আরবের দিনলিপি (র্পব-১)

আরবের দিনলিপি (র্পব-১)

কাউসার মাহমুদ এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার কবি। শীতের রোদ্দুরের মতন যার কবিতা, ‘একফোঁটা রোদ, একফোঁটা জল’ সে সাক্ষ্য দেয়। তার অনুবাদ যেন জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, ‘ঠাণ্ডা গোশত’, ‘মান্টো কে আফসানে’ ‘ দুঃখী কমলা লেবুর দেশ’ এর অন্তর্ভেদী স্বরূপ। বাংলা ও ইংলিশ এর পর ইদানীং আরবী সাহিত্যে তিনি বুদ হয়ে আছেন। দারবিশ, গাসসান কানাফানি ও এ্যাডুনিসের কাব্যের দেয়ালে দেয়ালে অস্থির হয়ে ছুটে চলেছেন৷ তার বই একটি আরেকটির চাইতে ‘আগ্রাসী’ রূপে ধরা দেয়। সৌদি আরব প্রবাসী। নানা রকম অভিজ্ঞতায় আরবের গুজরানো চাক্ষুষ সময়গুলোকে ‘আরবের দিনলিপি নামে’ অক্ষরবৃত্তে তুলে ধরেছেন পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকমে’র পাঠকদের জন্য..

(র্পব-১)

ভাবছি এ শিরোনামে এখন থেকে নিয়মিত গদ্য লিখব। এ ধরণের লেখার সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক এবং যথেষ্ট রাজনৈতিক মূল্য আছে। কারও কারও ক্ষেত্রে যা তাঁর বহু গল্প-উপন্যাসকে ছাপিয়ে পাঠকের জন্য, তাঁর ভাষার মানুষের জন্য অমূল্য সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে। তদুপরি বহু শ্রেষ্ঠ লেখকের দিনলিপিই পরবর্তীকালে প্রজন্মের জন্য, সাহিত্যের পাঠকের জন্য দেদীপ্যমান লণ্ঠনের কাজ দেয়। যেমন, সরদার ফজলুল করীম, মুজতবা আলি, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, জাহানারা ইমামের দিনলিপি, ফ্রিদা কাহলো, সিলভিয়া প্লাথের ডায়ারি, লিওনার্দো ভিঞ্চির নোটবুক কিংবা অন্যান্য শিল্পীদের অসংখ্য জার্নাল।

সেসব রচনার যে সম্মোহন, যে অভিব্যক্তি তা যেন প্রবলভাবে কল্পনাকে উসকে দেয়। অন্য একটা মানুষের জীবন, আচার, যাপন এবং সর্বোপরি ভাবনার ভেতর ঢুকে যাওয়ার এই যে এক রোমাঞ্চএর কি কোনো তুলনা আছে? তাই সঙ্গত কারণেই আপাতত এই কর্মে ( অনেক অনেক পড়া ও দৈনিক অল্পেকটু দিনলিপি লেখা) নিজেকেও নিবেদিত করলাম।

মূলত একজন লেখকের সবচেয়ে স্পর্শকাতর যে বিষয়টি থাকা লাগে, তা মনে হয় উপলব্ধিবোধ। চিন্তা ও দৃষ্টির প্রাবল্যতায় দৃশ্যটাকে আয়ত্ত করতে পারা। ভার্জিনিয়া উলফ যেমন বলেছিলেন, লিখনের মূল কথা হল ‘getting the rhythm’ ছন্দটিকে ধরা। সে হিসেবে আপনার ভেতর যদি শিল্পীসত্তার যেকোনো একটি রেণু থাকে, অবচেতনই আপনি বিচিত্র দৃশ্যের মুখোমুখি হবেন। জনসাধারণের চোখে দেখা ঘটনাটি আপনার কাছে রহস্যপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে। একটি স্বাভাবিক চিত্র আপনার ভাবনায় অপূর্ব ও উদ্বিগ্ন দু’ভাবেই এসে জড়ো হতে পারে। আমার মনে হয়, এই বোধটুকু আমার আছে। মানে লেখনীর যে শক্তি তার কিঞ্চিৎ উপলব্ধি প্রভু আমাকে দান করেছেন। তার ওপর যেহেতু প্রবাসে আছি, এ-র ফলে রোজ বিচিত্র মানুষ, আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা আর বিবিধ সংস্কৃতির সম্মুখীন হতে হয়—একজন শিল্পীর জন্য যা আরাধ্য। কেননা, নিমগ্নতা যদি লেখকের অপরিহার্য হয়, তবে প্রভূত বিষয়ে দৃষ্টিপাত তাঁর নিমগ্নতার প্রাণ। এ-ই হেতু আজ থেকে প্রত্যহ ‘দিনলিপি’ লেখার মনস্থ করলাম। যেন অপরিচিত একটা জীবনকে খাতাবন্দী করে ফেলতে পারি। যেখানে প্রায়শই জেগে উঠে দুশ্চিন্তা, হতাশা, ঈষৎ আনন্দ, অবসর, নির্জনতা কিংবা দীর্ঘদিন একাকী বসে বসে নিঃশব্দ পাঠ।

‘এই দূরদেশে মনস্তাত্ত্বিক যে যুদ্ধ আমি করেছি, বারবার নিজের দৃঢ়বদ্ধ সংকল্পের গতিপথ যেভাবে পাল্টেছি, তার ফলে বহুবার যে করুণ বিষন্নতার কাছে আনত হয়েছি’

এই যেমন গত নয় দিনে হেরমান হেসের ‘সিদ্ধার্থ’, ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘হাত বাড়িয়ে দাও’, সানজু’র ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ চিন্ময় গুহের ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ এবং জীবন বাবুর (জীবনানন্দ দাশ) ‘বেলা অবেলা কালবেলা’সহ পাঁচটা বই পড়েছি। কাহলিল জিবরানের ওপর প্রায় দু’হাজার শব্দের একটা মৌলিক রচনা ও দুটো কবিতা লিখেছি। নতুন যা-কিছু পড়ব তার নোট নিয়েছি। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো খুব সাধারণ ঘটনা হলেও, একজন নিঃসঙ্গ নির্জন মানুষ জানে এর মূল্য কী! আমার ভেতরে কী চলে, চিন্তায় কী সব অদ্ভুৎ কল্পনা ঘোরাফেরা করে, কীভাবে তারা আমায় দিনের পর দিন পীড়ন করে—বহু ভেবে এর যথোপযুক্ত যে সমাধানটি বের করেছি তা হল: ধারাবাহিক এ রচনা।

কেননা বিগত পাঁচ পাঁচটা বছর এই দূরদেশে মনস্তাত্ত্বিক যে যুদ্ধ আমি করেছি, বারবার নিজের দৃঢ়বদ্ধ সংকল্পের গতিপথ যেভাবে পাল্টেছি, তার ফলে বহুবার যে করুণ বিষন্নতার কাছে আনত হয়েছি—এর প্রধান কারণটি নিশ্চয় আমার বিচ্ছিন্ন মনোযোগ। যেমন কয়েকমাস টানা বই পড়ছি তো পরের পনেরো দিন অন্যভাবে জীবনকে সজাগ করতে উঠেপড়ে লেগেছি। ইন্টারনেটের অন্তর্জালে সাফল্যের নানা মন্ত্র দেখে দেখে কখনও কখনও দিকশুন্য পথিকের উদভ্রান্ত দৃষ্টির মত এদিকসেদিক দৌড়েছি। এটা-ওটা করার নানা প্রত্যয় নিয়ে বহু রাত বিনষ্ট করেছি। কিন্তু শেষাবধি দেখা গেছে, সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে, অজস্র পথঘাট পেরিয়ে আবার আমার এই বইপত্র, লেখালেখি ও কবিতার কাছেই ফিরতে হয়েছে। সুতরাং খুব ভালোভাবেই একটা ব্যাপার হৃদয়ঙ্গম করেছি যে, অর্থকড়ি হয়ত একদিন চলে আসব, কিন্তু প্রচেষ্টা ও নিবেদন ছাড়া কোনোদিন যা আসবে না তা হল আর্ট। নির্দিষ্ট করে বললে, ‘আমার ভালো লেখাটা।’

(চলবে…)

কবি, গদ্যশিল্পি ও অনুবাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *