আরবের দিনলিপি-৯

আরবের দিনলিপি-৯

  • কাউসার মাহমুদ 

গত পর্বের পর 

ইউরোপের সাম্প্রদায়িক ইতিহাস জানি। তাদের বৈষম্য ও নিম্নবর্গের প্রতি নির্যাতনের কথাও অজানা নয়। বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ সম্বন্ধে খুব একটা অবগত নই যদিও। তবে সৌদির উঠতি তরুণ, যুবা, কিশোর এমনকি সমঝদার শিশুদেরও অধীনস্থ, কর্মচারী এবং শ্রমিক শ্রেণীর ভিনদেশী মানুষের সঙ্গে অধুনা যে আচরণ দেখছি—তা ভীষণ শরমের। দুঃখপ্রদ ও দুশ্চিন্তার। এমনকি আরবীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি, খেলাফত ও ইসলামি রাজতন্ত্রের পূর্ববৃত্তান্তের সঙ্গেও অসমঞ্জস্যপূর্ণ।

এতে আরবের সেই গৌরব, সমতা ও ইনসাফের কথা বড় কল্পনা লাগে। যেসব সাধারণ নিরক্ষর মানুষের এসব জানাশোনা নেই, তাঁরা কুৎসিত ভাষায় এদের ভর্ৎসনা করে। কারণ, নিপীড়িতের তো এটুকু ছাড়া আর কোনও শক্তিও নেই। ভৃত্য ও শ্রমিকশ্রেণির প্রতি আরবদের অতিরঞ্জন দেখে বিস্মিত হই। আহবান, নির্দেশ ও লেনদেনে বঞ্চনার স্বীকার হতে হয়। তাতে নিজেকে অসহায় ও ছোটলোক ভাবা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। অধিকন্তু এ আচরণ শুধু যে একটা বয়সী বা একজাতীয় স্বভাবের লোকদের পক্ষ থেকে তা নয়। লক্ষ্য করেছি, এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব কেমন যেন তাঁদের অধিকাংশকেই গ্রাস করে রেখেছে (বিশেষত উপশহর ও গ্রামাঞ্চলে)। এর কারণ, বয়স ও স্বভাবের তফাৎকে উপেক্ষা। অর্থাৎ, পিতা -পুত্রের সামনে, ভাই-ভাইয়ের সম্মুখে এবং পৌত্র, দৌহিত্রের উপস্থিতিতেও একইরকম রূঢ় আচরণ করছে। প্রকৃতিগতভাবেই যা কনিষ্ঠরা গ্রহণ করে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে উপভোগও করে। ফলে দেখা যায়, বড়দের সঙ্গে কোথাও বেরুলে, বড়রা তো করেই, শিশুরাও ভিনদেশী কর্মীদের অযাচিত নির্দেশ দিয়ে বসে। কটু কথা বলে। উপরন্তু দু’কথা জবাব দিলে বা কিছু বিলম্ব হলে গালিও দেয়। এদের বয়সের কথা যদি ধরি তাহলে অধিকাংশই পাঁচ থেকে দশ-বারো বছরের।

তেমনি যেসব উচ্ছৃঙ্খল কিশোর, যুবা বা নাকউঁচু স্বভাবের বয়স্ক আছে, তাদের থেকে তো সন্ত্রস্তই থাকতে হয়। কখনও দেখা যায়, কাজ করিয়ে বিনিময় না দিয়ে চলে গেল। চুক্তির পর কাজ শেষে কম অর্থ ধরিয়ে দিল। তা গ্রহণ না করলে বা প্রতিবাদ জানালে আচ্ছামত বাবা-মা তুলে গাল শোনাল৷ তার ওপর হাত তুলতেও কিঞ্চিৎ দ্বিধা করবে না। এ একটা বিষয়: পৃথিবীতে আমি যা মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। তা অন্যের ওপর হাত উঠানো৷ অর্থাৎ, অনেক তর্ক হতে পারে, কিন্তু প্রতিপক্ষ দুর্বল হলেই যারা হাত উঠায়— আমার চোখে তারা সবচেয়ে নিচু জাতের৷ কুৎসিত মনোভাব ও জঘন্য প্রকৃতির লাগে। কিছুকিছু আরব সেই প্রকৃতির।মানে ওরা হাজারটা গাল দেবে। স্বর উচ্চগ্রামে তুলে আশপাশে নিজের বীরত্ব প্রদর্শন করবে। কিন্তু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যখনই আপনার কণ্ঠটা একটু উঁচুতে তুলবেন, অমনি তার সমস্ত ইজ্জত যাবে। পুরুষত্ব ভেঙে পড়বে। লা তানফুত, লা তানফুত ইয়া হাইওয়ান ( এই চেঁচাবি না জানোয়ার) বলে অন্যদের সম্মুখে আপনাকে নাস্তানাবুদ করা ছাড়া তার যেন নিস্তার নেই।

বস্তত জীবনের একটা পর্যায়ে প্রতিটি মানুষই তার সময়ের মূল্য বুঝতে পারে। তবে সৌভাগ্যবানদের এই উপলব্ধিটা হয় দ্রুত। এক্ষেত্রে নিজেকে কোন কাতারে ফেলব?

অসংখ্যবার লক্ষ্য করে দেখেছি, চরিত্রের এই বড়ত্বভাব বজায় রাখতে ওরা কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করে না। কেউ কেউ তো খুনও করে ফেলে। করে ফেলে কী! এমন ঘটনা সংখ্যায়ও গোনা যাবে। মানে চরিত্রের এই দিকটি যদি খুলে বলি তা এমন যে, নিজেদের উচ্চতা বজায় রাখতে ঘটনার সূত্রপাত, এর ফলাফল কিংবা দোষী-নির্দোষী নির্ণয় না করে কেবলই বাহ্যত দিকটিরই বিচার। তথা সে যা বলছে তাই সঠিক। অনারবী যার সঙ্গে বিতণ্ডা হয়েছে, কোনোক্রমেই সে ঠিক হতে পারে না। এখন ভাবুন! মনস্তাত্ত্বিকভাবেই যখন আপনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখেন, তখন এর ফলাফল কী দাঁড়াবে? এজাতীয় অসংখ্য গল্পের বিবরণ দেওয়া যাবে। অজস্র মর্মভেদী ঘটনা তুলে এনে আখ্যান তৈরি করা যাবে। শুনতে নিশ্চিতভাবেই যা আপনার অবিশ্বাস্য মনে হবে। কিন্তু একবার যদি আসেন। স্বচক্ষে, স্ব-শরীরে একবার যদি এ জীবনযাপন করেন—তাহলেই কেবল এর সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবেন।

তবে হ্যাঁ! এর বিপরীত যে নেই তা নয়। বরং সেসব ভদ্রলোক, ভদ্রসমাজ আর মনোরোম সাক্ষাৎ খুব স্বল্প কিছু মানুষেরই হয়। যারা সৌভাগ্যের পরম্পরায় আসেন। যারা অতিথি হয়ে আসেন। কিন্ত আমি যে বর্ণনা দিয়েছি, সামগ্রিকভাবে প্রবাসী শ্রমিক ও ভৃত্যশ্রেণীর সঙ্গে আচরণটা তেমনই। আল্লাহর শপথ! এ রচনায় একটি বর্ণও কাল্পনিক নয়। একটি শব্দও বানোয়াট নয়। একটি বাক্যও বিদ্বেষ-দোষে দুষ্ট নয়। বরং যে আচরণ, নিম্নবর্গের কর্মজীবিদের সঙ্গে অধিকাংশ গ্রাম্য আরবদের যে চালচলন দেখেছি, তারই বাস্তব চিত্রটি লিখে রাখতে চেয়েছি।
নইলে সামান্য সুখস্মৃতি হলে সেটিও ডায়েরিতে টুকে রেখেছি।

যেমন আগস্টের সাত তারিখের একটি ঘটনা। সেদিন লিখেছিলাম, শায়খ আব্দুল্লাহ বিন সা’দ আল-কাহতানির স্বরচিত কিতাব الخطط الأمنية في السيرة النبوية গত কয়েকদিন আগে তাঁর কাছ থেকেই উপহার পেলাম। সেদিন সকালে কাজে যেতেই পণ্ডিত এই আলেমের সাক্ষাতধন্য হলাম। কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারি মধ্যবয়স্ক এই বিদ্বান ব্যক্তি একজন লেখক। ইসলামি ইতিহাস তাঁর প্রধান গবেষণার বিষয়। ভালোবাসেন কাব্যসাহিত্য। পড়া আছে বিশ্বসাহিত্যের অজস্র চিরায়ত বইপত্র। যেন আলাপের শুরুতেই তাঁর তথ্য, রেফারেন্স, স্বতন্ত্র ভঙ্গি ও যুক্তির সামনে নত হয়ে যেতে হয়। তাই অল্প সময়ে অবচেতনই বোধকরি তাঁর একটা রশ্মি অধিগত হয়েছিল আমার। যা জ্ঞান, সময়, শৃঙ্খলা, আমল ও কর্মময় জীবনের প্রতি অনায়াসে আরও প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

আসলে, আশ্চর্য এক জায়গায় আছি। যেখানে প্রত্যহ নিয়মমাফিক যে একটু বইপত্র নিয়ে বসব, এক-আধঘন্টা লিখব—তা বেশ দুরূহ ব্যাপারই বটে। তাই কখনও খাওয়া, কখনও ঘুম কিংবা নামাজের অবসরটুকুই আরাধ্য। তখন তড়িৎ হাতের কাজগুলো গুছিয়ে একটু পড়তে বসি। মাঝেসাঝে লিখি। বস্তত জীবনের একটা পর্যায়ে প্রতিটি মানুষই তার সময়ের মূল্য বুঝতে পারে। তবে সৌভাগ্যবানদের এই উপলব্ধিটা হয় দ্রুত। এক্ষেত্রে নিজেকে কোন কাতারে ফেলব? তা নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকলেও, এটুকু বুঝি যে, হয়তো সময়নিষ্ঠ হয়েছি। কেননা, প্রচণ্ড পরিশ্রমের মাঝেও বিগত চার বছরে নিজের প্রিয় কাজের প্রতি যে অগাধ টান আর পরম ভালোবাসা উপলব্ধ হয়েছে—তা আমাকে সর্বদাই অবসরে পাঠ কিংবা লেখালেখিতে নিমগ্ন রেখেছে।

যাহোক, মূল কথা হলো : শায়খ আব্দুল্লাহর সঙ্গে যখন জীবনের এই ক্রমাগত ক্লান্তি, ব্যস্ততা, অবসাদ ও জাগতিক কাজের ভারে কুঁজো হওয়া অবসন্ন প্রাণের কথা বলি, তখন মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন তিনি। দূরভাষে যোগাযোগ রক্ষায় ফোন নাম্বার আদানপ্রদান করেন। সেইসাথে বইটিতে একটি অটোগ্রাফও দেন। লিখেন اهداء من المؤلف عبدالله بن سعد القحطاني للأخ العزيز كوثر محمود.

প্রকৃত, যে চাকুরি আমাদের, সেখানে রূঢ় ও ক্রূর আরবদের সঙ্গেই সাক্ষাত বেশি। ফলে যখনই কোনো সুশিক্ষিত, স্নিগ্ধ স্বভাবের অভিজাত আরবের সাক্ষাত পাই, ইচ্ছে করেই নানা বিষয়ে আলাপ জুড়ে দিই। এটা-ওটা জানতে চাই। তাতে কৌলীন্যের অসীম আত্মমর্যাদার সাথে অন্তর্গত কোমল চরিত্রটিরও দেখা মেলে তাঁদের। তাই এ কথা অনস্বীকার্যই যে, দিনের পর দিন যদিও আপনি এই পরদেশে মনক্ষু্ন্ন, বিষন্ন ও ভীষণ দুঃখীটিও হন, তবু কদাচিৎ এমন হৃদয়ার্দ্র আচরণে মুহুর্তের জন্য হলেও আপনার মনটা ভরে উঠবে। যে পেশায়, যে কাজই করুন না কেন, তাতে আরেকটু মনোযোগী হতে সাহায্য করবে। তাছাড়া আমরা তো জানিই, সহাস্য মুখ কিংবা সদাচার— দুটো কর্মই বড় শক্তিশালী। অধিকন্তু ছোঁয়াচের মত এ আপনাকেও ছুঁয়ে যেতে পারে। আপনিও হয়ে উঠতে পারেন কর্মঠ, সদাচারী ও প্রাণচঞ্চল।

২৯-১০-২৩

চলবে..

লেখক, কবি, বহুগ্রন্থ প্রণেতা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *