পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : অনেক প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স শত বছর পার হয়েছে। বর্তমান বয়স ১০৩ বছর। এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতি, রাষ্ট্র গঠনে ও জাতীয় চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণ। বর্তমানে এ কাজে পিছিয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এমনটিই মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া, শত বছর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট, নিরাপদ ক্যাম্পাসের অভাববোধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। সেইসঙ্গে তাদের প্রত্যাশা—এসব সংকট কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার পূর্বের গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে ফিরে আসবে।
ঢাবির ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’। এ বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের না। দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করবে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আরও যেসব ইনস্টিটিউট রয়েছে সেগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে জাতির জন্য জ্ঞান উদ্ভাবন। আর জ্ঞান উদ্ভাবন না হওয়ার কারণ—আমরা সেটিকে ফোকাস করি না। না করার পেছনে রয়েছে আমাদের জাতীয় চাহিদা। জাতীয় চাহিদার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। আমাদের একসময়ের জাতীয় চাহিদা ছিল স্বায়ত্তশাসন, জাতিরাষ্ট্র গঠন, ন্যাশনাল হারমনি। এ জন্য বলা হয়, বিশ্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। এগুলো হলো সার্বিকভাবে একটি অবদান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ নিত্যনতুন জ্ঞান উদ্ভাবন, জ্ঞান সংরক্ষণ ও জ্ঞান বিতরণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা পশ্চিমাদের জ্ঞান বিতরণ ও সংরক্ষণ করি। কিন্তু জ্ঞান উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আমরা নিঃসন্দেহে পিছিয়ে আছি। পিছিয়ে থাকার কারণও রয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করপোরেট, এনজিও ও সরকারের জন্য এক ধরনের কর্মী বাহিনী তৈরি করে এবং সেটি নিয়ে আমরা গর্ববোধও করি। জ্ঞান উদ্ভাবন যে পরিমাণে করার কথা, আমরা তা করছি না। এর মূল কারণ জাতি চাহিদা।’
জ্ঞান উদ্ভাবন না হওয়ার কারণ হিসেবে অধ্যাপক মজিবুর রহমান আরও বলেন, ‘আমাদের মনোভাব গবেষণাকেন্দ্রিক না, যার প্রভাব আমরা দেখি বাজেটে। আমাদের দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট গবেষণা বাজেট যা, তার চেয়ে বেশি গবেষণা বাজেট থাকে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলোতে।’
গবেষণা মূল্যায়ন না হওয়াকেও গবেষণা না হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আমাদের গবেষণা যে একদমই হয় না, তা নয়। তবে গবেষণা হচ্ছে স্বল্প পরিসরে, কিন্তু সেগুলোর মূল্যায়ন নেই। সেগুলো ফাইলেই চাপা পড়ে থাকে, রাষ্ট্র সেগুলোকে এক্সিকিউট করে না। যার ফলে আমলা ও রাজনৈতিক নেতারা তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নেন। মূল্যায়ন না হওয়ার ফলে গবেষকরা গবেষণা করতে নিরুৎসাহী হন।’
বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দলীয় রাজনীতি যে করে, তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে জুনিয়র শিক্ষকরা শুরু থেকেই গবেষণায় নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়কে অতি রাজনীতিকীকরণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাবিমুখ করেছে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন—‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বলতে যদি বোঝায় জ্ঞান উৎপাদন, জ্ঞান বিতরণ, জাতির কল্যাণে পলিসি নির্মাণ—তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের মানুষকে বেশ হতাশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের গড়পড়তা মানুষের সামগ্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতেও নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা লাল ইমারতগুলোকে বোঝাচ্ছি না। বরং ইমারতের রাজাসনে সমাসীনদেরই বোঝাচ্ছি। দেশ যখন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যায়, তখন দেশের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মগজ ও কলমের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু দেশের ক্রান্তিলগ্নে হাস্যকর ‘প্রেস রিলিজ’ ছাড়া মানুষের কপালে আর ভালো কিছু জোটে না। অবশ্য মহামতি শিক্ষকরা দেশ ক্রান্তিলগ্নে আছে মনে করেন কিনা, সেটাও বড় প্রশ্ন। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি আমলা উৎপাদনের ভালো কারখানা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে।’
আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘শত বছরে যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আবাসন নিশ্চিত করতে পারেনি, নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন উপহার দিতে পারেনি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করাটাও বোকামি। আপাতত এই দুটো চাহিদাই পূর্ণ করুক।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তৈবুর রহমান সিফাত বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত শত বছরে বাংলাদেশের মানুষের বেশ কিছু প্রত্যাশা পূরণ করেছে। এটি উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন, গবেষণা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মেধাবী মানুষদের শিক্ষিত করার মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে। তবে কিছু ঘাটতি ও চ্যালেঞ্জ এখনও রয়েছে।’
এসব ঘাটতি পূরণের জন্য সিফাত বেশ কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানো, শিক্ষক প্রশিক্ষণ বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাস প্রণয়ন করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল বাড়ানো এবং গবেষণায় উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়ন। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব ও লাইব্রেরি উন্নত করা। তারপর উদ্ভাবনী ও শিল্প সহযোগিতা। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্ভাবনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা এবং শিল্পের সঙ্গে আরও বেশি সহযোগিতা তৈরি করা। এরপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে চোখ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, যা তাদের সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব উন্নয়নে সহায়তা করবে।
সর্বশেষ দুটি বিষয় হলো—প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করা।
সিফাত মনে করেন, এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও উন্নত ও প্রতিযোগিতামূলক হতে পারবে। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন