আয়নাঘর খ্যাত সেনাকর্মকর্তা জিয়াউল আহসান গ্রেফতার

আয়নাঘর খ্যাত সেনাকর্মকর্তা জিয়াউল আহসান গ্রেফতার

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : আলোচিত সেই সাবেক সেনাকর্মকতআ এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) জিয়াউল আহসান গ্রেফতার হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।

গতকাল শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। তাকে একটি হত্যা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

আলোচিত এবং আয়নাঘর খ্যাত জিয়াউল আহসান ছিলেন একজন প্রভাবশালী সেনাকর্মকর্তা। বিগত বছরগুলোতে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ধর্মীয় বক্তাদের দমনপীড়নে তার যোগসাজস রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলের নেতাদের গুম করা, হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক নেতাদের তুলে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে স্থাপিত আয়নাঘরে বছরের পর বছর আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চাঞ্চল্যকর নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের ঘটনায়ও তার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশ ত্যাগের পরদিন গত ৬ আগস্ট আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এর পর থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে পুলিশ রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে বলে জানায়। নিউ মার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে।

জিয়াউল আহসান ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র‌্যাব) দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালের ৫ মার্চ তিনি উপঅধিনায়ক হিসেবে র‌্যাবে যোগ দেন। একই বছর ২৭ আগস্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক হন। ২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে তিনি র‌্যাব ছাড়ার আগ পর্যন্ত অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকার সময় তাকে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) ডিডিজি হিসেবে বদলি করা হয়। পরে তাকে সেখান থেকে এনএসআইর পরিচালক হিসেবে সংযুক্ত করা হয় ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল। ২০১৭ সালে এনটিএমসির পরিচালক হন তিনি। ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক আদেশে এনটিএমসির মহাপরিচালকের (ডিজি) দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে।

অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসান র‌্যাবে দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের গুম এবং ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে তুলে নেয়া এবং পরে তাকে গুম করার পেছনে তার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।

এ দিকে নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা হকার শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় মেজর জেনারেল (অব:) জিয়াউল আহসানকে আট দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত গতকাল শুক্রবার এ আদেশ দেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার এসআই মো: সজিব মিয়া জিয়াউল আহসানকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনে রিমান্ড আবেদন করেন। জিয়াউল আহসানের পক্ষে তার বোন অ্যাডভোকেট নাজনীন নাহার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত তার আট দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

এ দিকে আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। তিনি আদালতে বলেন, এ আয়নাঘর আমার সৃষ্টি না। আমি নির্দোষ। তিনি বলেন, আমাকে স্বেচ্ছায় অবসর দেয়া হয়েছে। আমি কখনো ধানমন্ডিতে যাইনি। এনটিএমসি কেবল ডিজিটালি গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে। আমার নামে আগে কখনো মামলা হয়নি।

শুনানির সময় আদালতে বাদিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ উল্লাহ্ খান জুয়েল বলেন, আজ যে আয়নাঘরের উত্থান, এটার মূল কারিগর এই আসামি। দেশে যত গুম খুন, এর নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ড জিয়াউল আহসান।

এ সময় জিয়াউল আদালতে বলেন, আমি অসুস্থ, আমার হার্টের ৭৯ শতাংশ ব্লক। আমাকে নিয়মিত মেডিসিন নিতে হয়।
আদালতে জিয়াউল আহসান বলেন, যেসব ব্যক্তি আয়নাঘর থেকে বের হয়ে আসছে তাদের কেউ বলুক আমি তাদের সেখানে রেখেছি। যেভাবে আমাকে নিয়ে দোষারোপ করা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়। আমি অসুস্থ। হার্টসহ অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। প্যাগাসাস সফটওয়ারের বিষয়ে আদালত জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্যাগাসাস বলে কিছু নেই। মোবাইল ট্র্যাকিং করিনি।

এ সময় আদালতে জিয়াউলের কথা বলার বিরোধিতা করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। তারা বলেন, তিনি গণহত্যার আসামি। তার কথা বলার অধিকার নেই।

বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের এসব কথার বিরোধিতা করেন জিয়াউল আহসানের বোন অ্যাডভোকেট নাজনীন নাহার। এর মধ্যেই জিয়াউল বলেন, র‌্যাবে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা জিডি হয়নি।

জিয়াউল আহসানের আইনজীবী নাজনীন নাহার আদালতকে বলেন, তার মক্কেল কখনো ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন না। তিনি ‘আয়নাঘর’ (গোপন বন্দিশালা) বানাননি। ফেসবুকে তাকে নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে। গত ৭ আগস্ট বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।

অপর দিকে বাদিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ উল্লাহ খান আদালতকে বলেন, এই জিয়াউল আহসান গুম খুনের নায়ক। তিনি ‘জেনোসাইডে’র সাথে যুক্ত। আয়নাঘরের জনকও তিনি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার ক্রীড়নক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত। সদ্য সাবেক এই সেনাকর্মকর্তা ২০১২ সালের পর থেকে এক যুগ ধরে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণ ও গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এর আগে শুক্রবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে জিয়াউল আহসানকে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিবের আদালতে আনা হয়।
গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশের দোকানের কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়শা বেগম (৪৫) একটি মামলা করেন।
এ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী শাহজাহান আলী নিউ মার্কেট থানাধীন মিরপুর রোডের বলাকা সিনেমা হলের গলির মুখে পাপোশের দোকানে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো গত ১৬ জুলাই সকাল ৯টার দিকে দোকানে যান তিনি। সেদিন সন্ধ্যায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি মামলার বাদিকে মোবাইল ফোনে জানান যে, শাহজাহান আলী গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য শাহজাহানকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে শাহজাহানের লাশ শনাক্ত করেন বাদি।

Related Articles