আরবের দিনলিপি-৮

আরবের দিনলিপি-৮

  • কাউসার মাহমুদ 

ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে। ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ।’ আল মাহমুদের আত্মজৈবনিক রচনার এই বইটি অর্ধযুগ আগে পড়েছিলাম মনে পড়ে। কিন্তু আজ যখন একটি আয়নার ভগ্নাংশের সামনে দাঁড়িয়ে, পরম মমতায় নিজের মুখের দিকে তাকালাম—তখন বিবিধার্থের মত কেবল ওই শিরোনামটিই মনে আসছিল। মনে হচ্ছিল এদ্দিনে জীবনের দীর্ঘ একটা পথ পারি দেয়া হয়ে গেছে। জীবনের প্রতি যে আকুল আকাঙ্খা জেগেছিল মনে, তার কিছুকিছু কীভাবে যেন ক্ষয়ে গেছে। কীভাবে যেন আমার কালো গোঁফদাড়িতে ঈষৎ লালিমা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঋতুর পালাবদলের প্রাক্কালে গোধুমের দু’একটি উজ্জ্বল শীষের মতই গালের এপাশে-ওপাশে কয়েকটি লাল শ্মশ্রু উঁকি দিচ্ছে। তাতে কিয়ৎকাল সত্যিই নির্বাক হয়ে ছিলাম। যেন সেখানে মিশে ছিল অতিক্রম করে আসা একটা কৈশোরক জীবন। সম্মুখেই অপেক্ষা করছিল রাশভারি মনোভাব।

বুঝি স্বপ্নের মতই মুহুর্তে একটা পর্যায় থেকে আরেকটা পর্যায়ে উন্নীত হলাম। দর্শনের মত জটিল বোধেরা এসে জড়ো হল মাথায়। ভাবছিলাম, মাত্রই সাতাশে আমি। অথচ, এমন দুঃসহ এক যাত্রার নাবিক হয়েছি। যাতে সমূহ স্বাভাবিকতা পেছনে পড়ে গেছে। ঠিক ওই কিশোরীর মত। ‘পেহচান’ গল্পে মান্টো যার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে, ‘মগর উস কে চেহরে ছে মা’লুম হো-তা থা কে ওহ আপনে জিসম্ কো পিছে চ্ছোর কর বহুত আ-গে নিকাল চুকি হে, বহুত আ-গে যা-হা শায়েদ উস-কি মা ভি নেহি পহন্চ সাকি। জো বাহার আঁগ মে চুলহা জোঁঙ্ক রাহি থি।’

মাঝেমাঝে ভাবি, আমিও কি অনেক বয়সের ভারকে পেছনে ফেলে আসিনি? অভিজ্ঞতার নামে যে অমূল্যের কথা বলা হয়, আমি কি তা এখনই অর্জন করে ফেলেনি? প্রায়শই মনে হয়, এই শব্দটিকে মহান করে তোলার কিছু নেই। কেবলই পণ্ডিতদের সাথে এর সংযোজন—অন্যায় ৷ কেননা, বিদ্বান হয়ে দীর্ঘ একটা জীবন পারি দেয়ার পরই যে কেউ অভিজ্ঞতালব্ধ হয়, ব্যাপারটি সেরকম নয়। বরং বাস্তব জীবনের রাস্তায় সমূহ সঙ্কট মোকাবেল করে, বিচিত্র মানুষের নানাবিধ অযাচিত আচরণ উপেক্ষা করে যারা বেঁচে আছি, যারা নিজের রোদনকে গলাধঃকরণ করে নিশ্চুপ হেঁটে চলি—আমাদের দৃঢ়তার কাছে, বেঁচে থাকার নির্মমতার কাছে, জীবনের পরীক্ষাগত সমস্ত অভিজ্ঞতাই নস্যি।

সামান্য অর্থের জন্য যে সংগ্রাম করছি, এর সমাপ্তি আছে তো? এসব ভাবনার নির্দিষ্ট গণ্ডিটা বুঝতে পারলে শান্তি পেতাম। যদি জানতাম এতদিন পর, এত বছর পর সঙ্কটগুলো শেষ হবে, প্রয়োজনগুলোর নিষ্পত্তি হবে—তাহলে একটু প্রবোধ পেতাম।

আহা! কী এক জীবন এই। বিস্মরণের মত যা আহত করে। কোনোরূপ গত্যন্তর না পেয়ে, আমার কাছেই যা ফিরে আসে। যেন আমি এক ত্রানকর্তা। বেদনার ভাঁড়ারের পাহারাদার। আমার স্মরণের কাছে সকলেই আসা যাওয়া করে। শোভাযাত্রা থেমে আবার পথ চলে। আনন্দ বিছিয়ে ধরে আমার রাজপথ। তবু কারও হৃদয়ের কাছে জায়গা পাই না। অন্তহীন এই যাত্রার শেষ দেখি না। তাই বুঝি এতকাল নিজের চিবুকের দিকেও তাকাতে পারি নি। একটা পলক নিবদ্ধ করে যে নিজের মুখটা দেখব—সে ফুরসুতও হয়নি। ফলে আজ যখন নিজের বিধ্বস্ত চোখের নিচে তাকালাম, আয়নায় লাল হয়ে যাওয়া দাড়ি ক’টি দেখলাম, মনে হল বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছি। হায়! এখনও তিরিশ অতিক্রান্ত হয়নি। অথচ, ভাবনারা বৃদ্ধ’কে ডাকছে। বহু ভেবে এর যে কারণটা আবিস্কার করেছি, তা শোক। জরা। অক্লান্ত নিনাদ। প্রবাসের এই দুঃসহ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ও বাঁকেই যা দুর্দম্য প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তা ভেদ করে কবে যে ভাবনাহীন, তাড়নাহীন
একটা খোলা মাঠে এসে দাঁড়াব—জানি না।

