ইসলামী বইমেলা; একটি নির্মোহ পর্যালোচনা

ইসলামী বইমেলা; একটি নির্মোহ পর্যালোচনা

তামীম আব্দুল্লাহ একজন উদীয়মান তরুণ আলেম ও লেখক। সাহিত্যের সাথে তার সখ্যতা দীর্ঘ দিনের। ইসলামী সাহিত্য আড্ডাগুলোতে তার লেখাগুলো বেশ সমাদৃত হয়। ইদানিং সাংবাদিকতা পেশায় নিয়জিত আছেন। ইসলামী ফাউন্ডেশন আয়োজিত ইসলামী বই মেলা ঘুরে এসে নিজের সোজা-সাপটা মতামত তুলে ধরছেন পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকমে’র পাঠকদের জন্য-

প্রাণের মেলা ‘বইমেলা’। এই স্লোগান শোনার সাথেসাথে চোখে ভেসে উঠে অমর একুশে বইমেলার দৃশ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হয়েও একুশে বইমেলায় ধর্মীয় পুস্তক ও প্রকাশনীগুলোর তেমন প্রভাব না থাকলেও গত দুয়েক বছরে কিছু ইসলামী প্রকাশনীর স্টল বাংলা একাডেমির তত্বাবধানে দেখা যায়। তদুপরি সেখানে সুযোগ-সুবিধা ও নিজেদের স্বকীয়তা না থাকায় সৃজনশীল কিছু ইসলামী প্রকাশনাকে রাসূলে আরাবী- সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের মাস পবিত্র রবিউল আওয়াল উপলক্ষে গত বছর চারেক ধরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্বাবধানে আনুষ্ঠানিকতার সাথে এক মাসব্যাপী ইসলামী বইমেলার আয়োজন করে থাকে। এবং বিগত বছরগুলোর মত এ বছরেও আয়োজন করা হয়েছে ইসলামী বইমেলার।

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের তরুণ আলেম এবং ইসলামী অঙ্গনের ব্যক্তিত্বদের মেলায় আগমন এবং মেলা কেন্দ্রিক কিছু সংস্কৃতিক কার্যক্রম করায় একমাস ব্যাপী মেলায় বেশ কিছুদিনই পাঠকের তুলনায় বেপাঠকদের সমাগম একটু বেশীই নজরে পড়ে। বিগত বছরগুলোতে মিডিয়া কভারেজ বলতে লাইমলাইটে ছিলো তাদের ফেসবুক লাইভ বা পোস্ট করে তাদের আগমনের সংবাদ সাধারণ মানুষ এবং পাঠকদের কর্ণে পৌঁছানো। সে প্রচেষ্টায় তাদের আগমনের দিনগুলো এবং কওমী মাদরাসা অঙ্গনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটা দলও মেলা চলাকালীন সময়ে বৃহস্পতি, শুক্রবার সবমিলিয়ে মোটামুটি একটা পর্যায়ের মানুষের সমাগম হয়। কিন্তু পাঠকের পাল্লাটা যেন আর ভারী হয়ে ওঠে না।

এবার ২০২৩ এর ইসলামী বই মেলার অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বিগত কয়েক শুক্রবারে টানা বৃষ্টি ও কওমী সেলিব্রিটিদের সময়-সুযোগের অভাবে বা তাদের মেলায় আমন্ত্রণ করে না আনায় পাঠকমুখর ও বেচা-বিক্রির খাতা খালি হয়ে আছে বলে মনে করেন ইসলামী বইমেলার স্টলকর্মীরা।

তাদের মতে, বাংলাদেশের যারা তরুণদের পছন্দের আলেম-ওলামা আছেন তারা যদি আসেন তাহলে মেলা জমজমাট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ জন্য আমরা আশাবাদী যে মেলার আর বাকী যে ক‘দিন আছে তারা আসলে মেলা আরো জমজমাট হবে।

তাদের এমন উত্তরে আরেক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, একটি বইমেলা কি কেবল নির্দিষ্ট ঘরানার কিছু ইনফ্লুয়েন্সার, সেলেব্রিটি কিংবা নির্দিষ্ট বয়সের কিছু আলেম-ওলামাকে কেন্দ্র করে পরিচালনা করার জন্যই কি আপনাদের এত আয়োজন?

এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাবাজারের সৃজনশীল রুহামা পাবলিকেশন্সের স্টলকর্মী মাহদী বলেন, আমরা তো শুধু কর্মী এজন্য এসব বিষয় প্রকাশকেরা ভালো বলতে পারবেন। ইসলামী বইমেলা উপলক্ষে যদিও মাহদী একজন স্টলকর্মী, প্রকৃতপক্ষে রুহামা পাবলিকেশন্সের মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র কর্মকতা তার বড় পরিচয়। তবে তাদের সাথে প্রকাশকদের কমিউনিকেশন বা ব্যবসায় অগ্রগতির জন্য কর্মীদের সাথে কর্তাদের মতবিনিময়ের যোগসূত্রে কোনো আলোচনা, পর্যালোচনা হয় না সেটা পরিস্কার। আর এ পরিস্কার বিষয় শুধু যে কেবল একক প্রকাশক বা প্রকাশনীতে ঘটে বিষয়টি এমন নয়। বরং এই ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রকাশনার মাঝেই বিদ্যমান। যার কারণে বইমেলা কেন্দ্রিক অনেক সহজলভ্য বিষয়গুলো এক তুড়িতে সমাধান হওয়ার মতো হলেও এই ‘গ্যাপ’ তাদেরকে ভোগাচ্ছে বছরের পর বছর।

ইসলামী বইমেলা নিয়ে ইসলামী প্রকাশনাগুলোর আগ্রহ তো আছেই, তবে এর মান উন্নয়ন এবং অগ্রগতির ব্যাপারে না আছে কোনো পরিকল্পনা আর না আছে কোনো ভালো ব্যবস্থাপনা। অনেকটা ‘কলা আমি খাবো কিন্তু গাছ লাগাতে চাই না’ প্রবাদের মতো। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্বাবধানে করা এ বইমেলায় সৃজনশীল ইসলামী প্রকাশনাগুলো অনেকক্ষেত্রে নিজস্ব নামে স্টল পর্যন্ত পায় না। রাহনুমা প্রকাশনীর স্টলকর্মী সুফিয়ানের ভাষ্যমতে, মেলার অগ্রগতি এবং উন্নয়নের জন্য আমাদের ২টি বিষয়ে কাজ করতে হবে। প্রথমত, সমস্ত সৃজনশীল প্রকাশনীরদের স্টল বরাদ্দ পেতে ফাউন্ডশনের কাছে একযোগে আলোচনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ইসলামী সৃজনশীল প্রকাশনা গুলোকে সম্মিলিতভাবে মেলায় তাদের কার্যক্রম এবং সাধারণ কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি যারা কর্মী হিসেবে যারা কাজ করে তাদের যথাযথ কাজের মূল্যায়ন করে দায়সারা মনোভাব দূর করে মানসম্পন্ন বেতন ব্যবস্থা রাখতে হবে। 

গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স এর কথা মনে আছে পাঠক? একুশে বইমেলা ২০২৩ শে গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স এর স্টল পাওয়া না পাওয়া নিয়ে এক তোরজোর দেখা গিয়েছিলো এবং স্টল বরাদ্দ না দেয়ায় প্রকাশনীর কর্ণধার সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা নিজেরা অনলাইন মেলা ঘোষণা করে ১ (এক) কোটি টাকার বই সেল করার টার্গেটে নেমেছিলো। বাংলা একাডেমী তাদের বইকে মানহীনতার কারণে স্টল না দেয়ায় তারা এই ঘোষণা দিয়েছিলো। নিজেদের একক প্রচারণা এবং একাডেমির কাছে নিজেদের সক্ষমতা প্রকাশের জন্য বিভিন্ন ধরণের ছাড় কুপন এবং পুরস্কারের মাধ্যমে তাদের সেই অনলাইন মেলাকে জমজমাট এবং মাদরাসা এবং ইসলামী পাঠক কেন্দ্রিক মহলে সাড়া জাগিয়েছিলো।

সেই একক তোরজারের কারণে তাদের অনলাইন ফলাফল হিসেবে তারা সার্থক হয়। তবে সবচে দুঃখ ও হতাশ লাগে তখন, যখন দেখি সেই গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্সই বায়তুল মোকাররমের ইসলামী বইমেলায় স্টল না পেয়েও তেমন তোরজোর ও সোস্যাল মিডিয়া গরম করার মতো রমরমা অফারপূর্ণ কোনো স্ট্যাটাস দেয় না। বরং অন্য নামে অথবা টাকার বিনিময়ে অন্যদের থেকে স্টলের ভাগ নেয়। আর ওই স্টলের ব্যানারের এক পাশে ছোট্ট করে ‘এখানে গার্ডিয়ানের বই পাওয়া যায়’ লেখা থাকে। এসব কী ধরণের সমাজ সেবা? একটি স্বনামধন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের এ কেমন দ্বিচারিতামূলক কার্যক্রম সেটা বোঝার মতো হয়ত এ দেশের মানুষের সে মস্তিষ্ক তৈরী হয়নি এমন বলা ছাড়া তাদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখা মুশকিল।

একজন ক্রেতার সাথে কথা বলার সুযোগ হলে তিনি বলেন, এখান থেকে কী বই কিনবো? সরাসরি বাংলাবাজার থেকেই কিনি। এখানে দামটাও বাড়তি রাখে। সবধরণের বইও পাচ্ছি না। আবার অনেক কর্মীদের ব্যবহারও ভালো না। তাই ঘুরে চলে যাচ্ছি।

একজন চাকুরীজীবি ক্রেতা আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ছোট জায়গায় মেলা। তাও খুব একটা পরিচ্ছন্ন না। মেলার মাঝেই হকাররা ভাসমান দোকান বসিয়েছে। মেইন গেটের সামনে বাইক পার্কিং করেছে। একটা মেলায় যদি এসব সাধারণ বিষয়ের প্রতি খেয়াল না করা হয় তাহলে মেলা কীভাবে হবে? এছাড়াও ইসলামী বইমেলা নামকরণে এ মেলা ইসলাম তো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিপাটির কথাও বলে। এখানে আশানুরূপ তেমন পেলাম না। এটা দুঃখজনক।

এক স্টলকর্মী জানান, মেলায় যারা দায়িত্বশীল আছে তাদের আরো বেশকিছু গঠনমূলক উদ্যোগের প্রয়োজন। তা না হলে মেলার উন্নতি সম্ভব না। এছাড়া বর্তমান সময়ে মানুষের যে অসহনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সেই দিক থেকেও ক্রেতাদের বইয়ের প্রতি চাহিদাটা তুলনামূলক কম। আর আমরা আগের মতো মান ঠিক রেখে স্বল্প মূল্যে বই পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারি না।

এ ব্যাপারে আরো কিছু আলোচনায় যোগ করতে কথা হয় বাংলাবাজরের স্বনামধন্য অনলাইন বই ব্যবসায়ী বন্ধু বুকশপের প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার সিফাত ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি মনে করি প্রকাশকদের অবহেলা। বছর কয়েক আগে যখন মেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য একযোগে একত্রে সবাই মেলার আয়োজন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো ঠিক সেইভাবে প্রত্যেকটা বিষয় প্রকাশকরা তাদের অধিনস্ত কর্মীদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে তখন এসব জটিল বিষয়গুলো অনেক সহজে সমাধান সম্ভব। অধিনস্ত কর্মীদের মতামত এ ব্যাপারে খুব জরুরী। কারণ, তারাই সরাসরি মার্কেট, কাস্টমারসহ সবকিছুর দেখভালের দায়িত্বে থাকেন। তারা জানেন মানুষ কী চায়। তারা কাস্টমার বা পরিস্থিতির সামাল দিতে জানেন। এজন্য তাদের মতামত খুব জরুরী।

অনেক সাধারণ শিক্ষিত মানুষ এ পেশায় জড়িত। তবে ইসলামী টাওয়ারসহ আরো বেশকিছু মার্কটে অনেক মানুষ আছেন তারা কওমী বা মাদরাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের। তারা এই পেশায় বেশি জড়িত। বিশেষ করে অনেকে প্রকাশক হিসেবেও আছেন। এসব ইসলামী প্রকাশনাগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাদের জন্য এটা বইয়ের মাধ্যমে ইসলামকে রিপ্রেজেন্ট করার একটা প্রয়াস। তবে ইসলামকে মানুষের কাছে রিপ্রেজেন্ট করতে গিয়ে তারা ভুলে যায় তার প্রকাশনায় তারই অধিনস্তরাও মানুষ। তাদের কাছে আর ইসলামের রিপ্রেজেন্ট করা হয় না। তারা কর্মপরিমাণ মূল্যের বেতনের পরিবর্তে কম বেতনভুক্ত করে লোক নিয়োগ নেন। এবং যে পরিমাণ সময় বা কাজের পরিধির কথা বলে কাজে নেন তারচেয়ে বেশি সময় এবং কাজ করান। এবং তার পরিবর্তে অতিরিক্ত বাড়তি বেতন বা বোনাস পরের কথা! নূন্যতম সম্মানটুকুও দেন না। অনেক প্রকাশনী হয়ত করে থাকেন। কিন্তু সবসময় সেটা পালন করেন না। এসব বিষয়েও কর্মীদের মনে ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে জীবনের কষাঘাতে চলতে থাকেন।

এ নিয়মের তালাটা আগে ভাঙা জরুরী। বইয়ের মাধ্যমে ইসলামের রিপ্রেজেন্টের নামে ইসলামী মানবাধিকারের যে লুণ্ঠন হচ্ছে। সেটা ঠিক করাই এখন বড় রিপ্রেজেন্টের বিষয়।

প্রকাশকদের এই দায়সারা মনোভাব থাকলে এবং নিজেদের ভিতরে গঠনমূলক সংস্কার না আনলে ইসলামী মেলাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা, মেলার নামে নিজেদের ইজ্জতের ধুলিস্যাত ছাড়া আর কিছুই না। ফাউন্ডেশনের কাঁধে সমস্ত দোষ চাপানোর সুযোগ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে দোষ ইসলামী বই মেলার সৃজনশীল প্রকাশনীদের। নিজেদেরকে যেভাবে একুশে বইমেলায় মূল্যায়ন করতে চায় ঠিক সেভাবে এখানেও যদি নিজেদের মূল্যায়ন করে তাহলে একুশে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পাওয়া না পাওয়ায় কোনো ক্ষেভ থাকবে না। কিন্তু বর্তমান সময়ে যা চলছে সেটাকে এখন নাটকীয়তা ছাড়া অন্যকিছু বলা যায় না।

ইসলামী বইমেলা বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার স্টলের সৌন্দর্যবর্ধনে এগিয়ে থাকবে ইলহাম, সত্যায়ন, হুদহুদ, ঐতিহ্য ও নির্বাচিত প্রকাশনীর স্টল।

 

লেখক: তামীম আব্দুল্লাহ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *