আকাবির- আসলাফের উসুলের বিপরীতে চলছে কওমী মাদরাসা

আকাবির- আসলাফের উসুলের বিপরীতে চলছে কওমী মাদরাসা

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

কওমী মাদরাসা হল সর্বজনীন। সবার জন্য উন্মুক্ত। ধনী- গরীব সব ধরনের পরিবারের সন্তানেরা সেখানে অতি সহজেই দ্বীন হাসিল করতে পারে। নির্বিঘ্নে সকল ফ্যামিলির ছেলে- মেয়েরা ইলমেদ্বীন হাসিল করে পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমনই এক চিন্তা- চেতনা নিয়েই কিন্তু কওমী মাদরাসার অগ্রযাত্রা। সেই দুইশত বছর ধরে ওই ধরনের মানসিকতা নিয়ে চলে আসছে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে কিছু কিছু মাদরাসার পরিচালনা কমিটি ও কর্তৃপক্ষের কারণে কওমী মাদরাসা আর সর্বজনীন থাকছেনা। মাদরাসাওয়ালাদের অনৈতিক নিয়মকানুন সাধারণ ছাত্রদের উপরে জগ্দল পাথরের মত চেপে আছে। কেউ এখন অতি সহজে কওমীতে পড়তে পারছে না। বিশেষ করে কিছু মানুষ কওমী মাদরাসাকে বিজনেস সেন্টার বানিয়ে ফেলেছে। বছরের শুরু থেকে ভর্তি বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা এবং অসামঞ্জস্য ভাবে শিক্ষার্থীদের থেকে বেতন উত্তোলনের মাধ্যমে বহু ইলমপিপাসু দ্বীন ইসলাম থেকে মাহরুম হচ্ছে। ইলম হাসিলের প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তারা ইলম শিখতে পারছেনা। মাদরাসাওয়ালাদের এমন বোঝা চাপানোর দরুন ইচ্ছে থাকলেও পারছেনা তারা। আস্তে আস্তে কওমী মাদরাসা এখন ব্যক্তি বিশেষ এর রাহুগ্রাসে বন্দী হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় মজার ব্যাপার, দারুল উলুমে পড়লে মাসিক ওজিফা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীকে মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এটা কি কল্পনা করা যায়?

অথচ কওমী মাদরাসা সবার। পুরো দেশের জনগণ যেন অতিসহজে ইলম হাসিল করতে পারে তার জন্যই তো কওমী মাদরাসা। আজও দারুল উলুম দেওবন্দে গেলে দেখা যায় তার কিছু নমুনা। যারা ছাত্রদের জন্য সকল ধরনের সুযোগ- সুবিধা উন্মুক্ত রেখেছেন। যাতে করে ইলমপিপাসু ছাত্ররা দ্বীনি ইলম থেকে মাহরুম না হয়। সকলেই যেন অতিসহজে ইলম শিখতে পারে। একটি গরীব ফ্যামিলির সন্তানও যেন ইলম থেকে মাহরুম না হয়, সেরকম বন্দোবস্ত তারা করে রেখেছে।

দারুল উলুমে এখনো ইমদাদী ( ফ্রি) খানা চালু রয়েছে। মেধাবী ছাত্রদের ফ্রি খাবার, মাসিক তানখা বা ওজিফা, কিতাব বিতরণ, স্পেশাল কামরা বরাদ্দ, শীতকালে শীতবস্ত্র, পরীক্ষায় অংশগ্রহণবাবদ বিশেষ ওজিফা, রেশন পদ্ধতি, দূরের ছাত্রদের ট্রেনে যাতায়াত এর টিকেট কন্সিশন এর ব্যবস্থা এমন বহু সু্যোগ সুবিধা রয়েছে। সবচেয়ে বড় মজার ব্যাপার, দারুল উলুমে পড়লে মাসিক ওজিফা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীকে মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এটা কি কল্পনা করা যায়?

দেওবন্দ মাদরাসাতে এখনো ভর্তি ফিস নেই। শুধুমাত্র নামমাত্র ফরমের দাম রাখা হয়।( ১৯৯৬ সনে ৫০ পয়সা ছিল) দারুল উলুমের কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের দ্বীনি ইলম শেখার ব্যাপারে এরূপ বহু সুযোগ তারা রেখেছেন।

দারুল উলুম দেওবন্দের প্রেরণায় আমাদের এদেশেও কওমী মাদরাসার গোড়াপত্তন শুরু হয়। দারুল উলুম হাটহাজারী, জামেয়া ইউনুসিয়া, বিবাড়িয়া, জামেয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ, ঢাকার বড়কাটরা, লালবাগ, যাত্রাবাড়ি, ফরীদাবাদ, মালিবাগ এরকম বহু দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দেওবন্দের অনুকরণে গড়ে ওঠে। দারুল উলুমে যেভাবে সুযোগ- সুবিধা দেওয়া হয়, অনুরূপ না পারলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেওবন্দের অনুকরণ করতেন এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধরগণ।

যেমন আমি শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ( রহ,) এর নিকট থেকে শুনেছি, লালবাগ মাদরাসার শুরু এর জামানায় উত্তরবঙ্গের ছাত্রদের বিশেষ ছাড় দেওয়া হত। কেননা সেসময়ে উত্তরবঙ্গে তেমন কোন আলেম পাওয়া যেতনা। তাই রাজশাহী, রংপুর,দিনাজপুর,পাবনা এসব অঞ্চল থেকে কেউ লালবাগে পড়তে আসলে তাকে আর ফেরত দেওয়া হতনা। ছাত্র যেমনই হোক, ভর্তি করে নেওয়া হত এবং নানান সুযোগ- সুবিধার ব্যবস্থা থাকত।। ওইসকল আলেমদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে উত্তরবঙ্গের মানুষের মাঝে দ্বীন পৌঁছায়। সেখানে যেন দ্বীন ইসলামের প্রচার – প্রসার ঘটে।

আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ ( রহ,) কে দেখেছি, গরীব এবং মেধাবী ছাত্রদের বিশেষ নজর দিতে। তিনি যৎ সামান্য বেতন – ভাতা পেতেন, তা থেকে গরীব ছাত্রদের দান করতেন, যাতে দ্বীনি ইলমের ব্যাপক- প্রচার – প্রসার ঘটে। আমাদের আকাবির আছলাফগণ দ্বীন ইসলামের প্রসার ঘটানোর জন্য লিল্লাহিয়্যাত কাজ করেছেন। নিজের ত্যাগ ও কোরবানির মাধ্যমে দ্বীনি ইলমের প্রসার ঘটিয়েছেন। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে নিয়ে এ সিলসিলার সকল বুজুর্গানেদ্বীন ইলমের ব্যাপক প্রচার- প্রসারের জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করেগেছেন তারা।

বছরের শুরুতে ঢাকা শহরের একটি কওমী মাদরাসাতে ভর্তি হতে ১৫০০০/ থেকে ২০,০০০/ টাকা ব্যয় হয়।


বড় পরিতাপের বিষয়,শত শত বছরের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে কওমী মাদরাসা থেকে। এখন আর কওমীতে সেই লিল্লাহিয়্যাত কাজ করার মত কেউ নেই। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্টান এখন গলা কাটছে ইলমপিপাসুদের। বছরের শুরু থেকেই মোটা অংকের ভর্তি ফিস, প্রতিটি সেশনে মোটা অংকের টাকা নেওয়া হয় ছাত্রদের থেকে।

ঢাকা শহরের অধিকাংশ কওমী মাদরাসাতে এখন মোটা অঙ্কের ভর্তি ফিস। বছরের শুরুতে ভর্তি ফিস, খোরাকীর টাকা, কিতাব ক্রয়, কাপড়- চোপড়, বিছানাপত্র এরকম একসঙ্গে বহু টাকার প্রয়োজন পড়ে। তাতে দেখা যায়, বছরের শুরুতে ঢাকা শহরের একটি কওমী মাদরাসাতে ভর্তি হতে ১৫০০০/ থেকে ২০,০০০/ টাকা ব্যয় হয়।

অথচ ওই সকল মাদরাসাওয়ালা ছাত্রদের থেকে ভর্তি ফি কম রাখলেও পারে। সেসব প্রতিষ্টানের আর্থিক অবন্হা একদম খারাপ নয়। তারপরেও ছাত্রদের উপরে চাপানো হয় জুলুমের খড়গ। বহু অভিভাবক নিরবে সহ্য করেন আর চোখের পানি ফেলেন। অথচ দেওবন্দী ধারার এসব প্রতিষ্টানগুলোর কাছে অভিভাবকগণ জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ওর থেকে বের হওয়ার যেন কোন রাস্তা নেই।

সবচেয়ে খতরনক হলো, প্রাইভেট কওমী মাদরাসা, প্রাইভেট হেফজখানা, প্রাইভেট মহিলা মাদরাসা। ওরা গার্জিয়ানদের পকেট কাটে সারাবছর। দ্বীনি ইলম শেখানোর নামে কোচিং সেন্টারের মত বাণিজ্য করে যাচ্ছে। আগে শুধু কোচিং বাণিজ্যের কথা শুনতাম, কিন্তু এখন কিছু প্রাইভেট হেফজখানা, প্রাইভেট মহিলা মাদরাসা ওসব কোচিং সেন্টার থেকে বেশী অগ্রগামী হয়ে পড়েছে।

বড় সমস্যা, ওসব প্রতিষ্টানে কোন ম্যনেজিং কমিটি নেই। মাদরাসার প্রধানই সব। তিনি যা ইচ্ছে তাই করেন। অধিকাংশ প্রাইভেট হেফজখানাতে আকাশছোঁয়া ভর্তি ফিস। সেই সাথে আবার বেতন। এমনি ভাবে খোরাকীবাবদ যেসব শর্তে তারা টাকা নিয়ে থাকেন, তার কোন শর্ত পালন করা হয় না। যেভাবে খাবার দেওয়ার কথা সেভাবে খাবার খাওয়া শয়ানা। আবার ওদিকে রীতিমতো মোটা অঙ্কের টাকা জমা দিতে হচ্ছে গার্ডিয়ান।

মোটকথা বহু অনৈতিক এবং অনিয়মের কথা শোনা যায় এখন কওমীতে। কিন্তু সেগুলো থেকে উত্তরণের কোন চেষ্টা করা হয় না। প্রাইভেট মাদরাসাগুলো এবং কিছু কিছু বড় প্রতিষ্ঠানেও অনিয়ম চলছে। আকাবিরদের উসুলের খেলাফ করা হয় সবসময়। অথচ কওমী মাদরাসা চলার কথা দেওবন্দ এর অনুকরণে। দারুল উলুম দেওবন্দ যেভাবে চলে সেভাবেই চলা উচিত বাংলাদেশের কওমী মাদরাসা গুলো। কিন্তু সেই উসুল আর নিয়ম কেউ মানছেনা। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখন আকাবির – আছলাফের বিপরীতে। যেকারণে এখন আর কওমী নেই। হারিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করেন। আমিন।

( শিক্ষক ও কলামিস্ট)

Related Articles