আরবের দিনলিপি (পর্ব-২)

আরবের দিনলিপি (পর্ব-২)

কাউসার মাহমুদ এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার কবি। শীতের রোদ্দুরের মতন যার কবিতা, ‘একফোঁটা রোদ, একফোঁটা জল’ সে সাক্ষ্য দেয়। তার অনুবাদ যেন জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক,  ‘ঠাণ্ডা গোশত’, ‘মান্টো কে আফসানে’ ‘ দুঃখী কমলা লেবুর দেশ’ এর অন্তর্ভেদী স্বরূপ। বাংলা ও ইংলিশ এর পর ইদানীং আরবী সাহিত্যে তিনি বুদ হয়ে আছেন। দারবিশ, গাসসান কানাফানি ও এ্যাডুনিসের কাব্যের দেয়ালে দেয়ালে অস্থির হয়ে ছুটে চলেছেন৷ তার বই একটি আরেকটির চাইতে ‘আগ্রাসী’ রূপে ধরা দেয়। সৌদি আরব প্রবাসী। নানা রকম অভিজ্ঞতায় আরবের গুজরানো চাক্ষুষ সময়গুলোকে ‘আরবের দিনলিপি নামে’ অক্ষরবৃত্তে তুলে ধরেছেন পাথেয়র টোয়েন্টিফোর ডটকমে’র পাঠকদের জন্য..  

আরবের দিনলিপি (পর্ব- ২)

যা-কিছুই নিয়মিত করার প্রত্যয় থাকে, তাতেই ব্যত্যয় ঘটে। বিশেষত সৃজনশীল কাজকর্মে। এ অবশ্য আমার তুমুল ব্যস্ততার কারণে। তাতে আলস্যের চেয়ে অপারগতাই বেশি থাকে। ফলে যা হওয়ায় তাই হয় আর কি! মানে লিখতে না পারা, রোজ বসতে না পারার যে উশখুশ, যে কিঞ্চিৎ বেদনার উদ্রেক—তাই প্রত্যহ নিদ্রার আগে খুব করে অনুভূত হয়।
যখন চিনচিনে একটা ব্যথা আর পরদিন আরও সংযত ও অধিকতর নিয়মনিষ্ঠ হওয়ার ব্রত নিয়ে চোখ বুজি।

কাজেই গত ছ’দিন ‘দিনলিপি’র এ লেখাটি লিখতে পারিনি যদিও। তবে সারাটা সময় কিন্তু কোনও না কোনও বিষয় ঠিকই মাথায় ঘুরছিল। ভ্রমের মত কিছু একটা কানে গুনগুন করে বাজছিল। যেন অদৃশ্য থেকে ভেসে আসা অপূর্ব এক সঙ্গীত: যার ধ্বনি সময় ও বর্তমানকে স্তব্ধ করে রাখে। কখনও সাঙ্কেতিক কখনও প্রকাশ্যে শ্রবণ ও দৃষ্টিতে গম্ভীর এক ঘোর তৈরি করে। সেই ঘোর ভাঙলে চেয়ে দেখি আরে ইনি তো সঙ্গীত সম্রাজ্ঞাী ফাইরুজ। গাইছেন ‘نحنا والقمر جيران’ ( We and the moon are neighbors)। ওই তো মহান রাবেহ সকার। আপন সুরের মাঝে নিপতিত হয়ে বলছেন, ‘انا والليل والقمره ‘ ( I’M, the night and the moon)। আর যাতে বুঁদ হয়ে আছে সমগ্র আরব। নারী, পুরুষ, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ, তরুণ,তরুণী, মুসলিম, ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, জোরোস্ট্রিয়ানিজম,শিয়াসহ সকলেই।

মূলত আরবি ক্লাসিক্লাল সঙ্গীতে গভীরভাবে যে বিষয়টি লক্ষ্য করেছি, তা ‘কাব্য।’ মানে তাঁদের সঙ্গীতে কাব্যিকতা এমনভাবে ফুটে থাকে, যেভাবে পুষ্পশয্যায় পরস্পর জড়িয়ে থাকে কয়েকটি ফুল। ফলে গানের ভাষাটি হয়ে উঠে আলঙ্করিক ও শ্রুতিমধুর। যাতে সুরের ব্যাঞ্জনায় কথারা হয়ে উঠে আরও জীবন্ত। আরও মনোগ্রাহী। তাই বলতেই হয়,আরব শিল্পীরা তাঁদের গায়কীতে এভাবে কবিদের আপন করে নিয়েছেন, যাতে সঙ্গীত ও কবিতা কোনোদিনই আমার কাছে দূরবর্তী মনে হয় না। বরং তাঁদের সামঞ্জস্যটি এমনই দৃঢ় বন্ধনে সুন্দর, ইতিহাসের বহু মঞ্চই যাদের একসঙ্গে আলিঙ্গন করেছে।

আমাদের ওদিকে, মানে এশীয় অঞ্চলে বোধকরি এই ঘনিষ্ঠতাটুকু খুবই ক্ষীণ। কাজেই সাংস্কৃতিকভাবে শুধু আমাদের কেন বরং পৃথিবীর বহু জনপদের কবি ও সঙ্গীতশিল্পীরাই যেখানে বাহ্যত (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) পরস্পর দুই মেরুর, সেখানে আরবীয় কবি ও শিল্পীদের সম্পর্কটা বুঝি শেকড়ে শেকড়ে। এই হেতু থেকেই বোধকরি আরবি কবিতায় ‘গীতিধর্মিতার’ এমন বলিষ্ঠ প্রভাব। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। বহু আরব সমালোচকই কাব্যে এই গীতিধর্মিতাকে অহেতুক বা খারাপ নির্ণয় করেছেন।

কোনো এক সাক্ষাৎকারে মাহমুদ দারবিশ এ বিষয়ে চমৎকার একটা কথা বলেছেন যে, ‘দেখুন, আরব বিশ্বে এই ভাবমূর্ছনা বা গীতিধর্মিতা নিয়ে বেশ একটা তর্ক আছে।বহু আরব সমালোচকই মনে করেন, এই গীতিধর্মিতা একটি খারাপ ধারণা। অথচ তারা একটি গান ও গীতিময়ী কবিতার পার্থক্যটি দেখে না এবং সেইসাথে গীতিকবিতাকে রোমান্টিক কবিতার সঙ্গেও গুলিয়ে ফেলেন। সুতরাং সর্বদাই আমি এ বিষয়ে জোর দিয়ে থাকি যে, আমি গীতিকবিতা লিখি, তবে তা মহাকাব্যের একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।’

তেমনি আদুনিসের বক্তব্যেও আরব কবি-শিল্পীদের এ মেলবন্ধনের ঐতিহাসিক বিষয়টি আরও প্রগাঢ় হয়েছে। যদিও সে বক্তব্যে তিনি ‘কবিদের নেতা’ বা আমিরুশ শুআরা বলে খ্যাত আহমাদ শাওকির প্রতি একপ্রকার তাচ্ছিল্যই করেছেন। কিন্তু ‘মেলবন্ধন’ বিষয়ে আমার ভাবনাটির যৌক্তিকতা পেয়ে ঠিকই আপ্লূত হয়েছি। তাই যখন তাকে এ প্রশ্নটি করা হয়েছিল যে, ‘We know you are not a fan of Ahmad Shawqi? Do you like to listen to Umm Kulthum when she sings his poems?

জবাবে আরবি সঙ্গীতের রাণী উম্মে কুলসুমের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘Yes, I do because she rewrites them in her voice. What remains is the voice and you forget the redundancy of the weak poetry. Umm Kulthum can transform the ugly into something beautiful. I have definitely grown to be a fan of hers.

সে যাহোক, মূলত আরবদের সঙ্গীতের প্রতি যে মমতা দেখি, তাতে আশ্চর্যই হই। এমনকি এখানে বহু বৃদ্ধকেই চিনি, যারা নিরুপদ্রব থাকতে ভালবাসেন। বিকেলে, সন্ধ্যার পর কিংবা রাত্রি গভীর হলে এখনও তাঁরা চুপচাপ সঙ্গীত শোনেন। যেন রাতের নিস্তব্ধতায় তাঁরা খুঁজে নিচ্ছেন নিজেদের অতীত। শান্ত মরুভূমি মাঝে ছোট্ট তাবু বানিয়ে এখনও তাঁরা দু’একজন নিমগ্ন বসে থাকেন। সামনেই লোহার ক্ষুদ্র উনুন। তাতে টিমটিম জ্বলা আগুনের ওপর বসানো একটি কেতলি। তাতে হয়তো চা কিংবা গাহওয়া। ধৈর্যকে পাশে বসিয়ে সেই উঞ্চ জলেরই অপেক্ষা করে তাঁরা। পাশেই বাজতে থাকে তাঁদের প্রিয় সঙ্গীত৷ সেগুলোর সুর শুনলে কখনও বিষাদে, কখনও আনন্দে, কখনওবা ভাষাহীন গম্ভীর উৎফুল্লতার ভেতর ডুবে যাওয়া যায়। এমতাবস্থাটিকে তাঁদের ভাষায় বলা হয় ‘رَاحَة’ (রাহাহ)।অর্থাৎ ইংরেজিতে আমরা যেটিকে ‘Leisure’ তথা অবকাশ বা বিশ্রাম বলি।

প্রাচুর্যেপূর্ণ আরবদের জীবনে এই অবকাশ যাপন বড় সোজা। আমাদের মত বছরের পর বছর অপেক্ষা, মাসের পর মাস পয়সা জমানোর কোনও প্রয়োজন নেই তাঁদের। ইচ্ছে হলো তো কয়েকজন মিলে কিংবা একাকীই গাড়িটি নিয়ে সোজা মরুভূমি, সমুদ্র, বন কিংবা কোনো জলাশয়ের ধারে চলে গেল। তখন তাঁদের গাড়িতে লাগাতার বাজতে থাকে ফরীদ আল-আতরাশ, উম্মে কলুসমু, ফাইরুজ ও আব্দেল হালীম হাফিজের গান।

৩/১০/২৩

(চলবে..)

লেখক: কবি, গদ্যশিল্পী ও অনুবাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *