অবরুদ্ধ গাজায় মানবতার মৃত্যু-অরুন্ধতী রায়

অবরুদ্ধ গাজায় মানবতার মৃত্যু-অরুন্ধতী রায়

  • অরুন্ধতী রায়

আমি জনপরিসরের আয়োজনে উপস্থিত থাকতে পারছি না। আপাতত আমার সে সুযোগ নেই। এমনকি জার্মানিতেও না। আমি জানি, সেখানে আমার মতাদর্শের মানুষ কার্যত নিষিদ্ধ। তবে আমার কণ্ঠ যোগ না করলেও লাখ লাখ মানুষ প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে। ইহুদি, মুসলিম, খ্রিষ্টান, হিন্দু, কমিউনিস্ট, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী– সবাই এতে শামিল হয়েছেন। তারা বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন। তাদের আহ্বান– গাজায় অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতি দিন।

আমরা যদি এই উন্মত্ত হত্যাকাণ্ড চলতে দিই; এমনকি আমরা যদি ব্যক্তিগত জীবনের একান্ত কোনো বিষয় নিয়েও ব্যস্ত থাকি, তার পরও আমরা এই দুষ্কর্মের সহযোগী হবো। আমাদের নৈতিকতার ভাবমূর্তি চিরদিনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যখন হাসপাতালগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে, ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং হাজার হাজার মৃত শিশুকে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বের করে আনা হচ্ছে, তখন আমরা কি কেবল পাশে দাঁড়িয়ে দেখব? আমরা কি আবার দেখব, সব মানুষকে এমনভাবে অমানুষে পরিণত করা হচ্ছে যে, তাদের সম্পূর্ণ শেষ করে ফেলাতেও কিছু আসে যায় না?

পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখল এবং গাজা অবরুদ্ধ রাখা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদেশ, যারা ইসরায়েলকে আর্থিক জোগান দিচ্ছে, তারাও অপরাধের সমান অংশীদার। এ মুহূর্তে আমরা বিভীষিকা দেখছি। হামাস হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছে, যার পরিণামে ইসরায়েলও যে দখল ও অবরোধ বজায় রাখছে এবং হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে– উভয়ই অগ্রহণযোগ্য।

এ নৃশংসতাকে কোনোভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। উভয় পক্ষ যে বাড়াবাড়ি করেছে, তার নিন্দা কোনোভাবেই যথেষ্ট হতে পারে না। এ বর্বরতা বন্ধে মিথ্যা কোনো বয়ান সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে না। ইসরায়েলি দখলই এ দানবের জন্ম দিচ্ছে। এটি অপরাধী এবং অপরাধের শিকার উভয়ের প্রতিই সহিংসতার কারণ হচ্ছে। নৃশংসতার শিকাররা মৃত। অপরাধীরা যা করেছে, তা তারা বয়ে বেড়াবে। তাদের সন্তানরাও তাই করবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

সামরিক সমাধান এখানে কাজে দেবে না। এখানে কেবল রাজনৈতিক সমাধানই যথাযথ হতে পারে, যেখানে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ই সমান অধিকার নিয়ে সম্মানজনকভাবে একসঙ্গে বা পাশাপাশি বসবাস করবে। সে জন্য বিশ্বকে হস্তক্ষেপ করতেই হবে। ইসরায়েলি এই দখলের অবসান অবশ্যই ঘটাতে হবে। ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব মাতৃভূমি থাকতে হবে।

যদি তা না হয়, তবে পশ্চিমা উদারনীতির তথাকথিত নৈতিক ভিত্তির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বস্তুত আমরা জানি, এটি সব সময় ভন্ডামিই ছিল। তার পরও পশ্চিমারা এক রকম আশ্রয় দিয়েছিল। সেই আশ্রয় আমাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

সে জন্য ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের স্বার্থে, সেখানকার জীবিত মানুষদের জন্য এবং মৃত মানুষদের নামে; হামাস যাদের জিম্মি বানিয়েছে, তাদের এবং ইসরায়েলের কারাগারে যেসব ফিলিস্তিনি রয়েছে, তাদের স্বার্থে এবং সর্বোপরি সব মানবতার জন্য এখনই যুদ্ধে বিরতি দিন।

অরুন্ধতী রায়: বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় লেখক ও মানবাধিকার কর্মী; মিউনিখ লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে প্রদত্ত ভিডিও বক্তৃতার পূর্ণ রূপ দ্য স্ক্রল থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *