অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে সরকার

অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের সকল বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাডব্যাংককে অটোমেশন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। অতিসম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেয়া ও নবায়ন প্রক্রিয়ার অটোমেশন কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন। এর ফলে লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধ সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক দ্রুত চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। লাইসেন্স নবায়ন না করা পর্যন্ত ওসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করতে পারবে না। তাছাড়া এক প্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে কর্মরত কোন চিকিৎসক, নার্স ও মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবে না। ফলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে লাইসেন্স গ্রহণ বন্ধ এবং অপ্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয়, সময় ও হয়রানি থেকে রোগীরা রেহাই পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশজুড়েই শত শত অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। অধিকাংশেরই নেই সরকারি অনুমোদন। কোথাও কোথাও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নিয়ে খুলে বসা হয়েছে হাসপাতালের ব্যবসা। ভর্তি করা হয় রোগী। ভাড়া করে আনা হয় চিকিৎসক। এমন ফাঁদে পড়ে অনেক রোগীই নানা হয়রানি শিকার হচ্ছে। সাইনবোর্ডসর্বস্ব ওসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা এবং দেয়া হয় মনগড়া রিপোর্ট। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা শত শত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র জানায়, নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণীর ডাক্তারের সহায়তায় বছরের পর বছর ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্টবাণিজ্য চালাচ্ছে। আর প্রতারণার শিকার সাধারণ মানুষ। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, কমিশনের লোভে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয়া হয় না। সেখানে সবচেয়ে দামী দামী আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে দ্রুততম সময়েই সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। আর বেসরকারি রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অনুমোদন নেয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোগ নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসেছে।

ভুঁইফোড় ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগ বরাবরই চরম উদাসীন। এমনকি অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেয়নি। বরং প্রতিনিয়ত রক্ত মিশ্রিত ব্যান্ডেজ, মাংসের টুকরা, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য আবর্জনা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে, খোলাস্থানেই ফেলা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী সেগুলো ইনসিনেটরে পোড়ানোর কথা। তাছাড়া ওসব বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ধুয়েমুছে আবার ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটছে। পাশাপাশি ওই বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে খোলা জায়গায় ফেলে রাখায় মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত সিপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী তার পছন্দ মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হলে পরেই চিকিৎসা। আর পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছেমাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। যদিও নিয়ম আছে রেট চার্ট স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার মতো স্থানে লাগিয়ে রাখার।

সূত্র আরো জানায়, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সামনে সুপরিচিত ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ তালিকাযুক্ত বিরাট মাপের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হলেও বাস্তবে গিয়ে তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। বর্তমানে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ১০ হাজার ৯৮০ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ৫ হাজার ১৫১ ক্লিনিক বা হাসপাতাল এবং ১৪৩ ব্লাডব্যাংক রয়েছে। সেগুলোর লাইসেন্স ও নবায়নের দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখা করে থাকে। নতুন পদ্ধতিতে কোন আবেদনকারী নিজ নিজ অবস্থান থেকেই অনলাইনে আবেদন করতে পারবে এবং আবেদনের অগ্রগতি পরীক্ষা করতে পারবেন। তাতে প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর সার্বক্ষণিক উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে থাকায় দুর্নীতিরও সুযোগ থাকবে না। প্রক্রিয়াটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের সব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান অনলাইন ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হবে।

এদিকে এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, বর্তমান সরকার নিরাপদ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে বদ্ধপরিকর। রাজধানীসহ সারাদেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ওই তালিকা তৈরির পাশাপাশি কালো তালিকাভুক্ত প্রতিস্থানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল বিভাগ ওই অভিযান পরিচালনা করছে। অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনসাধারণকেও সোচ্চার হতে হবে। ওসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, অনেক সময় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর তা বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি হাসপাতালগুলো আর অনিয়ম করতে পারবে না। দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ হবে। আর অভিযুক্তদের সহজেই চিহ্নিতকরণ এবং শাস্তির আওতায় আনা যাবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *