গাজীপুর প্রতিনিধি : ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য এবং কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে টঙ্গীর তুরাগ তীরে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ ৫৩ তম বিশ্ব ইজতেমার ২০১৮এ-র ২য় পর্ব গতকাল শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে।
ইজতেমা ময়দানে গতকাল শুক্রবার দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসুল্লি জুমার নামাজ আদায় করেন। জুমার নামাজে ইমামতি করেন ঢাকার কাকরাইল মসজিদের খতিব হাফেজ হযরত মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের।
জুমার নামাজে অংশ নিতে গাজীপুর ও ঢাকাসহ আশপাশের জেলার মুসল্লিরা ভোর থেকে ময়দানে আসতে শুরু করেন। ইজতেমা ময়দান, সড়ক-মহাসড়ক, অলিগলিসহ বিভিন্ন স্থানে পাটি, চটের বস্তা, খবরের কাগজ, চাদর ও পলিথিন বিছিয়ে মুসল্লিরা জুমার নামাজে শরিক হন।
ইজতেমার মুরুব্বি মাওলানা মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘গতকাল শুক্রবার জুম্মার নামাজে ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের খতিব হযরত হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের। তাবলীগ অনুসারী ছাড়াও ঢাকা, সাভার, গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকার লাখো মুসল্লি জুমার নামাজে অংশ নেন’।
ইজতেমা উপলক্ষে তাবলীগ জামাতের দেশী-বিদেশী লাখো মুসল্লির ঢল তুরাগ তীরের ইজতেমা ময়দানের দিকে। গতকাল শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমায় শরীক হচ্ছেন ঢাকা জেলার আংশিকসহ ১৪ জেলার মুসল্লিরা। তাদের সঙ্গে দুই ধাপেই শতাধিক দেশের তাবলীগের বিদেশী মেহমান রয়েছে। আগামী ২১ জানুয়ারি রোববার জোহরের নামাজের পূর্বে যেকোন সময় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয়পর্ব।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বরাদ্দকৃত তুরাগ পাড়ের প্রায় ১৬৫ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ইজতেমার মূল সামিয়ানার নিচে অবস্থান নিয়েছেন দেশ বিদেশ থেকে আসা লাখো মুসল্লি।
ইজতেমায় মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে থাকছে বিশেষ ট্রেন ও বাস সার্ভিস। নিরাপত্তায় নেয়া হয়েছে ৮ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিশ্ব ইজতেমার পুরো ময়দান সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে।
ইজতেমায় বিদেশী নিবাসে আছেন ভারত, পাকিস্তান থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশের ৫ হাজারের বেশি মুসুল্লি। বিদেশী নিবাসে গ্যাস সংযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে আলাদা স্বাস্থ্য ক্যাম্প।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের প্রথমদিন (গতকাল শুক্রবার) পর্যন্ত ৩৫টি দেশের ২ হাজার ৫শ’ মুসল্লি যোগদান করেছেন। তিনি জানান, ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকায় জেলা প্রশাসনের ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ভেজালবিরোধী অভিযান এবং উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এদিকে, তাবলীগের বিভিন্ন মেয়াদের চিল্লায় থাকা আর ইজতেমার দাওয়াতের কাজে যারা ছিলেন সেসব মুসল্লিরাও দলে দলে ইজতেমা ময়দানে আসছেন। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা আর ওযু, গোসলখানা ও নিরাপত্তাসহ সব ধরনের আয়োজন নিয়ে সন্তুষ্ট তারা।
এবারও তুরাগ নদ পারাপারের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় পন্টুন ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য র্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে ২য় ধাপেও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, সিসি টিভি বসানো হয়েছে।
ইজতেমা ময়দানে নির্দিষ্ট ‘খিত্তা’ গুলোতে অবস্থান নিয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মুসল্লিরা। মুজাকারাসহ চলছে নানা ধর্মীয় বয়ান।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ¯’ানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মো. জাহিদ আহসান রাসেল জানান, বর্তমান সরকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমা মাঠে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এরমধ্যে ১৩টি উৎপাদক নলকূপের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৩কোটি গ্যালন খাবার ও ওজু খোসলের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ৮ হাজারের বেশি মুসল্লি একই সময়ে টয়লেট ব্যবহার করতে পারবেন বলেও তিনি জানান।
বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে ইজতেমা ময়দানের পাশে নিউ মন্নু ফাইন কটন মিলে স্থাপন করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। এসকল মেডিকেল ক্যাম্প থেকে ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে দেয়া হচ্ছে।
টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ২৫০শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, হামদর্দ, যমুনা ব্যাংক, র্যাব, ইমাম সমিতি, গ্রামীণফোন ও রবি, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম, ইন্টার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, ড. এ আর খান ফাউন্ডেশন, টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, গাজীপুর জেলা প্রশাসন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পর্ষদ (স্বাচিপ) সহ অর্ধশত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল ক্যাম্প ইজতেমায় আগত মুসুল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। এছাড়াও ইজতেমা ময়দানে টঙ্গী প্রেসক্লাবের মিডিয়া সেন্টার চালু রয়েছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব) কে এম রাহাতুল ইসলাম জানান, সিটি কর্পোরেশন দ্বিতীয় ধাপের বিশ্ব ইজতেমায়ও আগত মুসল্লিদের ২৪ ঘণ্টা সেবা দিচ্ছে।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন- অর- রশীদ বলেন, দ্বিতীয় ধাপের বিশ্ব ইজতেমায় প্রায় ৬ হাজারের মতো পুলিশ নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করবে। প্রতিটি খিত্তায় ৬জন করে সাদা পোশাকে পুলিশ অবস্থান করবে। ইজতেমায় সার্বিকভাবে সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েনসহ পুরো ময়দান সিসি টিভি ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ইজতেমার প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ইজতেমায় বাংলাদেশসহ বিভিন্নদেশ থেকে আসা মুসল্লিরা অবস্থান করছেন। আমাদের দায়িত্ব তাদের নিরাপত্তা বিধান করা।
ইজতেমা ময়দানের জিম্মাদার মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার গিয়াসউদ্দিন জানান, দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসল্লিরা বুধবার রাত থেকে ইজতেমাস্থলে আসতে শুরু করেন এবং ময়দানে জেলাওয়ারি ‘খিত্তা’য় অবস্থান নেন।
তিনি বলেন, অনেকেই বাস, ট্রাক, পিকআপ, লেগুনায় চড়ে কেউবা ট্রেনে, নৌকায় চড়ে ইজতেমাস্থলে আসছেন। মুসুল্লিদের ইজতেমা ময়দানে আসার এ ঢল আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা জেলার খিত্তা নং-১ হইতে ১০ এবং ১৮ ও ১৯), জামালপুর জেলা খিত্তা নং-১১ ও ১২, ফরিদপুর জেলা খিত্তা নং-১৩, ফরিদপুর জেলা খিত্তা নং-১৪, ঝিনাইদহ জেলা খিত্তা নং-১৫, ফেনী জেলা খিত্তা নং-১৬, সুনামগঞ্জ জেলা খিত্তা নং-১৭, চুয়াডাঙ্গা জেলা খিত্তা নং-২০, কুমিল্লা জেলা খিত্তা নং-২১ ও ২২, রাজশাহী জেলা খিত্তা নং-২৩ ও ২৪, খুলনা জেলা খিত্তা নং-২৫ ও ২৭, ঠাকুরগাঁও জেলা খিত্তা নং-২৬ ও পিরোজপুর জেলা খিত্তা নং-২৮ এ অংশ নিবেন। মুসল্লিদের সুবিধার্থে ময়দানের উত্তর দিক থেকে ক্রমানুসারে দক্ষিণ দিকে খিত্তার নম্বর বসানো হয়েছে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রনকক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমা মাঠ ও এর আশপাশ এলাকায় ২০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন ২টি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। বুধবার বিকেল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
গাড়ি পার্কিং: বিশ্ব ইজতেমায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে টঙ্গী পাইলট স্কুল এন্ড কলেজ মাঠ, টঙ্গী সফিউদ্দিন সরকার একাডেমী এন্ড কলেজ মাঠ, উত্তরার আজমপুর স্কুল মাঠ, কামারপাড়ায় রানাভোলা মাঠে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।