ঈদ এলেই  দুশ্চিন্তা ফিটনেসবিহীন বাস

ঈদ এলেই দুশ্চিন্তা ফিটনেসবিহীন বাস

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঈদ এলেই সড়ক-মহাসড়কে বাড়ে ফিটনেসবিহীন বাসের দৌরাত্ম্য। দূরপাল্লায় চলতে গিয়ে অনেক সময় বিকল হয়ে পড়ে এসব বাস। এতে দীর্ঘায়িত হয় যানজট। আবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটে। যাত্রী অধিকারসম্পর্কিত সংগঠনগুলো বলছে, এবারের ঈদেও রাস্তায় নেমেছে ১৫ হাজারের বেশি ফিটনেসবিহীন বাস। এসব গাড়ির কারণে ঈদযাত্রায় ভোগান্তির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

দেশে ফিটনেসবিহীন বাসের সংখ্যা কত, এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে সংস্থাটির যানবাহন নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার ঘেঁটে দেখা গেছে, সারা দেশে নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ৪৪ হাজার ৮৩২। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৭৭৮টিরই নিবন্ধন হয়েছে আট বছর বা তারও আগে। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এবারের ঈদকে লক্ষ্য করে অন্তত ১৫ হাজার বাস সড়ক-মহাসড়কে নেমেছে।

এবারের ঈদযাত্রা নির্বিঘœ রাখতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা ফ্লাইওভার সাইট অফিস, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, ফেনী সার্কিট হাউজ, মেঘনা ঘাট ও ঢাকায় বিআরটিএর সদর কার্যালয়ে একাধিক প্রস্তুতি সভা করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং বিআরটিএর কর্মকর্তারা। সব কয়টি সভায়ই ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন এসব সংস্থার কর্তারা।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও সড়কে যানজটের জন্য ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে দায়ী করেছেন। ঈদ প্রস্তুতি সভাগুলোয় তিনি মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি কোনো অবস্থায়ই রাস্তায় নামানো যাবে না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় বিকল হয়ে যানজট সৃষ্টি হলে বা দুর্ঘটনায় পড়লে তার দায় এড়ানো যাবে না। এ সময় ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত ও জনবল সংকটের কথা বলেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে পাঁচ হাজারের বেশি বাস চলাচল করছে। রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা এসব বাসের সিংহভাগই লক্কড়-ঝক্কড়। এ লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলোর বড় একটা অংশ প্রতি ঈদেই উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচল করে।

হাইওয়ে পুলিশ, পরিবহনচালক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলো প্রধানত দুভাবে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমটি হলো, ব্যস্ত সড়কে বিকল হয়ে পড়া। ঈদের সময় রাস্তায় প্রচুর যানবাহনের চাপ থাকে। এ অবস্থায় রাস্তার মাঝে কোনো গাড়ি বিকল হলে তা রেকার দিয়ে সরাতেই ১ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় লাগে। এ সময়ে সড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট, যা স্বাভাবিক হতে লেগে যায় আরো কয়েক ঘণ্টা।

দ্বিতীয়টি হলো দুর্ঘটনা। ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। ব্রেক, চাকা, স্টিয়ারিং, গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পার্টস দুর্বল থাকায় চালক অনেক সময়ই ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ফলে ঘটে দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কয়েক দিনে সারা দেশে ২০৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ২৭৪ জন। আহত হয় আরো ৮৪৮ জন। বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদপত্র এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সংগঠনটি। তাদের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় তিন লাখ ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল করছে। এর মধ্যে অন্তত ১৫ হাজার ফিটনেসবিহীন বাস ঈদ উপলক্ষে রাস্তায় নামছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, আমাদের দেশে ২০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধসহ সড়কে বিশৃঙ্খলা এড়াতে ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে বিআরটিএর মনিটরিং ব্যবস্থা বেশ দুর্বল বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক-মহাসড়কে সাধারণত দুই ধরনের সমস্যা হয়। একটি কাঠামোগত, আরেকটি পরিচালনাগত। ভাঙাচোরা সড়ক, মোড়, গতিরোধক, টোলপ্লাজা, হাটবাজারসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো কাঠামোগত সমস্যার মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে ট্রাফিক আইন না মানা, বিশৃঙ্খলা, এক চালক দিয়ে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানো, ফিটনেস ইস্যু ইত্যাদি পরিচালনাগত সমস্যায় পড়ে। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির ইস্যুকে সড়ক-মহাসড়কে যানজট ও ভোগান্তির অন্যতম কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি কারিগরিভাবে কোনোভাবেই দূরপাল্লায় চলাচলের উপযোগী নয়। তার পরও প্রতি ঈদেই রাস্তায় এগুলোর চলাচল লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়ে। তিনি বলেন, ঈদ এলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর এ বিষয়ে টনক নড়ে। তারা বৈঠকের পর বৈঠক করে সমস্যাগুলো মাত্র কয়েক দিনের জন্য ঠেকা দেয়ার চেষ্টা করে। যদিও এ সমস্যা সমাধানে এখন পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি কোনো উদ্যোগ আমার চোখে পড়েনি। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের উদ্যোগ না নেয়া হলে কোনোভাবেই রাস্তা থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি তুলে দেয়া সম্ভব হবে না।

সড়ক-মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল রোধে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালুর পরামর্শ দিয়ে ড. শামছুল হক বলেন, উন্নত দেশগুলো এটি চালু করে উপকার পেয়েছে। আমাদের দেশেও যদি করিডোরভিত্তিক, কোম্পানিভিত্তিক রুট ভাগ করে দেয়া হয়, তাহলে কমসংখ্যক বাস দিয়েই জনগণ স্বস্তিতে যাতায়াত করতে পারবে। নিরাপদে যেতে পারবে। বিশৃঙ্খলা যেমন হবে না, তেমনি যানজটও হবে না।

এদিকে ঈদে সাধারণ মানুষের যাতায়াত নির্বিঘœ রাখতে এবং ফিটনেসবিহীন যান চলাচল রোধে সারা দেশে বিআরটিএর ৭০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত সক্রিয় থাকবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঈদের সময় মানুষের মুভমেন্ট বেড়ে যায়। মানুষের মুভমেন্ট বাড়লে গাড়ি চলাচলও বাড়ে। তবে আমরা বিআরটিএর পক্ষ থেকে রাস্তায় আনফিট গাড়ির চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহিত করছি এবং এসব গাড়ির চলাচল রোধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। দেশের প্রত্যেক জেলার অধীনে একটি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত, ঢাকায় পাঁচটি ও চট্টগ্রামে আরো একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল রোধে সক্রিয় থাকবেন।

____________

patheo24/105

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *