ঈমান

ঈমান

  • আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ  

প্রতিদিন চোখ খুললেই আমি আমাকে দেখতে পাই। আয়নার সামনে দাঁড়াই অতি সুন্দর অবয়বের একটা মনোরম চেহারা ভেসে ওঠে। প্রশস্ত কপাল, মনোহর দুটো চোখ, বিস্ময়কর কৌশলে নির্মিত দুটো কান, একটা নাক, দু’ধারে পেলব মসৃণ দুটো কপোল, কি সুন্দর দুটো ঠোঁট, চিকন চিবুক, তুলনাহীন অবয়ব, ‘আহসানি তাকবীম’ সুন্দরতম গঠনের এক লাবণ্যমাখারূপ, চমৎকৃত হই। হাসলে শুভ্র সুন্দরম দু’পাটি দাঁত আমাকে আরো মনোহর করে তুলে। চুলে চুলে পরিপাটি মাথা, ক্রমে নিচে নেমে যাই গ্রীবাদেশ, প্রশস্ত বক্ষ, মসৃণ পিঠ, পেলব মাংসল বাহুদেশ, ধরার স্বাভাবিক সুবিধামণ্ডিত অঙ্গুলিরাজি, নিতম্ব, উরু, শক্ত দুটো পা, পাতা বিছানো হাঁটার উপযুক্ত পদতল।
সর্বত্র ভারসাম্যপূর্ণ আঙ্গিক কাঠামো, অপূর্ব শৈলিমণ্ডিত দেহকান্তি, মসৃণ সতেজ বর্ণময় চামড়ায় আচ্ছাদিত। প্রতিটি যথাযথভাবে এবং যথাস্থানে। ভাবতে পারি নাকটা যদি পিঠে হতো, চোখ দুটো যদি কপালের উপর স্থাপিত হতো, মাথাটা যদি পায়ের জায়গায় আর পাটা যদি মাথার জায়গায় উল্টোভাবে হতো, তবে কী কিম্ভুতকিমাকার হতো আমার অবস্থা!
এই দেহ কান্তির ভেতরে আরেক অপরূপ মহারাজ্য। ফুসফুস, পিত্ত, দিল, কিডনি, গুরদা, কণ্ঠনালী আরো কত কী! কংকাল হাড্ডিসমূহের সুসমঞ্জস বিন্যাস, সারা দেহে ছড়িয়ে আছে নদীর মতো নানা ধরনের ধমনী, মাংসপেশীসমূহের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। পরিপাকতন্ত্র, মগজ-মস্তক, হার্ট, শ্বাসনালী ও খাদ্যনালী একই সাথে সন্বিবেশিত, চামড়ার ভেতর সে আরো বেশী সুন্দর এক জগৎ। বাইর থেকে ভেতর আরো কত সুন্দর, আরো কত মনোহর!
এক ডাক্তার সাহেব আমাকে বলেছিলেন, প্রথম যখন আমাদের প্রশিক্ষণের জন্য অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলো। একটা রোগীর পেট কাটা হলো। ইয়া আল্লাহ! এত সুন্দর করে অঙ্গগুলো সাজানো যে মনোহরিত্বে বিস্মিত হয়ে গেলাম। একেকটার একেক রং, সবুজ, হলুদ, মেটে, কালচে, যেন বিভিন্ন রঙের এক পুষ্পস্তবক উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সৌন্দর্য মহিমায় বিমূঢ় হয়ে রইলাম।
এক একটা লোমকূপেরও যে কত কাজ এর হিসাব কে দেবে? কত আশ্চর্য বর্জ্য নিষ্কাষণ ব্যবস্থা! এক একটা বিষয় কতভাবে কত ধরনের কাজ করে আসছে।

শুধু কি তাই, জীবাত্মা তার উপর আরো আছে রূহ পরমাত্মা। সব কিছুর কেন্দ্রভূম। সারা শরীরে ব্যাপ্ত চেতনাবোধ, হৃদয়ের মানস চৈতন্য, ইন্দ্রীয়াদির শিহরণ, মস্তিষ্কের বোধনী, চক্ষুর দৃষ্টিগ্রাহ্যতা, কর্ণের শ্রবণ যোগ্যতা, কথা বলার ভাববিনিময়ের কতই না উপকরণ। আরো আরো কত কি কেউ জানে না। কেউ আজও শুমার করতে পারেনি সব কিছু।
বিজ্ঞান বিশেষ করে মানব-শরীর-বিজ্ঞানের এত উন্নতির যুগেও কত জিনিস অজ্ঞাত, অনাবিষ্কৃত এখনও। এই মন সারাক্ষণ যা অনুভূত এরও কি খোঁজ পেয়েছে কেউ আজো? জ্ঞান তো খুবই সামান্য দেয়া হয়েছে আমাদের। সুবহানাল্লাযি আহসানুল খালিকীন, কতই না মহান সেই সুন্দরম পরম সৃজনকর্তা।
আয়না থেকে চোখটা ফিরিয়ে এবার একটু তাকাই বাইরের দিকে। বিস্তৃত আদিগন্ত প্রান্তর, উপরে উদার আকাশ, ঢেউ ভঙ্গুর অন্তহীন সাগর মহাসাগর, জমিন ছড়িয়ে গাছপালা, বৃক্ষলতাগুল্ম বনবনানী, কোথাও বা সবুজের মহিমা, কোথাও রুক্ষ মরুময় বালুকণা প্রান্তর, কখনও বা নাক উঁচু করে কঠিন দার্ঢ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের পর পাহাড়, কোথাও শুভ্র বরফ আচ্ছাদিত পর্বতশৃঙ্গসারি। হঠাৎ কলকল ধ্বনিতে বেয়ে পড়ছে জলরাশি, ঝর্ণা। নদী, মহানদী প্রবল প্রতাপে ধেয়ে চলছে সাগর মোহনায়। কখনও মার্তগুতাপে দগ্ধিত নিদাঘ দুপুর। কখনও রাতের আকাশের আলো চিকচিক তারকারাজি। কখনও মায়াময় স্নিগ্ধতায় চন্দ্র জ্যোতির্ময়, কখনও নিকষ আঁধারে ছেয়ে যায় আকাশ আর পৃথিবী, কখনওবা বর্ষণমুখর দিন, কখনওবা আকাশ নীলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা মেঘের ভেলা।
কত প্রাণী, কত পাখপাখালি, কত জানা অজানা পোকামাকড়, বাগানে প্রজাপতির মেলা, একেকটা একেক চেহারার, একেক গঠনের! কত বিচিত্র রূপের কী বিস্ময়কর সমাহার! কোনোটা চারপেয়ে আবার কোনোটা দু’পেয়ে। কোনটা বুকের উপর ভর করে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। কোনোটা চলে লম্ফ দিয়ে। আর কোনোটা ডানা মেলে দেয় উদার আকাশে। কত ধরনের, কত আওয়াজ, কতভঙ্গি, ভাবের অপূর্ব আদান প্রদান। প্রেম বাৎসল্যে সিক্ত আবার সংহারে ভীষণ রুদ্র। প্রজাপতির ডানায় কত রঙের মেলা। কত ঝড়বৃষ্টি, কত ধুলা বালি কিন্তু রঙের ঔজ্জ্বল্যে ম্রিয়মানতা নেই। রঙ তো ধুয়ে ফেলতে পারেনি কিছুই।

এত বৈচিত্র্যের মাঝেও কী এক মহা ঐক্য বেঁধে রেখেছে একই সুতোয়। প্রেমে বাৎসল্যে স্নেহে মরমিয়া প্রকাশে একই ধরনের অভিব্যক্তি আবার ক্রোধে জিঘাংসায় দ্রোহে একই ধরনের উদ্ভাসনা, একই রকমের প্রকাশ, ক্রুর, নিষ্ঠুর। কী আশ্চর্যম, বিনাশনে মৃত্যুতে সেই একই ধরনের পরিণতি! কত ধরনের গাছগাছালি পত্র পল্লব, ফলফলাদি, মিষ্টি, টক, নোনতা কত স্বাদের, কত ছাদের! কতনা পুষ্প-মালার উদ্ভাস। ফুলের পাপড়ির রঙ ঘষে মুছে বিবর্ণ করতে পারে না কেউ। কত রঙ কত বর্ণ! কত গন্ধ মেদুরতা শুমার করবে কে?
সাগর মহাসাগরের তলদেশে কত পাহাড় কত পর্বত, কত প্রাণী, কত সোনালী রূপালী মাছ কত আকার প্রকার তার! ফত রঙিন লতাগুল্ম! মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কত বিচিত্র গ্রহ উপগ্রহ, নক্ষত্র! কত গ্যালাক্সি কত সৌর জগৎমালা। ইয়ত্তা নেই, শেষ নেই। মহাশূন্যে সন্তরণশীল তীব্র বেগে ধেয়ে চলেছে অন্তহীনতায় স্ব স্ব কক্ষপথে। একচুলও যদি বিপত্তি ঘটে এর তবে মহাপ্রলয় অনিবার্য। পরিমিতভাবে সুনিয়ন্ত্রিত চলছে সব কিছু। ব্যত্যয় নেই, ব্যতিক্রমীয়তার সম্ভাবনা রহিত গতিপথ। একই ধারায় সঞ্চারমান সবাই, সকলেই।
আপনা আপনিই হয়ে গেল সব? মহাপরাক্রমশালী পরম ক্ষমতাধর কোন এক মহা সত্তার প্রজ্ঞাময় কোনো ইচ্ছা কি এর পেছনে ক্রিয়াশীল নেই? কোনো নিয়ন্তা নেই? সবই কি অনর্থক, কোনো সংবেদনময় উদ্দেশ্য নেই? লক্ষ্য নেই? বৃথা সবই?
এই সব কিছু কার জন্য? কার ভোগের জন্য এই পসরা। কার জন্য বিছায়েছে এই ডালা। কভু শীত, কভু গ্রীষ্ম, কভু বসন্ত, কভু বর্ষা, কভু হেমন্ত। ঋতুর এই ঘূর্ণন কার কল্যাণের জন্য? আকাশ বাতাস সাগর নদী ঝর্ণাধারা, গ্রহনক্ষত্র পত্রপল্লব, বনবনানী, পশু আর পাখপাখালি এ কার সেবায় সতত নিয়োজিত।
আমার, হ্যাঁ, আমার জন্যই সব। আমিই সব সৃষ্টির মুখ্য, সবার সাফল্য আমারি সেবায়। ঘোষণা দিয়েছেন, মহামহিম সব কিছুর সৃজনকর্তা যিনি, সব কিছুর জন্ম ও লালনপালন কর্তা যিনি,

سَخَّرَ لَكُمْ مَّا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ

তোমাদের জন্যই তো বাধ্যগত করে দিয়েছি যা আছে আকাশসমূহে আর যা আছে জমিনে। [সূরা লুকমান: আয়াত ২০]

Related Articles