- মাওলানা রুহুল আমিন সিরাজী
মানুষের জীবনে সবচে’ কাম্য ও আরাধ্য বিষয় হলো শান্তি ও নিরাপত্তা। ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে শান্তি এবং স্বস্তিতে জীবন কাটানোর জন্যই তার সব প্রয়াস, যতসব আয়োজন। পৃথিবীময় শান্তি শৃঙ্খলার নামে যত সমারোহ চোখে পড়ে সবই আবর্তিত হয় একই উদ্দেশ্যে। মানবসৃষ্টির প্রথম থেকে এই নিয়েই মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টা, যত সংগ্রাম আর সীমাহীন সাধনা। ইসলামী মূল্যবোধের মূল স্তম্ভ বা বুনিয়াদ হলো ঈমান।
ইসলামী মূল্যবোধের মূল স্তম্ভ বা বুনিয়াদ হলো ঈমান।
এই পরিভাষাটি আমনুন ধাতু থেকে উদগত, যার আভিধানিক অর্থ হলো নিরাপত্তা, ঈমানের অধিকারী একজন মুমিন সে নিজে যেমন নিরাপত্তা লাভ করে যাবতীয় অকল্যাণ ও কষ্ট যাতনা ক্ষতি থেকে তেমনি সে অপর জনকেও সমূহ অকল্যাণ ও দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে দান করে সার্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা। যে মানুষ অন্যের নিরাপত্তা বিধান করে না সে প্রকৃত অর্থে মুমিন পদ বাচ্যে বিবেচিত হতে পারে না। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিন হলো সে-যার থেকে অন্য মানুষের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ। সুতরাং ব্যাপক অর্থে শুধু মানুষ নয় সকল সৃষ্টির কল্যাণ সাধন উপযোগিতাই একটি জাতির, একটি বস্তুর, একটি আদর্শের টিকে থাকার মূলমন্ত্র। পৃথিবীতে টিকে থাকার এবং অস্তিত্বের স্থিতি-নির্ভর এই শাশ্বত দর্শনের উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে। আর যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, যা মানুষকে উপকৃত করে তাই টিকে থাকে পৃথিবীতে।
ইসলাম দুর্বলের ওপর সবলের আগ্রাসী মনোভাবকে সর্বদা প্রত্যাখ্যান করেছে
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট বিষয় যে পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যা কিছু অন্তরায় হবে, মানুষের কল্যাণকামিতা যাদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। ইসলাম দুর্বলের ওপর সবলের আগ্রাসী মনোভাবকে সর্বদা প্রত্যাখ্যান করেছে। উপরন্তু-অধিকার বঞ্চিত, আক্রান্ত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে প্রয়োজনে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুমতি প্রদান করে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে। যারা আক্রান্ত তাদের অনুমতি দেয়া হলো সশস্ত্র প্রতিরোধের, কারণ এরা মজলুম নিপীড়িত। (সূরা হজ: ২২ ও ৩৯)
ইসলামের ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কায়েমী স্বার্থবাদী তৎকালীন মক্কার পৌত্তলিক কুরাইশের অত্যাচার অশান্তি শোষণ নিপীড়নে বাধ্য হয়ে মুসলমানদের হিজরত করতে হয়েছিল মদীনায়। মক্কার আগ্রাসী শক্তি সেখানেও তাদের নিরাপদে বসবাস করতে দিতে সম্মত ছিল না। তারা শান্তিকামী দুর্বল মুসলমানদের সুশীল সমাজকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্যে নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে। সূদূর সিরিয়া থেকে তারা দফায় দফায় অস্ত্র সংগ্রহ করে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মানসে বিপুল শক্তির সমাবেশ ঘটায়। মূলত মক্কার পৌত্তলিক সেই আগ্রাসী জালিম শক্তিকে প্রতিহত করতে যেয়ে চরম হীনবল অবস্থায় বদর প্রান্তরে উপনীত হয় মুমিনদের একটি ক্ষুদ্র দল। নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকার, জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্তিসহ স্বাধীন সার্বভৌম আবাসভূমি শত্রুমুক্ত করার মহান লক্ষ্যে মুক্তিকামী মুসলিমবাহিনী সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে সে দিন ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলার অপার সাহায্যের দরুন আগ্রাসী শক্তির চরম পারাজয় ঘটে।
আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ইসলামের স্বীকৃত ধারাবাহিক স্বাধিকার আন্দোলনের একটি অংশ
ইসলামের দৃষ্টিতে মজলুম মানবতার মুক্তি সংগ্রাম তাই স্বীকৃত একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে ইসলাম যারা অত্যাচারিত ও নিপীড়িত তাদের অনুমতি দিয়েছে শোষক ও জালিম পশু শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার, পৃথিবীর কোনো শান্তিকামী সুশীল সমাজ কখনো এই অধিকারকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। জালিম আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান পবিত্র কুরআনে তাই ইরশাদ হয়েছে: কী হলো তোমাদের? সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছ না আল্লাহর পথে, অসহায় নর নারী ও শিশুদের রক্ষাকল্পে যারা ফরিয়াদ করছে। প্রভু হে জালিম অধিবাসী অধ্যুষিত এই জনপদ থেকে আমাদের বের হওয়ার উপায় করে দাও। তোমার পক্ষ থেকে আমাদের (রক্ষাকল্পে) কাউকে অভিভাবক বানাও আর কাউকে তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সহায় বা সাহায্যকারী বানাও (সূরা নিসা-৪:৭৫)
বলা বাহুল্য আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ইসলামের স্বীকৃত ধারাবাহিক স্বাধিকার আন্দোলনের একটি অংশ। বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল যে কোনো বিচারে একটি অসম সংগ্রাম।
লেখক : প্রাক্তন সহযোগী সম্পাদক, মাসিক পাথেয়
মাসিক পাথেয়, ডিসেম্বর, ২০১২ প্রকাশিত