আল্লাহর কাছেই ছুটে যেতে হবে

আল্লাহর কাছেই ছুটে যেতে হবে

মুফতি রিয়াজুল ইসলাম : পাপ-পুণ্য মিলিয়েই মানুষ। জগতে মানুষ কবিরা-ছগিরা, জাহেরি-বাতেনি, জানা-অজানা বেহিসাব পাপ করে। কেউ পাপ করে ইচ্ছকৃতভাবে আর কেউ অনিচ্ছায়। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণ হচ্ছে, যখনই তাদের দ্বারা কোনো পাপকাজ সংগঠিত হয়ে যায়, সাথে সাথে তারা আল্লাহর কাছে তাওবা করে নেন। কিন্তু যখন মানুষ পাপকাজ করতে করতে পাপে অভ্যস্ত হয়ে যায়, পাপকাজ থেকে ফিরে আসে না, তখনই আল্লাহ তাআলা রাগান্বিত হন। তখনই মানুষের উপর নেমে আসে বিভিন্ন রকমের বালা-মুসিবত, আযাব আর গজব।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ নিপতিত হয়, তা তোমাদেরই কর্মফল। তিনি অনেক গুনাহ মাফ করে দেন।’ (সুরা আশ্-শূরা: ৩০)

অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যখন তোমাদের ওপর মুসিবত এল, যার দ্বিগুণ তোমরা ঘটিয়েছ, তখন তোমরা বললে, এটা কোত্থেকে এল! (হে নবী) আপনি বলে দিন, এ তো তোমাদের পাপ থেকেই; নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়েই সর্বশক্তিমান।’ (সুরা আল ইমরান: ১৬৫;

আরেকটি ঘোষণা, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে ফ্যাসাদ প্রকাশ পায়, যার ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ তাদের আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৪১)।

গুনাহের কারণে অনেক জাতীকে ধ্বংসের বর্ণনা কুরআনুল কারীমে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।

হযরত নূহ (আ.) এর কওম যখন আল্লাহর অবাধ্য হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হলো, আল্লাহ তা’লা ভীষণ ক্রুব্ধ হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন। বন্ধ করে দিলেন বৃষ্টি বর্ষণ। ফলে তাদের ফসলাদি ও প্রাণিসম্পদ কমে যেতে লাগলো। এতেও যখন তাদের বোধোদয় হলো না। তারা তওবা করলো না। হযরত নূহ (আ.) এর কথায় কর্ণপাত করলো না। তখন তাদের উপর নেমে এলো আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন আযাব। তাদের চুলাসমূহ থেকে পানি উথলে ওঠে প্রবাহিত হতে লাগলো, আকাশ মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো। চারদিক থেকে অধিবাসীদের বেষ্টন করে ফেললো। নূহ (আ.) এর ছেলে কেনানসহ যারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিল তাদের কেউই রক্ষা পায়নি।

অনুরূপভাবে ‘আদ’ জাতিকে আল্লাহ তা’লা অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহর অবাধ্য হওয়ায় রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হল। প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। ঝড়ের আঘাতে গাছ-পালা উপড়ে ফেললো, বাড়ি-ঘর বিলীন করে দিলো এবং পশু-পাখিকে উড়িয়ে দূরে নিয়ে গেলো। আল্লাহর গজবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো ‘আদ’ জাতি।
হযরত লূত (আ.) এর কওমের লোকেরা যখন পাপচারে লিপ্ত হলো। সমকামিতার মতো ঘৃণ্য ও জঘন্য পাপাচার যখন তাদের পেশায় পরিণত হলো। তখন তাদের উপর নেমে এলো প্রচন্ড গজব।

আল-কুরআনে সবিস্তারে এগুলোর বিবরণ রয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লাহ তা’লা কুরআনে এসব ঘটনা উল্লেখ করে মানুষকে সতর্ক করেছেন, যাতে মানুষ পাপচারে নিমজ্জিত না হয়। আল্লাহর আযাব আর গজবে ধ্বংস না হয়।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন সরকারি মালকে নিজের মাল মনে করা হয়, আমানতের মালকে নিজের মালের মতো ব্যবহার করা হয়, জাকাতকে জরিমানা মনে করা হয়, ইসলামী আকিদাবর্জিত বিদ্যা শিক্ষা করা হয়, পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়, মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়, বন্ধুদের আপন মনে করা হয়, বাবাকে পর ভাবা হয়, মসজিদে শোরগোল করা হয়, পাপী লোক গোত্রের নেতা হয়, অসৎ ও নিকৃষ্ট লোক জাতির চালক হয়, ক্ষতির ভয়ে কোনো লোককে সম্মান করা হয়, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন অধিক হয়, মদ্য পানের আধিক্য ঘটে, পরবর্তী সময় লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের বদনাম করে—তখন যেন তারা অপেক্ষা করে লু হাওয়া (গরম বাতাস), ভূমিকম্প, ভূমিধস, মানব আকৃতি বিকৃতি, শিলাবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি ইত্যাদি কঠিন আজাবের, যা একটার পর আরেকটা আসতে থাকবে, যেমন হারের সুতা ছিঁড়ে গেলে মুক্তার দানাগুলো একটার পর একটা পড়তে থাকে। (তিরমিজি)

তাই ভয়াবহ এই আজাব গজব থেকে বাঁচতে হলে আল্লাহর কাছেই ছুটে যেতে হবে। কায়মনোবাক্যে তাঁর কাছেই তাওবা করতে হবে। কৃত গুনাহের জন্য রোনাজারি করে মাফ চাইতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে,”অতএব তোমরা তার কাছেই গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাওবা করে তাঁর দিকেই ফিরে এসো।”

তাওবা করলে আল্লাহ তা’য়ালা কী পরিমাণ খুশি হন,এ সংক্রান্ত একটা হাদিস উল্লেখ করে শেষ করছি।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাদেম, আবূ হামযাহ আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দার তওবা করার জন্য ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী আনন্দিত হন, যে তার উট জঙ্গলে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় ফিরে পায়।’’(বুখারী ৬৩০৯, মুসলিম ২৭৪৭, আহমাদ ১২৮১৫)

মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এইভাবে এসেছে যে, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবায় যখন সে তওবা করে তোমাদের সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশী খুশী হন, যে তার বাহনের উপর চড়ে কোনো মরুভূমি বা জনহীন প্রান্তর অতিক্রমকালে বাহনটি তার নিকট থেকে পালিয়ে যায়। আর খাদ্য ও পানীয় সব ওর পিঠের উপর থাকে। অতঃপর বহু খোঁজাখুঁজির পর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বাহনটি হঠাৎ তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যায়। সে তার লাগাম ধরে খুশীর চোটে বলে ওঠে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার দাস, আর আমি তোমার প্রভু!’ সীমাহীন খুশীর কারণে সে ভুল করে ফেলে।

লেখক : শিক্ষক ও সমাজ বিশ্লেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *