মাসউদুল কাদির ● আমরা মুসলিম জাতি। পৃথিবীজুড়েই যেনো শত কোটি মানুষের এই বিরাট শক্তিও আজ ক্ষীণকায়, দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়েছি। প্রায় শত বছর ধরে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিশ্ব বিবেক নাড়া দেয় না। কেবল বিবৃতিতেই থাকে সীমাবদ্ধ। এবার রাখাইনে যে নিধন চালিয়েছে মিয়ানমার কসাইরা তা আগের সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছে। জাতিগত এই নিধনকেই সাম্প্রদায়িকতার ছোবলে আক্রান্ত হয়ে রাশিয়া-চীন-ভারত সমর্থন জানিয়েছে। যদিও সুষমা রোহিঙ্গা সঙ্কটে বাংলাদেশের পাশে আছে বলে জানিয়েছে। এদিকে বিশ্ব মুসলিম বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চলেছে। খোদ রাশিয়ার মতো দেশে এগার লাখ মানুষ একত্র হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। বাংলাদেশের মানুষ তখনও অতটা বিক্ষোভ দেখায়নি। মিয়ানমারে সংঘটিত প্রকৃত ঘটনাও মিডিয়া কভারেজ না পাওয়ায় জনসম্মুখে খুব কমই আসে। সব মিলিয়ে বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে মানবিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উঠে এসেছে বলেই এখন সবাই ধরে নিচ্ছে।
খুব সতর্ক হয়ে খেয়াল করছিলাম, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী করেন? বিষয়টি যে ঝুঁকিপূর্ণ তা সবাই জানেন। যেখানে জঙ্গিবাদের তকমা এঁটে দেয়ার জন্য একটা শ্রেণি যারপরনাই চেষ্টা করে চলেছে। যেখানে সেখানে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তুলছে। পুলিশ সেসব আস্তানা খুঁজেও বের করছে। এরকম একটা সময়ে লাখো লাখো মানুষের জন¯্রােত দেখে কী করেন প্রধানমন্ত্রী তা দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। তিনি এই জন¯্রােত দেখে কাঁদলেন। একাত্তরের কথা মনে করলেন। এভাবে এ দেশের কোটি লোক ভারতে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলো।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে আর কষ্টের কথা শুনে চোখের পানি আটকাতে পারলেন না বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় আহত ও নির্যাতিতদের দুঃখ দেখে আর দুর্দশার কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে যে আদর্শের পথপরিগ্রহ করার কথা ছিলো তিনি তা-ই করলেন। মানবতার পক্ষে দাঁড়ালেন। এ দেশের কোটি কোটি মানুষ তা দেখলো। কেউ কেউ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলেরও চেষ্টা করেছে। শত শত ইসলামী দল, সংগঠন কাজ করছেÑ কেউই তো বাধার মধ্যে পড়ছে না। তাহলে কেউ কেউ কেন বাঁধার মধ্যে পড়লো? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সেবায় যখন রাজনৈতিক রঙ লেগে যায় তখন সেটা আর সেবা থাকে না। মানবতার পক্ষের কাজ থাকে না।
মূলত কক্সবাজার, টেকনাফের সাধারণ জনগণ যেভাবে রোহিঙ্গাদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেনÑ সেখানে তো দলের পরিচয় বড় না। মানুষের সেবাই বড়। সেখানে সব দলমতের লোকেরাই কাজ করে চলেছে।
আলেমগণ আগেও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের কথাও মনে পড়ে। জামিআ ইসলামিয়া পটিয়ার মুহতামিম মাওলানা হাজী ইউনুস ও খতীবে আজম সিদ্দিক আহমদ রহ. রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়ে স্মৃতি হয়ে আছেন। এখনও তাদের কর্মের প্রতিচিহ্ন সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
পবিত্র হজব্রতের সফরে ছিলেন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান ও ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা.। তিনি সেখানে থেকেই বেদনার কথা জানিয়েছিলেন। কষ্টের কথা জানিয়েছেন। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বানও করেছেন। বিশ্ব মুসলমানের একটি বৃহৎ অংশ তাঁর আহ্বানে সাড়াও দিয়েছেন। আপাতমস্তক আমরা সবাইকে যেনো ঐক্যবদ্ধভাবেই রোহিঙ্গাদের সেবায় কাজ করছি। সবমতপথের মানুষেরা এই প্রথম যেনো একত্র হয়ে গেছে। বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার একটি বড় কাফেলা মাওলানা ইমদাদুল্লাহ কাসেমী ও আল্লামা মাসঊদ তনয় মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুনের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কাজ করছে। চরমোনাইসহ দেশের বরেণ্য আলেমগণও কাজ করছেন টেকনাফের পাহাড়ে পাহাড়ে এবং শরণার্থী শিবিরে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও সাহসি ও স্বাবলম্বী বাংলাদেশের জয়োধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনা সরকারের আশ্রয়ের বিষয়টিকে প্রশংসা করেছে। গভীর উদ্বেগের কথাও জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ভুক্তভোগী (পালিয়ে আসা) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছে সহায়তা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টারও প্রশংসা করছে যুক্তরাষ্ট্র। শরণার্থী রোহিঙ্গাদের জরুরি সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, রেডক্রসসহ অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ৬৩ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা দিয়েছে বলে জানানো হয়। ৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ জানায়, মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সহিংস দমন-পীড়নের মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে সেখান থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসার বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্যে যুক্তরাষ্ট্র গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
মিয়ানমারের জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের প্রদত্ব বিবৃতিটি নি¤œরূপ, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর পদ্ধতিগতভাবে জাতিগত নিধন অভিযান চালানোর জন্য মিয়ানমারের কঠোর সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান জায়েদ রাদ আল হোসেইন। ১১ সেপ্টেম্বর সোমবার জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) প্রধান বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে মানবাধিকারবিষয়ক তদন্তকারীদের রাখাইনে ঢুকতে দিচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি দেখে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সেখানে সুস্পষ্টভাবে জাতিগত নিধন অভিযান চলছে।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সীমান্তরক্ষী পুলিশের (বিজিপি) ওপর হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্যরা।
এ হামলার ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়। এর মধ্যে ১২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর ও বাকিরা আরসার সদস্য।
এরপর মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী রাখাইনে বিতাড়ন অভিযান শুরু করে। তারা সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, সেনা অভিযানে রাখাইনে এ পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আর প্রাণ বাঁচানোর জন্য গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ইউএনএইচআরসি প্রধান জায়েদ বলেন, মিয়ানমারের এ অভিযান পরিষ্কারভাবে বাড়াবাড়ি এবং আন্তর্জাতিক আইনের মূল নীতি অনুসরণ না করেই এটি চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা প্রাপ্ত একাধিক প্রতিবেদন এবং স্যাটেলাইট ছবি থেকে জানতে পেরেছি, নিরাপত্তা বাহিনী এবং স্থানীয় জঙ্গিরা রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে আগুন দিচ্ছে। তারা পলায়নরত মানুষকে গুলিসহ ব্যাপকহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চালাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ইউএনএইচআরসি জানায়, চলমান সেনা অভিযান বন্ধ, অপরাধে জড়িত সবাইকে বিচার করতে এবং রোহিঙ্গা জনগণের ওপর বৈষম্যের অবসান করতে আমরা মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
হত্যা-নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখার ঘটনার কথা জেনে হতভম্ব হয়ে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।
যেসব রোহিঙ্গা শরণার্থী সহিংসতার ভয়ে পালাচ্ছে তাদের রাখাইনে ফিরতে হলে জাতীয়তার প্রমাণপত্র দেখাতে বলে মিয়ানমার সরকার যে অফিসিয়াল বিবৃতি দিয়েছে তারও সমালোচনা করেন জায়েদ।
১৯৬২ সাল থেকে নাগরিকত্বসহ রোহিঙ্গাদের অধিকার ব্যাপকহারে হরণ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রমাণপত্রবিষয়ক ঘোষণা জোর করে তাড়িয়ে দেয়া বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নস্যাৎ করা ছাড়া আর কিছু নয়।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছেন। সেখানেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছে। সেখানে রয়টার্সকে দেয়া সাহসি বক্তব্য মনে রাখবে এ দেশের মানুষ এবং বিশ্বাবাসী। যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের আশ্রয় দেবে না বলে ঘোষণা দেয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে কোনো সহায়তা আশা করেন না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘে এক বৈঠক শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শেখ হাসিনা তাকে কয়েক মিনিটের জন্য থামিয়েছিলেন।
জাতিসংঘের সংস্কার বিষয়ে আলোচনার জন্য ট্রাম্পের উদ্যোগে বৈঠকটি হয়েছিল।
ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে শেখ হাসিনা রয়টার্সকে বলেন, তিনি (ডোনাল্ড ট্রাম্প) শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন- বাংলাদেশ কেমন আছে? আমি বলেছিলাম- ‘ভালো। তবে আমাদের একমাত্র সমস্যা মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীরা। কিন্তু শরণার্থীদের নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।’
শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন, শরণার্থীদের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান পরিষ্কার। সেজন্য রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের বিষয়ে তার সহায়তা চাওয়া কোনো কাজ হবে না।
তিনি বলেন, আমেরিকা ঘোষণা করেছে যে, তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না। আমি তার কাছ থেকে কী আশা করতে পারি? বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। তিনি এরই মধ্যে তার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। সুতরাং আমি তাকে কেন জিজ্ঞেস করতে যাব?
প্রধানমন্ত্রী সব রোহিঙ্গাদের দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ ধনী রাষ্ট্র নয়। কিন্তু তারপরও ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারে। এর বাইরে আরও পাঁচ-সাত লাখ মানুষকেও বাংলাদেশ খাওয়াতে পারবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সত্যিই, আতিথেয়তাপ্রবণ এই বাংলাদেশের মানুষ। নিজের ঘরে খাবার থাকবে আর পাশের ঘরে উপোশ হয়ে বেঁচে থাকবে মানুষ তা কি করে হয়। এ দেশের মানুষ তো একটি কুকুরকেও না খেয়ে মরতে দিতে পারে না। কারণ এ দেশের মানুষের হৃদয়ে আছে ইসলামের মর্মবাণী। ইসলাম তো যাতে কীট পতঙ্গের কষ্ট না হয় সেমতে কোনো গর্তে প¯্রাব করতেও নিষেধ করে। ইসলাম কেবল মানুষ নয়, অহেতুক একটি গাছের পাতা ছিঁড়তেও মানা করে। ইসলাম শাশ্বত সুন্দরের পথ।