নূর নবীজীর দেশে—পর্ব ৩

নূর নবীজীর দেশে—পর্ব ৩

  • মুহাম্মাদ আইয়ুব

পাহাড়ের উপর সারি সারি বিল্ডিংগুলো দিনের প্রথম প্রহরের আলোয় স্নান সেরে নিচ্ছে। নজরকাড়া অপরূপ দৃশ্য। চোখ সরানো দায়। তবে মন ভেঙেছে চিন্তায়। শিশুকালে আরব চিনেছি ধূধূ মরভূমী আর উট বকরীর গল্প শুনে কিন্তু আরবে এসে দেখি রাস্তা কাঁপছে মার্সিডিজ, রোলস রয়েস, ভক্সওয়াগনের মতো বিলাশী গাড়ির দোর্দণ্ড প্রতাপে।

জীবনযাত্রা আধুনিক হয়েছে ঠিক কিন্তু আরবি রক্তের ওমরী যে ভয় ছিল কায়সার কিসরার মনে সৌদি আজকালকার আমীর উমারাদের প্রতি তার ছিটেফোঁটা গন্ধ আজ বাকি আছে আমেরিকা রাশিয়ার মনে?

বইয়ের পাতায় পড়া সেই তাবুময় মরুচারী জীবনের পরিবর্তে আলীশান ইমারাতে গড়া আরবের আজকের জীবন ইতিহাস উলোটপালোট করে দিয়েছে আমার চিন্তার জগত। এখন যা দেখছি তা কি গর্বের নাকি ভোগের বুঝতে পারছি না। জীবনযাত্রা আধুনিক হয়েছে ঠিক কিন্তু আরবি রক্তের ওমরী যে ভয় ছিল কায়সার কিসরার মনে সৌদি আজকালকার আমীর উমারাদের প্রতি তার ছিটেফোঁটা গন্ধ আজ বাকি আছে আমেরিকা রাশিয়ার মনে? পার্থক্যটা কি তাহলে এই ভোগবিলাশময় আলীশান জীবনের।

মিয়ানমারে মুসলমানরা মার খেল তখন এরা ছিলো চুপ। গাযায় সারি সারি লাশের মিছিল তবুও তারা নীরব। আচ্ছা, আজ যদি এই পবিত্র ভূমির সবচেয়ে নরম মানুষ হযরত সিদ্দিকে আকবর রা. থাকতেন তাহলে কি সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা আসত না? ‘আয়ানক্বুসদ দ্বীন ও আনা হাইয়্যুন’। ফিলিস্তিনের রক্ত দেখে আমরা কাপুরুষরা দমে গেলেও সাহাবীওয়ালা রক্ত কি আর দমবার পাত্র?

আরবদের নাম শুনলে এখনকার যুগের আবু জেহেলরা ভয় পায় না। পালিয়ে অন্দরমহলে আশ্রয় নেয় না। উল্টো আজকের আরবরা আবু জেহেলদের ভয় পায়! আচ্ছা ওমরায় এসে আরবদের সমালোচনা করা কি ঠিক হচ্ছে? তা বটে। সিংহ রাজার উপর অভিযোগ তো থাকবে বনের অন্য সব প্রজাদের। কেন তুমি ঘুমিয়ে গেলে আর জগতটা দখল করে নিল বানররা। ঘুম ছেড়ে উঠ, গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াও! আল্লাহর দেয়া এই পৃথিবীটা বুঝে নাও। ন্যায় ইনসাফ ও সাম্যে ভরে দাও অরাজকতার দুনিয়া।

আমাদের মুআল্লিম মুফতি আজমাল হুসাইন সাহেব যত্নসহকারে আমাদের শিখাচ্ছেন হজ্বের মানাসিকসমূহ। কারণ এই সফরে প্রায় আমরা সবাই নতুন। আল্লাহর ঘরের সম্মান রক্ষা। ওমরাহর সময় করণীয়। ওমরাহ সম্পন্ন করার পদ্ধতি। কোথায় কোন দোয়া পড়তে হবে ইত্যাদি। আমার কান এখানে থাকলেও চোখজোড়া ছিল আরবের বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে নিবদ্ধ। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ নামিদামি ফাস্টফুডের দোকান।

আচ্ছা, ঐ দূরে ওটা কী? স্টেডিয়াম না? হ্যাঁ তাই তো। ঐ যে পাশেই আরেকটা। মরুরবুকে ঘনঘন স্টেডিয়াম দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠে আবার স্বাভাবিক হলাম। হ্যাঁ, দুই হাজার ত্রিশ সালের মধ্যেই প্রিন্স মহোদয় ইউরোপ চলে যাবেন। তারই পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি চোখে। আরবরা আসলে পশ্চিমা কালচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বেশ ক’বছর হল। পোশাকআশাক, খাদ্য, লাইফস্টাইল খেলাধুলা সবখানে।

যাদের রক্ত ঘাম ঝরেছে দ্বীন প্রচারে বিশ্বময় আজ তাদের অধস্তনরা পশ্চিমা সংস্কৃতির গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।

আহ! আজকের আরবরা যদি জানত তাদের প্রকৃত ঐতিহ্য ঐ চটের কাপড়, খুরমা খেজুরে আর জরাজীর্ণ ঘরে তাহলে কি আর বিলীন হত তাদের গর্বিত ঐতিহ্য। আকাশছোঁয়া বীরত্ব ঢাকা পড়ত কি সুরম্য দালান কোঠার আস্তরণে? যাদের রক্ত ঘাম ঝরেছে দ্বীন প্রচারে বিশ্বময় আজ তাদের অধস্তনরা পশ্চিমা সংস্কৃতির গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। ঘাম ঝরছে ফুটবল মাঠে। আল্লাহ তুমি নবী ও সহাবীদের উত্তরসূরী আরবদের জাগিয়ে দাও। প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ দাও।

এসব ভাবতে ভাবতে আমাদের বাসটি মক্কার সীমানায় ঢুকে পড়েছে। দূর থেকে ক্লক টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। তার মানে আমরা কা’বার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। কেমন যেন মনে হচ্ছে জান্নাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দয়াময় আল্লাহর প্রতি অনায়েসে এমনটা আশা করা যায়। কারণ তাঁর দয়ার কোন তুলনা নেই। পুন্যভূমি মক্কায় এসে গেছি । আমি আসিনি। আমার আল্লাহ আমাকে নিয়ে এসেছেন আলহামদুলিল্লাহ।

এই তো সোনার মক্কা শরীফ গত ২৫ বছর ধরে যার নাম শুনে এসেছি। মন দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে পড়েছি, স্বপ্ন দেখেছি ধূলিমাখার। হযরত আদম আ. ,হযরত নূহ আ., হযরত ইবরাহিম আ., হযরত ইসমাঈল আ. ও প্রানের রাসূল হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও নাম না জানা কত নবীর স্মৃতিধন্য এই তো সেই মক্কা শহর। জীবনের সব প্রাপ্তি ও ভালোলাগার মুহূর্ত তো এই যে। মক্কা শরীফে না আসলে কোন নেয়ামত যে পূর্ণ হবার নয়।

আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু কুল্লুহু আল্লাহুম্মা লাকাশ শুকরু কুল্লুহু।

শ্রদ্ধেয় কামাল ভাই! আল্লাহ পাক আপনাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সব নেয়ামতে ঢেকে দিন।

ঐ যে কবুতর চত্ত্বর দেখা যাচ্ছে প্রচুর কবুতরের আনাগোনা। সাদা কাপড়ের জান্নাতি বহরে খানিকবাদে আমরা ও মিলিত হব। আপাতত হোটেলে যাচ্ছি, প্রিয় কা’বা! আমি আসছি ইনশাআল্লাহ।

ক্রমশ…

লেখক, শিক্ষক ও মাদরাসা পরিচালক

Related Articles