আবারো সিমান্তে রোহিঙ্গার ঢল!

আবারো সিমান্তে রোহিঙ্গার ঢল!

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে নতুন করে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যকার যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত মংডুর সংঘর্ষে কেঁপে ওঠে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে এপারের সীমান্তের বাড়িঘর। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অন্য দিকে এমন পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে মংডুর রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। নৌকায় করে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের একাধিক চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। এমন শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে নিজ দেশে ফিরিয়ে দিয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। গত বুধবার রাত ও গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নাফ নদী দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালান বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় কয়েকটি সূত্র। তবে এ বিষয়ে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক বা সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, বিদ্রোহী আরাকান আর্মি সম্প্রতি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে সামরিক বাহিনীর ওপর তুমুল হামলা চালায়। শহর রক্ষায় তারাও পাল্টা জবাব দেয়। বিদ্রোহীদের হটাতে জান্তা বাহিনী আকাশ পথে হামলা জোরদার করেছে। ফলে মংডু শহরের সুদাপাড়া, হাদিবিল, নুরুল্লাপাড়া, হাইরপাড়া, মুন্নীপাড়া, সাইরাপাড়া, ফাতনজ, ফেরানপ্রু, সিকদারপাড়া, হাঁড়িপাড়া ও হেতিল্লাপাড়ার বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছেন। তাদের অনেকে বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছেন। ফলে টেকনাফে রোহিঙ্গার পাশাপাশি মিয়ানমার বিজিপি সদস্যদের আবারো অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।


জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, রাখাইনে যুদ্ধের জেরে মংডু ও বুথিডংয়ে ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আটকা পড়েছে। ৮ এপিবিএনের অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আমির জাফর বলেন, কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যুদ্ধ চলছে। সাধারণ রোহিঙ্গারা টিকতে না পেরে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। আমাদের দিকেও আসার চেষ্টা করছেন। তবে আমরা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। সীমান্তের বাসিন্দারা জানান, টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এবং সাবরাংয়ের পূর্বে নাফ নদের ওপারে মংডু শহরের অবস্থান। মংডু শহরের নাফ নদী দিয়ে প্রবেশ পথ খায়েনখালী খালের মোহনায় অনেক রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছেন। টেকনাফ পৌররসভার চৌধুরীপাড়ার নবী হোসেন বলেন, শুনেছি, বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। মঙ্গলবার রাতভর ওপারে গোলাগুলি হয়েছে। বুধবার সকাল থেকেও থেমে থেমে গোলাগুলি হয়।

ফলে বিজিবি বাংলাদেশ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটিঘাটে সাধারণ মানুষের চলাচল বন্ধ রেখেছে। রাখাইনে বিকট বিস্ফোরণের ফলে টেকনাফ সীমান্তের মানুষ ভয়ে আছে বলে জানিয়েছেন পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান। টেকনাফ ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, দুই পক্ষের গোলাগুলিতে অনেক রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্তে আসছে। এপারে আসার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমরা তাদের নিরুৎসাহিত করছি। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে জান্তা ও বিদ্রোহীরা যুদ্ধের নামে নাটক করছে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান রাখছি, মিয়ানমারে সেফজোন গড়ে তোলে রোহিঙ্গাদের সেখানে বসবাসের সুযোগ দেয়া হোক। বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত রয়েছেন।

অসমর্থিত সূত্র মতে, মিয়ানমারে এখনো সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর মধ্যে রাখাইনের বুথেডংয়ে আড়াই লাখ, মংডুতে তিন লাখ এবং বাকিরা আকিয়াবসহ অন্য টাউনে রয়েছেন। বর্তমানে মংডুতে হামলা হচ্ছে। সেখানে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বাস। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

নাফ নদীতে মাছ আহরণ করা একাধিক জেলে ও জেটিঘাটের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নাফ নদীর টেকনাফ জেটিঘাটের শেষের অংশে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ কিছু রোহিঙ্গাকে জড়ো করে রাখেন বিজিবির সদস্যরা। পরে তাদের নৌকাসহ আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, টেকনাফ জেটিঘাট, নাইট্যংপাড়া, দমদমিয়া, শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, নাজিরপাড়ায় নাফ নদীর ওপারে মংডু শহরের নিকটবর্তী সীমান্তে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছেন। সুযোগ পেলেই অনুপ্রবেশের চেষ্টায় রয়েছেন তারা। তবে, রোহিঙ্গারা যাতে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সীমান্ত-নাফ নদীতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি-কোস্টগার্ড। সীমান্ত পরিস্থিতির বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আদনান চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয়দের মাধ্যমে শুনেছি রোহিঙ্গাবোঝাই কয়েকটি নৌকা নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে অনুপ্রেবেশের চেষ্টা করে। আর বিজিবির সদস্যরা তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠান। রাখাইনের ওপারে বিস্ফোরণের শব্দ টেকনাফে এখনো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।’

২ মাস পর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বিস্ফোরণ : এবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত পিলার ৪৮ নম্বর চেলিরটাল ও ৫১ নম্বর পিলার সংলগ্ন পাইনছড়ি সীমান্তের ওপার থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টায় চেলিরটালের বিপরীতে ৮ রাউন্ড, ৬টায় একই এলাকায় ২ রাউন্ড ভারী অস্ত্র বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এর আগের দিন পাইনছড়ির বিপরীতে ২০ রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা। দীর্ঘ ২ মাস পর সীমান্তের এই দুই পয়েন্টে নতুন করে গোলাগুলির আওয়াজে স্থানীয়দের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, ছুরত আলম ও জসিম উদ্দিন জানান, ঈদের ছুটিতে তারা বাড়ি এসেছেন। এরই মধ্যে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় গোলাগুলির শব্দ শুনে তারা কিছুটা ভয় পেলেও পরে এলাকার লোকজনের অভয়বাণীতে তাদের ভয় কেটে যায়। দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে ফুলতলী সীমান্ত সড়কের পথচারী ছুরত আলম ও জসিম উদ্দিন বলেন, তারা সীমান্ত সড়কে বেড়াতে যান। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ৫ মিনিটে ৮ রাউন্ড গুলির শব্দ শোনে তারা। এ কারণে তারা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ফিরে আসে। অপর বাসিন্দা ছৈয়দ নুর ও ফরিদুল আলম জানান, এ সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরে চোরাকারবার হতো। গেল ঈদুল আজহার ১ সপ্তাহ পর থেকে এ পয়েন্টে চোরাকারবার বন্ধ হয়ে যায়। ওপারে রাখাইনে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির সাথে আরএসও সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে মতদ্বৈধতার কারণে বর্তমানে উভয় পক্ষ মুখোমুখী অবস্থানে। এর ফলে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। সূত্র জানায়, সীমান্তে জান্তাবিরোধী সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি আর আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অব অর্গানাইজেশন) এর কমান্ডাররা পরস্পরকে চোরাগোপ্তা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যার কারণে মঙ্গলবার থেকে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটে চলছে। স্থানীয়রা আরো জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তজুড়ে বিজিবি সতর্কাবস্থানে রয়েছে।
সেন্ট মার্টিনে চলাচলকারী ট্রলারে উঁচু করে পতাকা বাঁধার নির্দেশ।

নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সেন্ট মার্টিনে চলাচলকারী ট্রলারে উঁচু করে বাংলাদেশের পতাকা বাঁধতে বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী এ তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিজিবির ১০১তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।

তিনি বলেন, মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও বিদ্রোহী দলের মধ্যে নাফ নদীর তীরবর্তী এলাকায় তুমুল যুদ্ধ চলছে। যখন একটি-দুটি দলের মধ্যে যুদ্ধ চলে তখন এর পাশাপাশি এদিক-ওদিক গোলাগুলি হতে পারে। কিছু গোলা এদিক-ওদিক গেছে, কিছু ট্রলারে গেছে। আমরা মিয়ানমারের দুই পক্ষকে জানিয়েছি, আমাদের ট্রলারে পরবর্তীতে যেন কোনো (গুলির) ঘটনা না ঘটে। তাই আমরা নিশ্চিত করছি, ওই দিক দিয়ে (সেন্ট মার্টিন) যেসব ট্রলার যাবে সেগুলো যেন বাংলাদেশের পতাকা উঁচু করে চলাচল করে। সে ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে না।

তার ভাষ্য, যে কোনো মূল্যে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা ও সীমান্তে নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিজিবি বদ্ধপরিকর। সেন্ট মার্টিনকে কেন্দ্র করে যতটুকু কানে এসেছে কিংবা অনেকেই বলছে, সেগুলো আসলেই গুজব। সেন্ট মার্কিনকে নিয়ে অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করছে অনেকেই। আমি নিজেও সেন্ট মার্টিনে গিয়েছি। সেখানে বিজিবি সদস্যদের সাথে মতবিনিময় করে সাবধান করা হয়েছে।

Related Articles