অস্বাভাবিক মুনাফায় ইন্ট্রাঅকুলার লেন্স বিক্রি হচ্ছে

অস্বাভাবিক মুনাফায় ইন্ট্রাঅকুলার লেন্স বিক্রি হচ্ছে

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক ●  ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে দোহারের মাহতাবনগর এলাকার প্রবাসী আবুল হোসেনের বাম চোখে ছানি অপারেশন করা হয় গত মাসে। ওই সময় চোখে ইংল্যান্ডে তৈরি ইন্ট্রাঅকুলার লেন্স লাগানোর কথা বলে তার কাছ থেকে এ বাবদ নেয়া হয় ৯ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া ওষুধ ও অন্যান্য খরচসহ তার কাছ থেকে নেয়া হয় মোট ৩২ হাজার টাকা। একই উপজেলার পুষ্পখালি গ্রামের খোদেজা বেগম ঢাকার অন্য একটি হাসপাতালে ছানি অপারেশনের জন্য আসেন। ওই হাসপাতালে তার স্বজনদের কাছে এ বাবদ দাবি করা হয় ৩০ হাজার টাকা। পরে তিনি দোহারেরই একটি হাসপাতালে চোখের অপারেশন করাতে যান। সেখানে তার কাছে এজন্য চাওয়া হয় ১২ হাজার টাকা। পরে স্থানীয় একটি চক্ষু শিবির থেকে ছানি অপারেশন করান ৪ হাজার টাকায়। দেশে বিশেষ করে রাজধানীর চক্ষু হাসপাতালগুলোয় চোখের চিকিৎসায় ব্যবহৃত লেন্স বিক্রি হচ্ছে অস্বাভাবিক দামে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গেও এ দাম কোনোভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

লেন্সের মূল্য ও মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মূলত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। অথচ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ। ফলে চোখের চিকিৎসায় আর্থিকভাবে ঠকছেন রোগীরা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে দেড় হাজার জনের চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর চোখের ছানি অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে ২৪ লাখ জনের। এদের সবারই ছানি অপারেশনের পর চোখে লেন্স বসানোর প্রয়োজন পড়ে। রোগীদের কাছে এখন এসব লেন্স বিক্রি হচ্ছে অস্বাভাবিক মুনাফায়। অথচ লেন্সের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবার তথ্য অনুযায়ী, পাওয়ার ও গ্রুপ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটি ইন্ট্রাঅকুলার লেন্সের মূল্য সর্বনিম্ন দেড় থেকে সর্বোচ্চ ৬০ ডলার। সে হিসাবে ডলারপ্রতি বিনিময় হার ৮০ টাকা ধরে প্রতিটি লেন্সের মূল্য পড়ে ১২০ থেকে ৪ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া আমদানিতে ভ্যাট-ট্যাক্স রয়েছে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। একই সঙ্গে অন্যান্য খরচ বাবদ আরও ১০ শতাংশ ধরে প্রতিটি লেন্সের মূল্য হওয়া উচিত ১৬২ থেকে ৬ হাজার ৪৮০ টাকা। কিন্তু বাজারে এসব লেন্স বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ১৭ হাজার টাকায়।

রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট এলাকার ইন্ট্রাঅকুলার লেন্স ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তাদের কাছে ভারত, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চোখের লেন্স রয়েছে। পাওয়ার ও গ্রুপভেদে ভারতীয় প্রতিটি লেন্স তারা বিক্রি করছেন ২৮০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া নেদারল্যান্ডসের লেন্স ২ থেকে ৫ হাজার টাকায় ও যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালকন কোম্পানির লেন্স বিক্রি হচ্ছে ৮ হাজার ৮০০ থেকে ১৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে বাজারে এ মুহূর্তে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৮ হাজার টাকা মূল্যের লেন্সগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, অপারেশনের সময় লেন্সের মূল্য এককভাবে নয়, বরং প্যাকেজ হিসেবে ধরা হয়। তবে গরিব রোগীদের জন্য বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কম দামে লেন্স সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, চোখ অপারেশনের বিষয়টি মূলত টেকনিকের বিষয়। যার যত বেশি টেকনিক জানা রয়েছে, তার ফি তত বেশি। তবে এটি রোগীর পছন্দের ওপর নির্ভর করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্লিনিক বা হাসপাতালের মালিক, কর্মকর্তা, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী ও দালালের কমিশনের কারণে চোখের চিকিজসায় ব্যবহূত লেন্সগুলোর দাম বেশি ধরা হয়। যেসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চোখের লেন্স লাগানো হয়, সেখানে প্যাকেজ মূল্যের ভেতরেই লেন্সের দাম ধরা হয়। এ দাম নির্ধারণ করা হয় হাসপাতালের ধরন ও মান অনুযায়ী। বড় একটি হাসপাতালে চোখের লেন্স বসালে রোগীদের ব্যয় লাখখানেক টাকা ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া মাঝারি মানের হাসপাতালগুলোয় এ বাবদ ব্যয় দাঁড়ায় ৪০-৬০ হাজার টাকায়। অন্যদিকে সাধারণ মানের হাসপাতালের ক্ষেত্রে এ ব্যয় ২৫-৩৫ হাজার টাকা।

বেসরকারি একটি ক্লিনিকের স্বত্বাধিকারী জানান, চোখের অপারেশনের যন্ত্রপাতি উচ্চমূল্যের। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, ভবন ভাড়া, চিকিৎসকের কমিশন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন হিসাব করে একটি প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। চোখের লেন্স আমদানিকারক খলিল আহমেদ জানান, চোখের পাওয়ার ও গ্রুপ অনুযায়ী নেদারল্যান্ডস থেকে আনা প্রতিটি লেন্স তিনি ২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। এছাড়া ভারতীয় লেন্স বিক্রি করছেন ২২০ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে। দেশে লেন্স আমদানিতে একসময় কোনো অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল না। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চোখের লেন্স আমদানিতে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করে দেয় গত বছর থেকে। আমদানিতে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করলেও লেন্সের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকাই রাখছে না অধিদপ্তর। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, অধিদপ্তর চোখের লেন্সের বিষয়টি দেখভাল করছে স্বল্প সময় ধরে। এগুলোর আমদানিকারকরাও রেজিস্ট্রেশন শুরু করেছেন বেশি দিন হয়নি। লেন্স আমদানির জন্য যারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন, তাদের মূল্য নির্ধারণও করে দেয়া হচ্ছে। তবে বর্তমানে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বিষয়টির দেখভাল করছেন।অন্যদিকে চোখের ছানি অপারেশনের ফি লেন্সের দামের ওপর নির্ভর করে না বলে জানান জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের রেটিনা বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাগ। তিনি বলেন, লেন্সের মূল্যের ওপর নয়, মূলত মেশিনের দামের ওপর নির্ভর করে ছানি অপারেশনের ফি নির্ধারণ করা হয়। এসব মেশিনের কোনোটির দাম রয়েছে ৩০ লাখ থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে। এছাড়া লেন্সেরও মূল্য রয়েছে ২০০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *