পুত্রের বয়ানে পিতা ফিদায়ে মিল্লাত রহ.।। পর্ব-২

পুত্রের বয়ানে পিতা ফিদায়ে মিল্লাত রহ.।। পর্ব-২

গত ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত জামি’আতুল আস’আদ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘ হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. জীবন ও কর্ম শীর্ষক সেমিনার। এতে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এর জীবনের নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র সাইয়্যেদ মওদুদ মাদানী (দামাত বারাকাতুহুম)। পুত্রের বয়ানে পিতার সেই স্মৃতিচারণের চুম্বকাংশ পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

গত পর্বের পর  

আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষায় অনড় স্বত্তা হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ.

হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানী (রহ.) এর ইন্তেকালের পর হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) যখন কাজের ময়দানে নামলেন, তখন তাঁর উপর বিশাল দায়িত্ব এসে পড়লো। একদিকে পিতা ইন্তেকাল করেছেন। অন্যদিকে পরিবারে ছোট ছোট ভাই-বোন। পিতার জীবদ্দশায় মাত্র এক বোনের বিয়ে হয়েছিলো। তিনি আমাদের বড় ফুফি রায়হানা। সবমিলিয়ে অবস্থা শোচনীয় ছিলো। কিন্তু ফিদায়ে মিল্লাতের চেষ্টা ছিলো ভাইদের তিনি মাদ্রাসায় পড়াবেন, দীনী শিক্ষা দীক্ষায় বড় করবেন। তাঁর ছোট ভাই মাওলানা আসজাদ সাহেব যখন কিছুটা বড় হলেন তখন ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) তাঁকে দিল্লীতে জমিয়তের নাজেমে দফতর বানিয়ে দিলেন। মাওলানা আসজাদ সাহেব যেহেতু শিশু বয়সেই পিতা হারিয়েছিলেন, তাই পরিবারের সবাই তাকে অনেক মুহাব্বাত করতেন। অল্প বয়সেই তাঁর শাহী মেজাজ গড়ে উঠলো। স্বভাবেও তাঁর কিছুটা কঠোর ভাব চলে এসেছিলো।

মাওলানা আসজাদ সাহেব জমিয়তের দায়িত্ব নেয়ার পর তাঁর কঠিন মেজাজের কারণে পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়। জমিয়তের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী মাওলানা আসরারুল সাহেব, মাওলানা ফুযায়েল, মাও. সদরুদ্দীন আনসারী সাহেবসহ আরো অনেকে যারা ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এর সাথে কাজ করছিলেন কোনো কারণে তারা মনক্ষুণ্ন হলেন। আকাবিরে আসলাফের মতো পরিপক্কতা, বিনয়-নম্রতার গুণ তারা দেখতে পাচ্ছিলেন না তারুণ্যদীপ্ত আসজাদ সাহেবের মাঝে। ফলে কিছুটা মতানৈক্যের সৃষ্টি হলো।

তখন ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) সফরে ছিলেন, (ফিদায়ে মিল্লাতের একেক সফর কয়েক মাস পর্যন্ত  দীর্ঘ হতো)। তিনি যখন সফর থেকে ফিরছিলেন। সবাই তাঁকে ইস্তিকবালের জন্য এয়ারপোর্টে গেলেন। তখনো কেউ কিছু জানতেন না। (গোপনে) মাওলানা আসরার সাহেব, ফুযায়েল সাহেব,  সদরুদ্দীন সাহেব (তাঁদের সকলের ইন্তেকাল হয়ে গেছে) তাঁরা সবাই হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) আসার আগে সম্মিলিত ইস্তিফা পত্র লিখলেন। এটা জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের নথিপত্রে লেখা আছে। হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) এয়ারপোর্টে নামতেই তারা তাঁর কাছে ইস্তিফা পত্র জমা দিয়ে চলে গেলেন। তাদের একটাই শর্ত, ভাইকে এখান থেকে সরালেই আমরা ফিরে আসবো।

হযরত ফেদায়ে মিল্লাতের সামনে এক বিশাল পরীক্ষা। কী কররেন তিনি? একদিকে জমিয়ত আরেকদিকে পরিবার। ফিদায়ে মিল্লাত রহ. ছিলেন পাহাড়ের মতো দৃঢ় মনোবলের অধিকারী। তাঁর সামনে ছিলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা ও ছিলাতুল আরহামের আদর্শ। অনেকেই আলেম হন, মুফতি হন কিন্তু জীবনে থোরাই এসব নির্দেশনাবলীর প্রয়োগ করেন!

