনিয়া-শাসিত ভারতবর্ষের মানুষের সম্মুখে নজরুল এসেছিলেন শেকল ভাঙার গান গেয়ে। পরাধীন ভারতবাসী সামনে তিনি কী অসীম আত্মপ্রত্যয়ে উচ্চারণ করেছেন,
কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল পূজোর পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।
তিনি স্বাধীনতাহারা ভাগ্যাহত মানুষকে নতুন প্রণোদনায় জাগ্রত, উদ্বোধিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন,
তোরা সব জয়ধ্বনি কর।
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখীর ঝড়-
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর
প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন
আসছে নতুন, জীবন হারা
অসুন্দরে করতে ছেদন।
নজরুলের কবিতা, নজরুলের গান এভাবে অধঃপতিত, হতাশাগ্রস্ত মানুষকে আশা ও আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছে; ভীতি-বিহ্বল মানুষের চেতনায় বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে।
নজরুল বঞ্চিত-নিপীড়িত, অসহায়, সর্বহারা মানুষের একান্ত বন্ধু ছিলেন। তাদের জন্য দরদ এবং ক্ষোভ মিশ্রিত প্রতিবাদ ফুটে ওঠেছে তার বহু কবিতায়-
সেদিন দেখিনু রেলে
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে
ঠেলে দিলে নিচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল
এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া
মার খাবে দুর্বল।
নজরুল মানবতার কবি, সাম্যের কবি। মানুষের প্রতি এই ভালোবাসা এই মমত্ববোধকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন যুগ থেকে যুগান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে-
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশকাল পাত্রের ভেদ
অভেদ ধর্ম-জাতী
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে
তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার জীবনশত্রু ছিলেন কবি নজরুল। তিনি ইসলামের সুমহান উদারতা, শান্তি ও কল্যাণের স্পিরিট পুরোপুরি আত্মস্ত করতে পেরেছিলেন বলেই ধর্মীয় সংকীর্ণতা, গোঁড়ামী, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি অমানবিক অনুষঙ্গগুলো তাকে কখনই স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের একজন সদস্য হয়েও প্রথাগত সংস্কারকে তিনি অতিক্রম করেছেন। গেয়েছেন মানবতার জয় গান। এ কারণেই মুসলিম-হিন্দু উভয় শ্রেণিরই গালমন্দ ও সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে।
স্বীয় সম্প্রদায়ের মানুষ তাকে কাফের বলতেও কসুর করেনি। অথচ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ইসলামি কবিতা ও গানগুলো কবি নজরুলেরই রচনা। তার মোহাররম, খেয়াপারের তরণী, খালেদ, উমর ফারুক, এসব কবিতার সঙ্গে তুলনীয় কটি ইসলামি চেতনা-ভাস্বর কবিতা আছে বাংলা সাহিত্যে? উমর ফারুক কবিতায় তার সে অনন্য উচ্চারণ-
উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ বাহু,
আহ্বান নয় রূপ ধরে এস গ্রাসে অন্ধতা রাহু।
ইসলাম সেতো পরশ মানিক, কে পেয়েছে তারে খুঁজি?
পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি।
হে নজরুল! তুমি বেঁচে থাকো আমাদের হৃদয় মাজারে যুগ যুগ ধরে।
লেখক : তরুণ লেখক ও কলামিস্ট
মাসিক পাথেয়, মে ২০১৮