আদতে অধিক সন্তপ্ত করে তোলে এই ‘না জানা।’ সীমার অজ্ঞতা। জানি না কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। কবে শেষ হবে এই যুদ্ধ। আদৌ কি নিজের প্রিয় বিষয়গুলোতে নিমগ্ন হতে পারব? যা করতে ভালোবাসি, যা বলতে ভালোবাসি, শিল্পের যে আরাধনা করতে চাই—কোনোদিন তাতে আবিষ্ট হতে পারব কি? সামান্য অর্থের জন্য যে সংগ্রাম করছি, এর সমাপ্তি আছে তো? এসব ভাবনার নির্দিষ্ট গণ্ডিটা বুঝতে পারলে শান্তি পেতাম। যদি জানতাম এতদিন পর, এত বছর পর সঙ্কটগুলো শেষ হবে, প্রয়োজনগুলোর নিষ্পত্তি হবে—তাহলে একটু প্রবোধ পেতাম। কিন্তু হায়! প্রত্যহ ভোরে একই দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে সেই যে জীবনের দিকে দৌড়াই—তার কোনো সীমানা দেখি না। মূলত এটিই আহত করে। এটিই সর্বদা উদ্বিগ্ন রাখে। কেননা গন্তব্যহীন যাত্রার যেমন অন্ত নেই, তেমনি একটা সময় পর সঙ্কটগুলো শেষ হবে; এই সীমানা যদি অজানা হয়ে থাকে—তাহলে বেঁচে থাকা ক্রমাগত কঠিন ঠেকে। জোঁকের মত হতাশারা কামড়ে ধরে।

তবুও আহত যোদ্ধার মত বারংবার উঠে দাঁড়াই। বিষের নীলে নিস্তেজ হয়ে কখনও পড়ে থাকি। কখনও হাহাকার করে উঠি। কখনও মরে যেতে চাই। কখনও সকল দায়িত্ব ছুঁড়ে ফেলে ভ্রষ্ট অশ্বের মত দুচোখ যেদিকে যায়, ছুটতে চাই। কিন্তু কোথাও হয় না যাওয়া। এসবের কিছুই হয় না করা। বরং নিজেকে প্রতারিত করে আবার সেই তীর্যক একঘেয়েমির জীবনে প্রত্যাগমন করতে হয়।

পরিবার, প্রেমিকা, স্ত্রী, সন্তান, ভালোবাসা ও মাংসের দেয়াল আমাদের মাঝে অবরুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সেসবের দিকে তাকাই। মনে হয়, এইতো সবুজে সবুজে লতিয়ে উঠেছে আমাদের সম্পর্কের দেয়াল। পাখির ঠোঁটের মত আদর বাড়িয়ে দিয়েছে আপনজন। আমরা দুঃখদের ভুলে যাই। কান্নার বদলে আমাদের চোখের ওপর ফুটে উঠে স্বপ্ন। যেসব শ্মশ্রুরা লালিমাভাব ধরেছিল, তা থেকে বিচ্ছুরিত হয় থোকা থোকা জোনাকির আলো।
সে আলোর নীচে নিহত কবির মত জেগে থাকি। দূরদৃষ্টি ভর করে। ভবিষ্যৎ ঘনিয়ে আসে। বহুদূর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। তাতে কল্পনা ভেসে ওঠে। এতকাল ধরে কথার আঘাতে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে থাকা হৃদয়টা নাড়া দেয়। স্নায়ুতন্ত্র পুনর্জীবন লাভ করে। এই পুঁজিবাদী বিশ্বে আমরা যারা যন্ত্রের অনুরূপ, যাদের পদ, পদবী, প্রতিনিধি ও জাগতিক ডিগ্রী নেই, তারা কলের মত ঘুরতে থাকি। অর্থ আমাদের কাছে সার্বভৌম ক্ষমতাপন্ন অধিপতির প্রতিরূপে আবির্ভূত হয়। তার সামান্য পরিমাণের জন্য, যাতে কোনোরূপ প্রয়োজনটুকু পুরো হবে—তাতে যৌবনের দীপ্তিময় লাবণ্যের লোপ কেন, মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করতে পারি।

২৭/১০/২০২৩

চলবে..

লেখক, কবি, বহুগ্রন্থ প্রণেতা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *