আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ প্রদ্ত্ত ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর’ গ্রন্থের তা’আরুফ

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ প্রদ্ত্ত ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর’ গ্রন্থের তা’আরুফ

শাইখুল হাদীস আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ. রচিত, শাইখুল আরব ওয়াল আজম কুতবুল আলম, শাইখুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর বৈচিত্রময় জীবন-চরিত বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর গ্রন্থের মুরশিদুল আলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ আস’আদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম-এর অন্যতম খলিফা, প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট গবেষক আলেম হযরত মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেব প্রদত্ত তা’আরুফ।

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম, আস-সালাত আস-সালামু আলা সায়্যিদিল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, ওয়া আ’লা আলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়া আতবায়িহী আজমাঈন। আম্মা বা’দ

‘হাকীমুন আলীম’ অসীম প্রজ্ঞাময়, সর্বময় জ্ঞানের অধিকারী, মহান আল্লাহ পাক এই মানুষ এবং সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। আর তিনিই হিকমতময় উপায়ে প্রতিটি বিষয়কে পরিণতির চূড়ান্তে নিয়ে যান। প্রতিটি বিষয় ও বস্তুর কল্যাণ ও সফলতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান একমাত্র আছে তাঁরই। কল্যাণ ও সফলতা নির্ণয়ের একমাত্র অধিকার ও চুড়ান্ত ক্ষমতা তাঁরই। তিনি ‘ওয়াহদাহু লা শরীকা লাহু’ সর্বক্ষেত্রে তিনি এক। কোন ক্ষেত্রে কোন বিষয়েই তাঁর শরীক নেই কেউ। সব সৃষ্টির জন্য স্ব স্ব স্বভাব ও মিজায অনুসারে পথও নির্ধারণ করে দিয়েছেন তাকবীনীভাবে। প্রাকৃতিক স্বভাব আচারে সব সৃষ্টিই মেনে চলছে সেই নির্দেশনা। এক চুলও ব্যতিক্রম হওয়ার অবকাশ নেই কোথাও। জন্ম-মৃত্যু, বর্ধন-পরিপক্কনসহ সবই এই নিয়মের অধীন। এর বাইরে যাওয়ার অধিকার ও ক্ষমতা নেই কারো। মানুষও তার প্রাকৃতিক জীবনে এর থেকে আলাদা নয়। চার ও নাচার সেই নিয়মকে আর সবার মত তাকেও মেনে চলতে হয় এবং চলেছেও সে।

কিন্তু মানুষ সব সৃষ্টি থেকে উন্নততর। ‘আহসানি তাকবীম’ সুন্দরতম অবয়ব কাঠামোয় তার পয়দা। “লাক্কাদ কাররামনা”- আমি মর্যদাময় করেছি বনু আদমকে এই অভিধায় সে অভিসিক্ত। সেই উন্নত মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি তাকে তাঁর মারিফত ও অভিজ্ঞান, কুরব ও নৈকট্য লাভের, তাঁর রেজা ও সন্তুষ্টির মহান পথও বাতলে দিয়েছেন। সেই পথ হল শরীয়তের পথ। আর এর জন্য তিনি নির্বাচন করেছেন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের এক বিমল ধারা। প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ.) থেকে নিয়ে শেষ নবী ও শ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে এসে এর পরিপূর্ণতা সাধন হয়। এর মাঝে হাজরো লাখো আম্বিয়া কেরাম প্রতি যুগেই সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন এ পথের। নিজের জীবনেও তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন এর বাস্তবায়নের উপায়।

যারা তাঁদের কথা অনুসারে এই পথ অবলম্বন করেছে তারা তো পৌঁছে গেছে ‘আ’লা ইল্লিঈন’ সাফল্যের সর্বোচ্চ মার্গে। আর যারা গ্রহণ করেনি তারা হয়েছে ‘আসফালা সাফিলীন’ হীন থেকে হেয়তর। পরিণত হয়েছে ‘কাল আনআম’ পশুত্বের হীনতায় ‘বাল হুম আদাল্লু’ না, আরো নীচতায়, আরো হেয়তায়, লাঞ্ছনার তলাহীন গহ্বরে। তাকবীনী কুদরাতে এই ইনসানের পয়দায়েশ; আর তাশরীআতের প্রজ্ঞাময় অবলম্বনে তা পৌঁছে গেছে মার্যাদার মার্গচূঁড়ায় ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে আম্বিয়া ও মুরসালীনের মহান ধারার ঘটে পরিসমাপ্তি, পায় পরিপূর্ণতা। ইকমালে দীন ও ইতমামে নিয়ামতের মুযদা ঘোষিত হয় চিরদিনের জন্য, অনন্ত যুগ ও কালের জন্য। তাঁর পরে আর কোন নয়া নবী নেই, রাসূল হয়েও আর আসবে না কেউ। নবুওয়াতের সুমহান প্রাসাদে শেষ ইটটি গেঁথে দেয়া হয়েছে। সুতরাং ‘লা নাবীয়্যা বা’দী’ আমার পরে আর নবী নেই কেউ। দরজা এর চিরতরে রূদ্ধ।

তবে ‘উলামাউ উম্মাতী কা আম্বিয়ায়ে বনী ইসরাঈল’- বনী ইসরাঈলের নবীগণের মত দায়িত্ব হল আমার উম্মতের আলীমগণের” এই বাণীর রূপচিত্র হিসাবে ওলামায়ে কিরাম হামেশাই উম্মতের কল্যাণকামিতায় নববী দায়িত্ব ও জিম্মাদারী আদায় করে গিয়েছেন। বাতিলের রুদ্র চক্ষু, তাদের হীন ষড়যন্ত্র ও প্রলোভন, আর সব ধরনের শঙ্কা ও ভয় উপেক্ষা করে ‘কালিমাতুল্লাহি হিয়াল উলইয়া’ –আল্লাহর কালিমা ও দীনকে সমোচ্চ রাখতে যে কোন ধরনের কুরবানী ও আত্মত্যাগের পথে পিছপা হতে দেখা যায়নি তাঁদের। নববী বাণীর বাস্তব নমুনা হিসাবে প্রত্যেক শতাব্দীর জঞ্জাল, শিরক ও বিদআত ও কুসংস্কারের আবর্জনা ছাফ করে দীনকে ‘খালিসাতান লীল্লাহ’ এক মাত্র আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলের সুন্নত ও আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে মুজাদ্দীদগণের আগমন ঘটেছে বহু। এক এক জন একেক দিকে কাজ করে চলে গিয়েছেন প্রিয় মাহবুবের অনন্ত সান্বিধ্যে।

কুরআন মজীদের ভাষায় সায়্যিদুল মুরসালীন ও খাতামুন্নাবিয়্যীন ও রাহমাতুল্লীল আ’লামীন যে কয়টি দায়িত্ব পালনে প্রেরিত হয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিতাব ও হিকমা-হিদায়াতের মূল উৎস কুরআন ও সুন্নাতের শিক্ষা দান, তাযকিয়ায়ে নফস ও প্রত্যেকের আত্মিক পরিশুদ্ধকরণ এবং দাওয়াত ও জিহাদ আল্লাহর দীনকে সর্ব ক্ষেত্রে সর্ব স্তরে পৌঁছে দেয়া ও ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহর মহান দায়িত্ব পালনে, সর্বাত্মক জেহাদ ও মুজাহাদা। ‘খায়রুল কুরুন’ সর্বোত্তম যুগ সাহাবীগণের পর তাজদীদ ও এহয়ায়ে দীনের রাহে প্রতি শতাব্দীতে এই সব ক্ষেত্রে একই সময়ে একাধিক হাক্কানী আলিম উলামা মুজাদ্দিদগণের আবির্ভাব ঘটেছে।

কেউবা তালীম -এর ধারায় এনেছেন বিশুদ্ধতার অলংকরণ, কেউবা করেছেন তাযকিয়া ও রূহানিয়াতের পথের জঞ্জাল ছাফ, আর কেউবা এনেছেন দাওয়াত ও জিহাদের ক্ষেত্রে নয়া উজ্জীবন। হযরত সাঈদ ইব্ন জুবায়ের, উমর ইবন আব্দুল আজীজ, ইমাম আযাম আবূ হানীফা, ইমামে দারিল হিজরা ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল এর যুগ পেরিয়ে হযরত আব্দুল কাদির জিলানী, ইমাম গাযালী, শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দী, হযরত খাজা চিশতী, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসায়ী, ইমাম তিরমিযী, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম ইবন মাজাহ, আরো কত শত স্বর্ণোজ্জ্বল নাম আঁকা রয়েছে অনির্মোচনীয় আখরে ইতিহাসের ধারায় যুগে যুগে ।

আশ্চর্য হয়ে দেখেছে সব মালাইকা মুকাররবীন, সৃষ্টিকুল আর পৃথিবীর তাবত সব কিছু। ইয়াহুদী ষড়যন্ত্রী আর শি‘আ, খারেজী বাতেনী আর মু’তাযিলা, বেদআতী, হিংস্র তাতারী ও ক্রুসেডারদের ছোবল থেকে কেমন করে সুনির্মল করে উজ্জ্বল ও অমলিনভাবে রক্ষা করে গেছেন হেদায়াত ও নূরের এই ধারা সর্ব যুগের ওলামায়ে কেরাম। এমনিভাবে যারাই গ্রাসে উদ্যত হয়েছে তাদেরকেই কল্যাণকামিতার সহানুভব আবেগে জড়িয়ে একদিন খাদিমরূপে পরিণত করেছেন এই দীনের। তাতারী ও মুঘলদের ইতিহাস এর উজ্জ্বল সাক্ষী ।

ইউরোপীয় রেনেসাসের আড়ালে ইউরোপের উত্তর পশ্চিম কোণে এক দ্বীপে ক্রমে ঘন হয়ে উঠছিল কাল মেঘ। বাণিজ্যের নামে ছলে-বলে-কৌশলে (ন্যায় নীতি ও সামান্য নৈতিক মূল্যবোধ বলতে যাদের কিছুই ছিল না, বর্তমান যুগে ইরাকের আবু গরীব কারাগার যার কলংকময় উদাহরণ) তারা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে। ষড়যন্ত্র ও মিথ্যার সিঁড়ি বেয়ে ছিনিয়ে নেয় বাংলার সিংহাসন। পলাশীর আম্রকাননে খুলে গেল তাদের সামনে হিন্দুস্থান, ক্রমে মুসিলম বিশ্ব আফ্রো-এশিয় ও দক্ষিণ আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশের দ্বার। এদিকে দিল্লীর এক মসজিদের চাটাইয়ে বসা মুজাদ্দিদীনের উত্তরসূরী শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.), পরে শাহ আব্দুল আজীজ (রহ.)- এর তীক্ষ্ণ চক্ষু এড়াল না সেই কাল মেঘ। জ্বালিয়ে তুললেন নতুন করে কুরআন ও সুন্নার আলোকে এক বিশ্ব বিপ্লবের নয়া উজ্জ্বল শামাদান। ঝড় তুললেন নয়া বাতাসে। ঢেউ উঠল আবার ঢেউ ভাঙ্গল। বালাকোটের ময়দানে শাহাদতের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটল প্রথম পর্যায়ের। স্থানে স্থানে এ শামাদান জ্বলতে জ্বলতে ১৮৫৭ এর সিপাহী বিপ্লবের মহা-অগ্নি ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। দিল্লীর পতনের মাঝ দিয়ে শেষ হল এই দ্বিতীয় পর্যায়ের। এই পর্যায়ের সফল সিপাহসালার আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুত তাইফা তাযকিয়ার ময়দানের মুজাদ্দিদ হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহ.), ফেকাহ ও তাফাক্কুহ -এর ক্ষেত্রে মুজাদ্দিদে যামান হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) আর দাওয়াত ও জিহাদের মুজাদ্দিদ ও দীক্ষাগুরু হযরত কাসিম নানতবী (রহ.) শামেলীর তাজদিদী অন্তরালোকে উম্মাহকে গড়ে তোলার নয়া দিক নির্দেশনায় ঐক্যবদ্ধ হলেন পরবর্তী যুগের ওলামা ও মুজাদ্দিদ গড়ার কেন্দ্রভূমি দারুল উলূম দেওবন্দে। নতুন মোড়কে বাঁধলেন তা’লীম ও তাযকিয়া ও দাওয়াত জিহাদের মহান রাহকে ।

হযরত কাসিম নানতুবী (রহ.) ছিলেন এই রাহের মস্তিষ্ক ও মনন। নববী চিন্তার পূর্ণ অবয়বে গড়ে তুললেন দেওন্দের এই মহামারকাযকে। একদিকে যেমন তা’লীমে কিতাব ও হিকমার ছিল নব জাগরণ, অন্য দিকে এরই সাথে ছিল তাযকিয়া ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির নব উত্থান। অপর দিকে ছিল দাওয়াত ও জিহাদের নব উজ্জীবন। শুরু হল তা’লীম, তাযকিয়া, দাওয়াত ও জিহাদের সমন্বিত তাজদীদ ও এহ্ইয়ার আগামী সহস্র বছরের মহা সংগ্রামের জীবন প্রতীক। এরই সাথে প্রস্তুতি চলল সাম্রাজ্যবদী উপনিবেশবাদীদের হাতে পিষ্ট আফ্রো-এশীয়, লেটিন আমেরিকার মজলূম আমজনতার রাজনৈতিক মুক্তি আন্দলনের নব পর্যায়। পৃথিবী সাক্ষী ভারত উপমহাদেশের দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল যে সাম্রজ্যবাদের উত্থান, আবার এই উপমহাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমেই কেবল ঘটেছিল এর পতন । তাজাদীদ ও এহ্ইয়ায়ে দীনের সব ক্ষেত্রের সমন্বিত ও জামি’ ধারার এই মহান উত্তরসুরী ছিলেন হালকা পাতলা ছোট খাট গড়নের, দেখতে কময়ুর, বিনয়ী কিন্তু লৌহ-কঠিন ও সিংহ-তেজদৃপ্ত মাওলানা মাহমূদ হাসান হযরত শাইখুল হিন্দ। মুজাদ্দিদুল কুল হযরত কাসিম নানতবীর বহু শাগরিদ-শিষ্য ছিলেন, এক একজন একেক ক্ষেত্রে আল-উছতাজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজন মান্য। কিন্তু কাসেমী মনন ও চিন্তন, কাসেমী প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞান, তাযকিয়া ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জন, দাওয়াত ও জিহাদের উন্মাতাল প্রেরণাময় উজ্জীবন, সেই বহুমাত্রিকতার সমন্বিত উত্তরসুরী ছিলেন তেজদৃপ্ত এই সিংহপুরুষ হযরত শাইখুল হিন্দ (রহ.)।

একদিকে যেমন তিনি দারুল উলূমের মসনদে হাদীস অলংকৃত করেছিলেন শত শত মুহাদ্দিস ফকীহ মুফাস্সির আলিমের তিনি ছিলেন শিক্ষাগুরু, তেমনিভাবে তাযকিয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন শীর্ষ মার্গে। আবার দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে ছিলেন প্রবল প্রতাপে। কিতাব ও হিকমার আলোকে পৃথিবীকে সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী যিনি বিপ্লব গড়ে তোলেন নিরবে ধীরে ধীরে। ভারতের আনাচে কানাচে গড়ে উঠে মুজাহিদীনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কাবুলে প্রতিষ্ঠা করলেন প্রবাসী ভারত সরকার। নিজে চলে গেলেন একান্ত সঙ্গীদের নিয়ে হিজাজে।

হজ্জ মৌসুমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তুললেন তুর্কী খেলাফতের সঙ্গে। চুক্তি করে ভারত স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু এরই মাঝে ‘রায় বাহাদুর’ ‘খান বাহাদুর’ আর ‘শামসুল উলামা’ খেতাব লাভের পদকলোভীদের বিশ্বাসঘাতকতায় ফাঁস হয়ে যায় সেই মহাআন্দোলনের কর্মসূচী। হিজাজে তাঁরা কারাবরণ করেন। তিনি নিজে গ্রেফতার হন মক্কা মুকাররমায়। গাদ্দার শরীফ হুসাইন তাঁকে তুলে দেয় ইংরেজদের হাতে। প্রিয় শাগরিদ চেরাগে মুহাম্মদ (হযরত মাদানী রহ.) -সহ অন্তরীণ হলেন ভূ- মধ্যসাগরীয় দ্বীপ মাল্টায়। সে সময় মুসলিম বিশ্বের বহু আন্তর্জাতিক নেতা সেথায় অন্তরীণ ছিলেন। ফলে প্রতিকূল আবহাওয়ায়ও তিনি তাদের কাছে পৌঁছে দিলেন তাঁর আন্দোলনের আওয়াজ। পরবর্তীতে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়াসহ আফ্রো-এশিয়ার বহু দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আযাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাদেরই হাতে।

দীর্ঘ চার বছর কারা দুর্ভোগের পর রুগ্ন ও অসুস্থ অবস্থায় মুক্ত হয়ে যখন ভারতে ফিরে আসছিলেন, জাহাজ থেকে দূর ভারতের বোম্বাই উপকূল চোখে ভেসে উঠলে প্রিয় উত্তরসুরী চেরাগে মুহাম্মদ (পরবর্তীতে শাইখুল ইসলাম মাদানী রহ.) -কে ডেকে বলেছিলেন, “এই আমার দেশ আজ ইংরেজ কবলিত। যেদিন এই দেশ এদের কবলমুক্ত হবে, সেদিন সারা পৃথিবীই এদের কবলমুক্ত হবে। তাই আজাদী আন্দলন এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব তোমায় দিলাম” ।

যাহোক, হযরত শাইখুল হিন্দ (রহ.) ছিলেন ছাহাবায়ে কেরামের নমুনায় রাসূল (সা.)-এর ওরাসাত-ধারার সার্থক উত্তরসুরী। তিনি ছিলেন এক সফল মানুষ গড়ার কারিগর। একদিকে যেমন তাঁর সাগরিদগণের মাঝে তা’লীম ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে হযরত আনোয়ার শাহ কাশমিরী (রহ.)-এর মত হিমালয় সদৃশ মুহাদ্দিছ, ইবরাহীম বলীয়াবী ও ইজায আলী (রহ.)-এর মত সর্বোতঃ সফল একনিষ্ঠ শিক্ষা-মন উসতায, তেমনি তাযকিয়া ও তাসনীফের ক্ষেত্রে হযরত আশরাফ আলী থানবী (রহ.) -এর মত বিদগ্ধ প্রজ্ঞাময় হাকীমুল উম্মাত, তেমনি দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্দলবী (রহ.), ফীকাহ ও শরয়ী ব্যবহারিক জ্ঞানে মহাবিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হযরত মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রহ.), জেহাদ ও মুজাহাদার ক্ষেত্রে অসাধারণ বিপ্লবী হযরত মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী ও মাওলানা হিফযুর রহমান সিহারভী (রহ.)-এর মত নববী আদর্শে অটল পাহাড়সম বিজ্ঞজনের, এমনি আরো কত মহাপ্রাণ ।

তবে নবুওয়াতী ওরাসাতের বহু মাত্রিকতা, জামিয়ীয়্যাত ও সব্যশাচীতা, তা’লীম ও তাযকিয়া, দাওয়াত ও ইরশাদ, জিহাদ ও মুজাহাদা, খিদমতে খালক্ব-সৃষ্টির সেবা, বিনয় ও নম্রতা, সর্বক্ষেত্রে বুবকরী চেতনা ও জাযবা, কোমলতা ও রিফক, উমরী হিম্মত ও দার্ঢ্যতা, উসমানী হায়া ও সুনম্র লজ্জাশীলতা আর হায়দারী সাহস ও বিচক্ষণতা, ইনসাফ ও নিষ্ঠতার বহুমাত্রিকতা দিয়ে যাকে সার্থক উত্তরসুরী করে গড়ে তুলেছিলেন হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.), সে চেরাগে মুহাম্মদ শাইখুল আরব ওয়াল আজম শাইখুল ইসলাম হযরত মাদানীর নমুনা আর ছিল না তো কেউ ।

হযরত আনোয়ার শাহ্ কাশ্মিরীর মত পাহাড়সম মুহাদ্দিস যখন দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে কোন কারণে পৃথক হয়ে যান তখন সেই মসনদকে পূরণের জন্য আসামের এক নিভৃত এলাকায় কর্মরত এই ব্যক্তিত্বের দিকেই পড়েছিল তৎকালীন সারপোরাস্ত হযরত থানভী (রহ.)-এর দৃষ্টি। সব শর্ত মেনে মিনতী করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁকে, দারুল উলূম দেওবন্দ যার সম্পর্কে বহু পূর্ব থেকেই মজলিসে শূরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল তিনি যখনই আসবেন তখনই দারুল উলূমের শিক্ষক হিসাবে গণ্য হবেন। পৃথিবী দেখেছে হাদীছ শাস্ত্রে রওযা পাককে সামনে নিয়ে দীর্ঘ দিনের পাঠদানকারী এই শাখছিয়্যাতের জ্ঞান সাগরের বিপুলতা। আরব- আজমের সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিল আরো বহুদূর । আজকের পৃথিবীতে শিমাল থেকে জুনুব আর মাশরিক থেকে মাগরিব ইউরো-আটলান্টিকা, আফ্রো-এশিয়ার সর্বত্র যার চিহ্ন বর্তমান। দাওয়াত ও বিপ্লবের ক্ষেত্রে সর্ববিস্তারী তাবলীগী মেহনত তো রিযা’আত ও দুগ্ধ পেয়েছিল তাঁরই ক্রোড়ে। জিহাদ ও মুজাহাদার ময়দান তো তাঁর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য, তুলনাহীন যেখানে তিনি সর্বকালে। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরুধী আন্দোলনে, বিশেষ করে এই উপমহাদেশের মুক্তি আন্দোলনে তাঁর অবদান তো ক্ষুদ্র নয়। মাদানী ফর্মুলা নামে ভারত স্বাধীনতার যে নীতিমালা তিনি দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে এর চেয়ে উত্তম সমাধান আর ছিল না কিছুই। এখনও যদি তা বাস্তবায়ন করা যায়, তবে উপমহাদেশের সব সমস্যার সমাধান হতে পারে এতে। কিন্তু কাপালিক ব্রাক্ষনদের মত সাম্প্রদায়িক হিংস বিদ্বেষীদের বিদ্বেষ পরায়নতা আর ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ছদ্মবেশী বন্ধু বিশ্বাস ঘাতকদের জন্য তা বাস্তবায়ন হতে পারেনি ।

স্বাভাবিক অর্থেই ছিলেন এই মহান ব্যক্তিত্ব চেরাগে মুহাম্মদ ও মুহাম্মদী চেরাগ ও প্রদীপ। ‘ফুরসানুন্নাহার ও রুহাবানুন ফিল্লায়ল’ এ মহান ব্যক্তি উম্মতের কল্যাণ চিন্তায় পরম আবেগে রুনাযারী রত রাতের বেলায় আল্লাহর হুযূরে আর শত্রুর মোকাবেলায় দিন যাপনকারী তেজোদৃপ্ত আহবে -এর স্বার্থক নমুনা। ইসলামের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, এমন কোন দিক নেই যেখানে তিনি নববী ওরাসাতের স্বাক্ষর রাখেননি ।

এই ধরনের বহু মাত্রিক যাত ও শাখছিয়্যাতের জীবনী তুলির আঁচড়ে স্পষ্ট করা খুবই দুরহ ও মহা মুশকিল কাজ। তবে এই মুশকিল কাজটিকে আছান করতে প্রয়াস পেয়েছেন ঐ মহা ব্যক্তিত্বের অন্যতম শাগরিদ ও মুরীদ সুবিখ্যাত মুহাদ্দিছ প্রিয়তম উস্তাদের আদর্শে আসীন, বর্তমানের এক সুসফল উত্তরাধিকারী হযরত মাও. কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ। প্রাপ্ত তথ্যাবলির বিন্যাসই করেননি তিনি এতে, অধিকন্তু নিজে দীর্ঘদিন তাঁর সংসর্গে থেকে যা দেখেছেন যা উপলদ্ধি করেছেন সবই তুলে ধরেছেন অতি নিপুনতায়। গ্রন্থটি আপাত: দৃষ্টিতে দু’খণ্ড বিশিষ্ট বিরাট কলেবরের মনে হলেও যে মহান ব্যক্তিত্বের জীবন ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে এতে, তাতে আমার মনে হয়েছে এত লেখার পরেও এটি খুবই ক্ষুদ্র ও কিঞ্চিতকর। তাঁকে নিয়ে লেখকের সরাসরি অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারটিও তুলে ধরা সম্ভব হয়নি হাজার হাজার পৃষ্ঠার এই কলেবরেও। হযরত শাইখুল ইসলাম মাদানীর জীবনের প্রতিটি দিককে আবেগ ভরা ভাষায়, তথ্য সমৃদ্ধ করে, আলাদা আলাদা অধ্যায়ে তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে এতে। তাঁকে নিয়ে বাংলা ভাষায় কিছু কিছু গ্রন্থ রচিত হলেও অপূর্ণঙ্গতার মাঝেও এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা ও তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ হয়নি বলেই আমার জানা ।

দীনহীন অধম এই আমি, আমার পরম সৌভাগ্য, আমার বে-ইনতেহা সা‘আদাতমান্দী এই মহাগ্রন্থের তা‘আরুফ নিয়ে ইউসুফ আলাইহিস্সালামের খরিদাগ্রহী দীনহীন বৃদ্ধার সূতো নিয়ে হাজির হওয়ার মত অনন্ত দুয়ার মাঝে শামিল হওয়ার। আল্লাহর দরবারে এ গ্রন্থটি কবুল হবে বলে আমার বিশ্বাস। এর মাধ্যমে সবাই পাবে পরম অনুপ্রেরণা ও নিজেকে গড়ে তোলার দিশা। আশা, হাশরের ময়দানে যখন রাহমাতুল্লিল আলামীন ও শাফিউল মুযনিবীন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে কায়েম হবে জান্নাতিদের মিছিল; যে মিছিলে থাকবেন আম্বিয়ায়ে মুরসালীন, শুহাদা ও সালেহীন, সাহাবা আজমাঈন ও আওলিয়া যাকেরীন, ফুকাহা ও মুহাদ্দিছীন, তাঁদের পেছনে সেই মিছিলে হযরত শাইখুল ইসলাম কুতবে আলম হযরত মাদানীর সাথে এই অধমের, লেখকের ও অনুসারী পাঠকদের একটু জায়গা করে দেবেন মহান রাব্বুল আলামীন । আমীন ইয়া আরহামার রাহেমীন।

Related Articles