- মুহাম্মাদ আইয়ুব
আশ্চর্য! বুক কাঁপছে যে আমার। ধড়ক ধড়ক শব্দে তোলপাড় গোটা দেহ। কেন এ কাঁপুনি? বিরহ, দুঃখ, বেদনা, শোক অপ্রাপ্তি? না, এ ধাড়কান আনন্দের সুখের, প্রাপ্তির। আমিও যে সেই কাঙ্খিত সাদা মিছিলে নেমে পড়েছি মহান আল্লাহর নামে। নিল সাইনবোর্ডে সাদা অক্ষরে স্পষ্ট লেখা ‘শারেয়ে ইব্রাহিম খলিল’ মানে ইব্রাহিম খলিল রোড।মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আ. এর নামে নামকরণ। শাম থেকে উনি এ পথ দিয়েই মক্কায় গমনাগমন করতেন কি না কে জানে? নামকরণে যদি মিল থাকে তাহলে আমি ভাগ্যবান। এ পথেই তো আমার নবীজী সা. হেঁটেছেন, হেঁটেছেন তাঁর তরে জীবন উৎসর্গকারী মহান আদর্শিক জামাত হযরত সাহাবায়ে কেরাম রিযওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম আজমাঈন। তারপর তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ওলী গাউস কুতুবগণ।
আর আজ এতো শত বছর পরে আমি অধম এই গোনাহগার হাঁটছি সেই পথ ধরে। এইখানে আমাদের সবার লক্ষ্য উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন, চোখভরে আল্লাহর ঘর কা’বা শরিফ দেখা। আল্লাহ গো! শামিল করে নাও আমাকে পূর্বসূরি আকাবিরের সেই নূরানী মিছিলে। অন্তত তাঁদের পায়ের ধূলোবালি হিসেবে। আমি তো সেই আশা বুকে ধারণ করে আছি সেই আজন্ম থেকে। আর তুমি যখন এই অধমকে পবিত্র জমিনে ডেকে আনলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু দিবেই!
ঘড়ির কাটা দুপুর বারোটা ছুঁইছুঁই। যেহেতু মুহরিম অবস্থায় ছিলাম তাই আগে ওমরার কার্যাদি শেষ করতে হবে। দূর থেকে মসজিদুল হারামের সুউচ্চ মিনারাগুলো দেখতে পাচ্ছি। দুপুরের তেতিয়ে ওঠা মরু সূর্যের তাপ গায়ে লাগছে বেশ। অবশ্য সেদিকে খেয়াল নাই। মনোযোগ নিবদ্ধ অন্যখানে।আমাদের মু’আল্লিম ও আমির মুফতি আজমাল হুসাইন সাহেব দক্ষ অভিজ্ঞ মুত্তাকী আলেম। কাফেলার চৌদ্দজন একসাথেই ছিলাম। কিন্তু হারাম শরীফের সীমানার কাছাকাছি আমরা দুই যুবক কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
জাবালে ওমর জুমাইরা ও হিলটন হোটেলের মাঝামাঝি হেরেম শরিফের সীমানা যেখান থেকে শুরু প্রথমেই যে এস্কেলেটর সেটা বেয়ে উপরে উঠে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু কোন দেখা পেলাম না কাফেলার। এখানে যে হারানোর মাঝেই প্রকৃত আনন্দ কিন্তু তবুও মনটা খারাপ হয়ে গেল একা-একা ওমরাহ সম্পন্ন করব। অভিজ্ঞ আলেম সাথে থাকলে যা হয় তা এক হাজার কিতাব পড়েও হয় না। বিষয়টি এযাত্রায় হাড়েহাড়ে টের পেলাম।
হেরেমের আঙিনায় পা রেখেছি আলহামদুলিল্লাহ। বাইতুল্লাহর সুঘ্রাণ নাকে ঢুকছে আর উতলা হয়ে যাচ্ছি জান্নাতি নেশায়। জুতা খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলছি। উচিত তো ছিল খালি পায়ে সমস্ত মক্কা শরীফ হাঁটব কিন্তু সে ঈমান কোথায় আমার?
গেইট নম্বর ৯৪। নামকরণ করা হয়েছে প্রয়াত বাদশাহ ফাহাদের নামে। মসজিদে ঢোকার সুন্নত সমূহ আদায় করে দুনিয়ার জান্নাতে ঢুকে পড়লাম অবনত মস্তকে শুকরিয়ার তাসবীহ মুখেমুখে। আরবের প্রসিদ্ধ উদের সুঘ্রাণে সমগ্র হেরেম শরিফ সুগন্ধিময়। নির্মাণের প্রথম দিন থেকেই অনবদ্য অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল আল্লাহর ঘর। মুমিনদের আকৃষ্ট করার সর্বোচ্চ ক্ষমতা এ মসজিদে বিদ্যমান।
তাই তো ভাবি মুমিনরা এখানে আসতে কেন উন্মুখ ও উতলা থাকে সারা জীবন। একবার আসলে তৃষ্ণা বেড়ে যায় বহুগুণ আবার যাব আবার যাব জপমালা থাকে আমৃত্যু। আল্লাহু আকবার। দূর থেকে বাইতুল্লাহকে দেখা অতৃপ্তির। একদম কাছে আরো কাছে যেয়েই তবে জুড়াব তৃষিত চোখ, পরাণ ভরে দেখব আল্লাহর ঘর। দুরুদুরু বুকে অতি সন্তর্পণে এগোচ্ছি তবুও যেন দ্রুত চলছি। ধৈর্য্যের বাঁধ আজ আর যে মানে না। চলে যে এসেছি একদম কাছে অতি নিকটে আরো সন্নিকটে । তাহলে মানবে কোন বাঁধা।
আইয়ুব! ঐ যে আল্লাহর ঘর,পবিত্র কা’বা শরীফ। সাতশত ক্রোশ দূর থেকে দৈনিক পাঁচবার যে ঘরকে সামনে রেখে নামাজ পড়েছিস এই তো সেই কা’বা। পিতা পুত্রের পবিত্র হাতে নির্মিত পৃথিবীর প্রথম ঘর এই যে দেখ। মনভরে দেখ। সুবহানাল্লাহ! আমার আল্লাহর ঘর। জগতের মালিক, আসমান জমিনের সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যার তাঁর বাড়ি এসেছি মেহমান হয়ে সুবহানাল্লাহ।
খোশ রাহো, জিতে রাহ, জনম জনম আইয়ুব। প্রেম ও কল্পনার জগতে তখন উত্তাল ঢেউ। বুকের ধুকপুকানি সমান তালে বাড়ছে। অজানা জগতে হারিয়ে যাচ্ছি। আসমান থেকে মহান আল্লাহ পাক দেখছেন সূদূর বাংলাদেশ থেকে এক বান্দা এসেছে আমার ঘর দেখতে। মনের যত কথা সব জেনেছেন তিনি আর খানিকবাদে শুনবেন। আর কিছুক্ষণ পর তাঁর ঘর দেখে যুগযুগ ধরে সঞ্চয় করা একগাদা চাওয়া-পাওয়া পেশ করবো আর তিনি বলবেন কবুল ! থামলি কেন? এখানে তোর গুনাহ ফকিরি অবস্থা বিষয় না অভাগা! বিষয় হচ্ছে তুই রহমানুর রহিমের বান্দা, তাঁর অনুগ্রহে পবিত্র ভূমিতে পা দিয়েছিস সুতরাং যা চাওয়ার চেয়ে ফেল। কবুল হবেই হবে।
চাইবি মন ভরে, পবিত্র ঘর কা’বা শরীফ দেখে, চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে, আশ্বান্বিত হৃদয়ে। শয়তান যেন আজ কুমন্ত্রণার জালে তোকে বন্দীর কোন সুযোগ না পায়, আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝে কোন প্রতিবন্ধকতা যেন ঢালতে না পারে অভিশপ্ত ইবলিস মরদূদ।
হ্যাঁ, চোখ তুলে তাকালাম পবিত্র কা’বা পানে। আল্লাহর ঘর কি অনিন্দ্য সুন্দর! তাকিয়ে ছিলাম কতক্ষণ জানি না, হারিয়ে গেলাম কোথায় তাও জানি না। কালো গিলাফে আবৃত একটা ঘর কিন্তু আকর্ষণ? অবর্ণনীয়, অকল্পনীয়। কী চাইব? কী বলব? কোন দোয়াটা করব সব এলোমেলো হয়ে গেল। কা’বার আসমানী সৌন্দর্যে বেমালুম ভুলে গেলাম আকাঙ্ক্ষার কথা। অনেকক্ষণ পর আব্দারের ফুলঝুরি ছুটল মুখ দিয়ে। অনেক কিছু চেয়ে ফেললাম সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠ দয়ালু মেজবানের কাছে। নিজের জন্য, মা-বাবা, আসাতেযায়ে কেরাম,ছেলে -মেয়ে,ভাই -বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু -বান্ধব, প্রতিবেশী হিতাকাঙ্ক্ষী, শুভাকাঙ্ক্ষী
তারপর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ, মুসলিম বিশ্ব, ও সর্বাধিক নিপীড়িত নির্যাতিত মজলুম ফিলিস্তিনী ভাই বোনদের জন্য। আহ ফিলিস্তিন! আল্লাহ তুমি মুক্তি দাও। প্রাণের জামিয়া আবু বকর, মনোয়ারা জালালউদ্দিন ফাউন্ডেশন স্পেশালি কামাল ভাই ও তার মা বাবা পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জে কে পলিমার ইন্ডাস্ট্রি। কিছুই বাদ দিলাম না। কেন দিব, চাইছি তো আল্লাহর কাছে যিনি চাওয়া পসন্দ করেন না চাইলে রাগ করেন।
সিঁড়ি বেয়ে এবার মাতাফে নেমে এলাম। কাছে আরো কাছে এলাম আমার প্রভুর ঘরের প্রতিবেশী হয়ে মেহমান হয়ে অনুগত বান্দা হয়ে। ঐ যে মাকামে ইবরাহীম আল্লাহু আকবার। একটা জায়গায় প্রচন্ড ভীড়। হ্যাঁ হাজরে আসওয়াদ ই হবে। আমরা ঘুরে হাজরে আসওয়াদের সোজাসুজি এসে ইসতিলাম করে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে। তাওয়াফ শুরু করলাম।
ক্রমশ…
লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসা পরিচালক