শরীয়ত কাকে বলে? শরীয়তের নাম এটা না যে, আপনি অনেক বড় বড় কিতাব পড়েছেন,  হাদীসের রেওয়ায়াতগুলো মুখস্থ করে পরীক্ষায় লিখে পাশ করেছেন এবং পরীক্ষায় অর্জিত নাম্বারের ভিত্তিতে নিজেদের প্রোফাইল বানালেন। সার্টিফিকেট ভারী করে বিভিন্ন পদে ঢুকে গেলেন।

কিন্তু নবীজীর এসব নির্দেশনাবলী নিজেদের জীবনে অন্তুর্ভূক্ত করা, দুনিয়ার বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এগুলোকে সামনে রাখা এসব আমরা হযরত ফিদায়ে মিল্লাতের মাঝে দেখেছি। এমন কঠিন অবস্থায় লোকেরা ভাববে, জমিয়তকে বাচাঁবো, দীনকে বাচাঁবো নাকি ভাইকে বাচাঁবো? যদি ভাইকে না বাচাঁন তাহলে জান্নাত পাওয়া যাবে? না, যাবে না। কিন্তু নিজের অধীনস্ত কর্মচারীগণ আপনাকে ছেড়ে গেলে আল্লাহ তাআলা এর পরীক্ষা বা হিসাব নিবেন না। কিন্তু আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন হলে আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হতে হবে।

হযরত ফিদায়ে মিল্লাত (রহ.) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দৃঢ়চিত্তে সব সামলালেন। সূরা মুহাম্মাদের আয়াত ‘ফাহাল আসাইতুম ইন তাওয়াল্লাইতুম আন তুফসিদু ফিল আরদি ওয়াতুকাত্তিয়ু আরহামাকুম’-এ বর্ণিত অবস্থার ন্যায় কাজ করলেন। মুনাফিকদের পরিচিতিতেও আছে, তারা আত্মীয়তার বন্ধন ভুলে যায়, আত্মীয়দের  হত্যা করে। উপরে বর্ণিত সূরা মুহাম্মাদের আয়াতের সারমর্ম হলো, যখন কেউ ক্ষমতা লাভ করে, তখন সে তার আত্মীয়দের ভুলে যায়, নিজের ভাইদের ভুলে যায়।

এ ব্যপারে ইসলাম কী বলে? ইসলাম বলে, নিজেদের মাঝে আত্মীয়তার বন্ধন শক্তিশালী করো এবং সম্প্রীতি বজায় রাখো। আল্লাহ তাআলা শক্তি দিলে আত্মীয়দের জন্য সেই শক্তি ব্যয় করো, মুমিনদের জন্য সেই শক্তি ব্যয় করো। সূরা ফাতহের (২৯ নং আয়াতের) মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু বৈশিষ্টের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁরা কাফেরদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আহলে কুফরের সাথে তাদের কোন সমাঝোতা নেই। নিজেদের মধ্যে তারা দয়াশীল।

ফিদায়ে মিল্লাতের এই কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর সাহায্য আসলো। তখন যারা জমিয়তকে ছেড়ে গেছে আজ তাদের নাম-নিশানও নেই। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মোকাবেলায় আজ তাদের সামান্য থেকে সামান্য অবস্থাও নেই। এটা কে করেছেন? আল্লাহ তাআলা করেছেন।

অথচ আমরা মুসলমানরা বাহ্যিক অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যাই, লোকজন কী বলবে তা ভাবতে শুরু করি। মুসলমানরা যখন আত্মীয়ের জন্য কিছু করে অমুসলিমরা এটার নাম দেয় ‘স্বজনপ্রীতি’। এটা একটা মানষিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই কাজ আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয়। মানুষ এই কথা বোঝে না। সমাজ স্বজনসেবাকে গালি বানিয়ে নাম দিয়েছে ‘স্বজনপ্রীতি’ । স্বজনসেবা ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা উত্তম কাজ। ইসলামের দুশমনরা এটাকে খারাপ বানিয়ে ফেলেছে। তারা চায়, মানুষ তার স্বজনকে ভুলে অন্যের কাছে বসে থাকুক।

অথচ ফিদায়ে মিল্লাতের যদি দুনিয়ার প্রতি সামান্য মুহাব্বাতও থাকতো, তিনি বলতেন, ভাইদের পিছু ছাড়ানোর এটা ভালো সুযোগ, তাই তোমাদের চাওয়া মতো কাজ করি, আসো। কিন্তু তিনি এমনটা করেননি। দুনিয়ার গালি খেয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে পত্রিকায় লেখালেখি পর্যন্ত হয়েছে। এগুলো সবই ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে আছে, দেখে নিন।

বিপদে ধৈর্য্য ধরেছেন, মানুষের ক্রোধানলে ভষ্ম হয়েছেন, অপমান সহ্য করেছেন তবুও পরিবারের হাত ছাড়েননি। এটা কার জন্য করেছেন? দুনিয়ার জন্য করেননি। একমাত্র আল্লাহর জন্যই করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টর জন্যই করেছেন। আল্লাহর রাসূলের অনুসরনার্থেই করেছেন।

ক্রমশ..

উর্দু থেকে ভাষান্তর: আব্দুর রহমান রাশেদ, সহকারী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম

সম্পাদনা, আব্দুস সালাম ইবন হাশিম, সহযোগী সম্পাদক, পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম 

আরও পড়ুন,তাবলিগের দুইপক্ষই আমাদের : মাওলানা আরশাদ মাদানী 

 

 

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *