ইন্টারনেট বিহীন বাংলাদেশে যা ঘটলো বৃহ:বার থেকে

ইন্টারনেট বিহীন বাংলাদেশে যা ঘটলো বৃহ:বার থেকে

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে হওয়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর উত্তপ্ত সময় পার করছে দেশ। ঘটেছে প্রাণহানি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ।

গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) রাত থেকে মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) দিবাগত রাত পর্যন্ত টানা পাঁচ দিন সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাত থেকে সীমিত পরিসরে চালু হতে শুরু করে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট।

ইন্টারনেট না থাকায় বিঘ্নিত হয় অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোর নিয়মিত সংবাদ প্রকাশ। এই পরিস্থিতিতে চলুন জেনে নেওয়া যাক, ইন্টারনেট না থাকা দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহ—

১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার

কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের “কমপ্লিট শাটডাউন” শুরু হয় এদিন। এর আগে ১৭ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। কর্মসূচি চলাকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

এদিন সংঘর্ষে সারাদেশে ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। অবরোধকারীদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশ প্রায় অচল ছিল। এদিন দুর্বৃত্তরা মহাখালীতে সেতু ভবন, স্বাস্থ্য ভবন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভবন, দুর্যোগ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়। শতাধিক গাড়ি পোড়ানো হয়। দুই দফা আগুন দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এর জেরে অন্তত ১২ ঘণ্টা বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে এই ধ্বংসযজ্ঞ বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল বলে জানায় প্রশাসন।

এদিন সকাল থেকে বন্ধ রাখা হয় মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট। বিভিন্ন স্থানে ডেটা সেন্টারে অগ্নিসংযোগের পর বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। ফলে কার্যত ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গোটা দেশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এদিন সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

১৯ জুলাই, শুক্রবার

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের “কমপ্লিট শাটডাউন” ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এদিন রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল, পরিস্থিতি ছিল থমথমে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

এদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গুলি ও সংঘর্ষে অন্তত ৪৪ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও ১২ জন নিহত হওয়ার খবর জানা যায়। এদিন আহত হন শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ অনেকে। এদিন আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকেও অংশ নিতে দেখা যায়।

এদিন দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালানোর পাশাপাশি হামলা চালানো হয় রাজধানীর মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশনে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের শতাধিক গাড়ি। প্রায় প্রতিটি হামলার ঘটনায় লুটপাটও করে হামলাকারীরা।

এদিন নরসিংদীর জেলা কারাগারে আক্রমণ চালানো হয়। কতৃপক্ষ জানায়, এই আক্রমণে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। কারাগারের গেট ভেঙে ৮২৬ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। লুট করা হয় অস্ত্র। পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত আনসরুল্লাহ বাংলা টিমের সাত সদস্য ও জেএমবি’র দুই নারী সদস্যও রয়েছে। এসময় ৮৫টি অস্ত্র ও ১ হাজার ৫০টি গুলি ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

এদিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে চলমান আন্দোলন পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়। পরে ১৪ দলের নেতারা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে ১৪ দলের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েন ও কারফিউ জারির পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর রাত ১২টা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়, পাশাপাশি করা হয় সেনাবাহিনী মোতায়েন।

এদিন দিবাগত গভীর রাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আট দফা দাবি তুলে ধরেন কোটা আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক। একইসঙ্গে তারা জানান, আন্দোলনের নামে সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। অবশ্য এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের সংবাদকর্মীদের মুঠোফোনে পাঠানো এক বার্তায় ৯ দফা দাবির কথা জানান।

২০ জুলাই, শনিবার

সরকারি সিদ্ধান্তে এ দিন দেশজুড়ে কারফিউ দেওয়া হয়। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টায় শুরু হওয়া কারফিউ এদিন দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত শিথিল ছিল। এদিনও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন মোট ২৬ জন নিহত হওয়ার খবর জানা গেছে।

এদিন সরকার এক ঘোষণায় ২১ ও ২২ জুলাই দুই দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। সরকার নির্বাহী আদেশে এ ছুটি ঘোষণা করেছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। পরে অবশ্য সাধারণ ছুটি আরও একদিন বাড়িয়ে ২৩ জুলাইও ছুটির আওতায় আনা হয়।

এদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করে তার পরিবার।

২১ জুলাই, রবিবার

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রদান করেন।

রায়ে বলা হয়, কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩%; মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫%; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১% এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১% নির্ধারণ করা হলো। নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করার কথাও বলা হয় রায়ে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

রায়ে আরও বলা হয়, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।

এদিন আগের আহতদের মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুর খবর আসে।

এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবন গণভবনে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নির্দেশনা দেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান, নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল নাজমুল হাসান, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

২২ জুলাই, সোমবার

কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। এদিন আহতদের মধ্য থেকে আরও ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

এদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে হামলা-অগ্নিসন্ত্রাস করেছে মন্তব্য করে ওই মতবিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এখানে ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখনও তারা জ্বালাও-পোলাও আন্দোলনের হুকুম দিয়ে যাচ্ছে। যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, এত সহজে ছাড়া হবে না। শক্ত অ্যাকশন নিয়ে এটা দমন করে পরিবেশটা উন্নত করা হবে।”

সরকার বাধ্য হয়ে কারফিউ ও সেনা মোতায়েন করেছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “এটা আমরা চাই না। তারা (ছাত্ররা) যখন সরে এসেছে সেই সময় আমি আর্মি নামিয়েছি। আমি কিন্তু তার আগে আর্মি নামাইনি। আমরা শেষ চেষ্টা করি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে। তারপর আর্মি নামাতে বাধ্য হয়েছি। কারফিউ দিয়েছি।” আস্তে আস্তে কারফিউ শিথিল করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

এদিন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ মেট্রোরেল স্টেশন চালু করতে এক বছর লাগতে পারে। এর কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, যেসব সরঞ্জামাদি হামলাকারীরা ধ্বংস ও লুট করে করেছে, এর অনেক কিছুই ইউরোপ থেকে আমদানী করা হয়েছিলো। সেগুলো পুনরায় কিনতে দরপত্র আহ্বানসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যাবলী শেষ করে আমদানির পর তা স্থাপন করে স্টেশন দুটি চালু করতে গিয়ে এই দীর্ঘ সময় ব্যয়ের সম্ভাব্যতা তৈরি হয়েছে।

২৩ জুলাই, মঙ্গলবার

কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এছাড়া বুধববার থেকে চার ঘণ্টা করে অফিস চালু রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এদিন রাত থেকে সীমিত পরিসরে চালু হতে থাকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা।

মোট হতাহত

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের হিসাবে, কোটা আন্দোলন শুরুর পর ১৬ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে ১৯৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট করে হতাহতের সংখ্যা জানানো হয়নি।

তবে সপ্তাহব্যাপী সহিংসতায় আন্দোলনকারী কিংবা সাধারণ মানুষ কত জন মারা গেছেন, এর তথ্য সরকারের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

আজ বুধবার (২৪ জুলাই) তিনি সাংবাদিকেদের বলেন, “জনসাধারণ কতজন মারা গেছেন, তার কোনো হিসাব আমাদের কাছে নেই। কোনো থানায় এ সংক্রান্ত কোনও মামলাও দায়ের হয়নি। পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করছে, এ বিষয়ে পরে বলা যাবে।”

 

ঢাকা ট্রিবিউন ও দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *