মুহাম্মাদ আইয়ুব
বর্বর ইজরায়েল কতৃক ফিলিস্তিনের নিরীহ স্বাধীনতাকামী শান্তিপ্রিয় মানুষদের উপর হামলার এক মাস হতে যাচ্ছে। আট হাজারের অধিক মানুষ এ পর্যন্ত মারা গেছে। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ শিশু। বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমান আমরা ইন্টারনেটের কল্যাণে সব কিছু দিব্যি দেখছি। স্পষ্ট দেখছি সন্ত্রাসী ইজরায়েলের পাশে নির্লজ্জের মতো আমেরিকা ইউরোপসহ গোটা কুফফার শিবির সহযোগিতা ও সমর্থন ব্যক্ত করেছে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও ভালোবাসা নিয়ে।
কিন্তু মজলুম নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পাশে দু’চারটে সান্তনার নামে অর্থহীন বাক্যব্যায় ছাড়া ২০০ কোটি মুসলমান কিছুই করতে আর পারেনি। তাই ভাবলাম আমজ আমার পাঠকদের একটু ভিন্ন জগত নিয়ে যাই। ইসলামের মহান আদর্শিক নবী রহমতের কাণ্ডারী, মানবিকতার মহাকাব্য রহমতে দো-আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোনালী সিরাতের আলোকিত উপত্যকায় তার দুইশো কোটি বেঘোর ঘুমে নিমজ্জিত উম্মতকে ঘুরিয়ে আনি।
এক. ৮ম হিজরির রমজান মুতাবেক ৬৩০ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাস। নববী জীবনে শুধু নয়, বরং গোটা ইসলামী ইতিহাসের জন্য সময়টা ঝলমলে আলোকিত উচ্ছ্বাসের অধ্যায়। যার রেশ কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি মুমিন হৃদয়ে দুলতে থাকবে মহা বিজয়ের উল্লাসে।
আজ থেকে ঠিক আট বছর আগে এই দিনে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে দো-জাহানের সর্দার তাঁর ‘গারে ইয়ার’কে সঙ্গে নিয়ে রাতের আঁধারে মক্কা থেকে হিজরত করে প্রিয় মাতৃভূমিকে বিদায় জানিয়েছিলেন চোখের জলে। পূণ্যভূমি মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় ছলছল নয়নে ব্যথিত হৃদয়ে অপলক নেত্রে তাকিয়ে ছিলেন আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহর দিকে। প্রচণ্ড আক্ষেপে অস্ফুটস্বরে বলছিলেন হে মক্কা! খোদার কসম,তুমি এই প্রেমিকের চোখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর ও আমার চোখের শীতলতা। আমার জাতি যদি আমাকে অন্যায়ভাবে বের না করত তাহলে আমি কোনদিন কখনোই তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেতাম না। কালের গর্ভে হারিয়ে গেল আট বছর পট পরিবর্তন হল, ইতিহাস ঘুরে এলো তবে রাতের আঁধারে নয় ফকফকা দিনের আলোয়। এলো ঠিক তবে দুঃখ নয় সুখের ডালি নিয়ে। একজন মহান বিজেতার বেশে গাম্ভীর্যের সাথে জিকিরের পবিত্র সুরে আড়ম্বরের সাথে প্রবেশ করেন সেই মক্কায়।
আল্লাহর ঘর বাইতুল্লায় প্রবেশ করে ভক্তি ভলোবাসার সেজদায় খোদার ঘরের সম্মান মর্যাদা মাহাত্ম্য বাড়িয়ে দেন বহুগুণে।
দুই. নিশ্চয়ই এবার পাঠকের মনে বিরাট বিরাট প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে সদর্পে। হুদাইবিয়ার সন্ধিতে তো মোটা দাগে একটা শর্ত ছিল যে,দশ বছরের মধ্যে দু’দলের মাঝে কোন যুদ্ধ হবে না তাহলে মাত্র দুই বছরের মাথায় নবীজী সাঃ সব শর্ত জলাঞ্জলী দিয়ে কী করে মক্কা বিজয় করলেন? অস্ত্রশস্ত্র ও বিশাল বাহিনী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন মক্কায়? যুৎসই প্রশ্নই বটে। তবে এ সব কিছুর মূলে কারা শুনেন তাহলে মজা পাবেন ঢের শিরোনামের দ্বন্দ্ব ও নিরসন হবে এখানে।
তিন. হুদাইবিয়ার সন্ধিতে আরব গোত্রগুলো ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাদের সামনে যে কোন পক্ষাবলম্বনের সুযোগ ছিল যে, যে কেউ মন চাইলে কুরাইশ শিবিরে যাবে কিম্বা মহানবী সাঃ এর সাথে থাকবে। এ শর্তের প্রেক্ষিতে বনু বকর চলে যায় কুরাইশদের দলে আর বনু খুজা’আ থাকে মুসলমানদের পাশে।
তারা দুই গোত্র বসবাস করত মক্কার কাছাকাছি এলাকায়। তবে দুই বংশের মাঝে পুরোনো বিরোধ ছিল দীর্ঘদিনের।
মক্কার কুরাইশ কাফের ও আরবের অপরাপর গোত্রগুলো একটা সময় একজোট হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব দিয়ে লড়তে থাকে। তবে হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তারা থেমে যায়। কিন্তু বনু বকর তার পুরোনো বিরোধের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে।
সেই জেরে একদিন তারা অতর্কিতে বনু খুজা’আর উপর আক্রমণ চালায়।
অপরদিকে মক্কার কুরাইশ কাফেররা হামলায় তাদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কুরাইশ নেতারা তথা ইকরিমা ইবন আবু জাহল, সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা, সুহাইল ইবন আমর এই হত্যাজজ্ঞে সরাসরি অংশ নেয়।
নিরীহ বনু খুজা’আ এই ভয়ানক হামলা থেকে বাঁচতে দৌঁড়ে হেরেম শরীফে আশ্রয় নেয়। বনু বকরের সাধারণরা হেরেম শরীফের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিরত থাকলেও তাদের সর্দার নওফেল হত্যার নেশায় মাতাল হয়ে এই পবিত্র আঙিনায় বনু খুজা’আর লোকদের হত্যা করে এবং স্বজাতিকে এই বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে এসো এসো! এই সুযোগ আর পাবে না।
তাহলে আজকের ফিলিস্তিন কি মুসলমানদের মিত্র নয়! না কি ভিনদেশ, ভিন্নভাষী বিচিত্র রংয়ের বিধায় আমাদের বোধে লাগে না।
মনুষ্যরূপী এই হিংস্র প্রাণীরা আল্লাহর ঘরের সম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। অপরদিকে কুরাইশ নেতারা থামানো তো দূরের কথা উল্টো সমর্থন দিয়ে নিজেরাও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। কুটাইশরা তাদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে হুদাইবিয়ার সন্ধি টুকরো টুকরো করে ফেলে। কেননা বনু খুজায়া হুজুর সাঃ এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাঁর মিত্র হয়ে গিয়েছিল তাই তাদের উপর আক্রমণ মানে হুজুর সাঃ এর উপর আক্রমণের নামান্তর।
এই হামলায় বনু খুজায়ার ২৩ জন মারা যায়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বনু খুজায়ার সর্দার আমর ইবন সালিম খুজায়ী ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে ফরিয়াদের সুরে নবীজীর (সাঃ) কাছে উপস্থিত হয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলে।
মূলত, এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডই মক্কা বিজয়ের পথ সুগম করে।
হযরত মাইমুনা (রাঃ) বর্ণনা করেন, এক রাতে হুজুর সা. ঘরে অযু করছিলেন অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ তিনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, লাব্বাইক লাব্বাইক লাব্বাইক ( আমি তোমাদের পক্ষে একদম তৈরী আছি)
তারপর তিনবার বললেন, নুসরাত নুসরাত নুসরাত( তোমরা সাহায্য পাবে) তিনি যখন অজুখানা থেকে বের হলেন তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি একাকী কার সাথে কথা বলছেন? বললেন, মাইমুনা! সর্বনাশ হয়ে গেছে; আমার মিত্র বনু খুজা’আর উপর বনু বকর ও কুরাইশরা মিলে আক্রমণ করেছে। সেই কঠিন বিপদসংকুল মুহুর্তে বনু খুজা’আ আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে আর আমি এখান থেকে তাদের ফরিয়াদ শুনে সান্তনা দিয়েছি যে, আমি আসছি আমার সৈন্য বাহিনী নিয়ে।
প্রিয় পাঠক! কি বুঝলেন? মিত্র কাফের তাতে কী? মিত্র তো মিত্রই। মহানবী সা. ঝাপিয়ে পড়েছেন সাহাবীদের নিয়ে জয় করেছেন মক্কা। মজলুমকে দিয়েছেন তার প্রাপ্য বিচার।
তাহলে আজকের ফিলিস্তিন কি মুসলমানদের মিত্র নয়! না কি ভিনদেশ, ভিন্নভাষী বিচিত্র রংয়ের বিধায় আমাদের বোধে লাগে না।
আমি তো ভালো আছি বেশ। হামলা আর নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমার দেশে হচ্ছে না।
পরিবার পরিজন নিয়ে তো আমি ভালো আছি আমার ক্ষমতা আছে তো বেশ তাহলে আর সমস্যা কী? ওদের সমস্যা ওরাই মিটমাট করুক আমরা বরং ঘুমিয়ে পড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে।
লেখক, আলেম ও মাদরাসা পরিচালক