ঈমান ও নাস্তিক্যবাদের দোলাচলে নাগিব মাহফুজ

ঈমান ও নাস্তিক্যবাদের দোলাচলে নাগিব মাহফুজ

আব্দুস সালাম : নাগিব মাহফুজ (নাজিব মাহফুজ) এর নাম শুনেননি এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আরবী সাহিত্য নিয়ে যাদের একটু আধটু আগ্রহ আছে নাগিব তাদের কাছে অতি ‘আপন’ একটি নাম। নাগিবের ভাষা অন্য দু’চারজন আরব সাহিত্যিকের মত নয়। শব্দ, বাক্য ও আলঙ্কারিক সুষমা ছাপিয়েও আলাদা এক সম্মোহন স্বীকৃত হয়ে ওঠে তার বর্ণমালায়।

যারা মানফালুতি, আক্কাদ আর তাওফিক আল হাকিমের শৈলীর সাথে নাগিবের শিল্পের মিল খুঁজতে যাবেন তারা প্রথমে বিভ্রান্তই হবেন। কারণ প্রথাগত আরবী সাহিত্যের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে ওয়েস্টার্ন আবহে ভিন্ন এক সাহিত্য জগত তৈরী করেছিলেন তিনি। এজন্যই অন্য দু’চারজন আরব্য সাহিত্যিকের সঙ্গে তাকে মেলানো যায়না ।

তিনি নিজেই স্বীকার করতেন যে, আইরিশ লেখক ও কবি ‘জেমস জয়েস’ জার্মান লেখক ফ্রাঞ্জ কাফকা ও খ্যাতনামা ফরাসি ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক মার্সেল প্রুস্ত তার সাহিত্যগুরু।

১৭ বছর বয়সে তার লেখালেখি শুরু। তৎকালীন বিখ্যাত পত্রিকা আর রিসালায় তিনি দেদারসে লিখতেন। তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। ১৯৫২ সালের জুলাইয়ে মিসরীয় বিপ্লবের আগে তার ১০টিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু তখনো তার লেখকস্বত্তার খ্যাতি বেশিদূর ছড়ায়নি। এরপর তিনি বেশকিছু বছর লেখালেখি বন্ধ রাখেন। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত তিন বইয়ের সিরিজ উপন্যাস ‘কায়রো ট্রিলজি’ তাকে সারাবিশ্বে পরিচিত করে তোলে। বই তিনটির মূল নাম ‘বাইনাল কছরাইন’ ইংরেজিতে ‘বিটুইন দ্য প্যালেসেস’, ‘আশ শাওক ইলাল কছর’ ইংরেজিতে ‘প্যালেস অব লঙিং’ ও আস সুক্কারিয়া বা ‘সুগার হাউস’। এখানে আরব কায়রোর শহুরে জীবনযাপনের চিত্র ফুটে উঠে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘আওলাদু হারাতিনা বা ‘চিল্ড্রেন অব গেবেলাই’ দিয়ে তার লেখালেখিতে পরিবর্তন আসে। রূপক ও প্রতীকের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিষয়াদি লেখায় তুলে ধরেন। এ সময়ে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো ‘দ্য থিফ এ্যান্ড দ্য ডগস’ (১৯৬১), ‘অটাম কুয়াইল’ (১৯৬২), ‘সাম টক অন দ্য নাইল’ (১৯৬৬) ও ‘মিরামার’ (১৯৬৭)। এ ছাড়া রয়েছে উল্লেখযোগ্য কিছু ছোটগল্প। তার কিছু গল্প, উপন্যাস বাংলায় অনূদিত হয়েছে।

পঁয়ত্রিশটির উপন্যাসের মধ্যে তার বিখ্যাত ও বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘চিল্ড্রেন অব গেবেলাই’ বা ‘আওলাদু হারাতিনা’ এটি একদিকে যেমন তাকে দুনিয়া জোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিলো অন্যদিকে নাস্তিক্যবাদীতার মুখোমুখিও দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো।

কিন্ত নাগীব নিজেই এই ব্যাখ্যা অস্বীকার করে বলেন, ‘আদৌ আমার মনে এমন উদ্দেশ্য ছিলো না, আমি একজন পরিপূর্ণ মুসলমান। নবী রাসূলগণের প্রতি আমি পরম ভক্ত ও শ্রদ্ধাশীল’।

মিশরের ‘আল আহরাম’ ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি ছাপছিলো, কয়েক পর্ব যেতে না যেতেই আযহারের কতক শায়খ ও কিছু তাকফির পন্থীর তীব্র বিরোধিতার মুখে এর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু প্রখ্যাত সাহিত্যিক আল আহরামের সম্পাদক হাসনাইন হায়কাল পুনরায় তা প্রকাশ করা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে লেবাননে এবং ২০০৬ সালে মিশরে উপন্যাসটি মলাটবদ্ধ ভাবে প্রকাশ পায়। এরই মধ্যে চল্লিশ বছর বইটি মিশরে নিষিদ্ধ ছিলো। ৮৮ তে যখন এই বইটিসহ মোট তিনটি বইয়ের কারণে নোবেল পুরস্কার পান তখন নাস্তিক্যবাদীতা ও কুফরিসহ নানান অপবাদ তার দিকে ধেয়ে আসে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন তাকে ঈমান ও নাস্তিক্যবাদিতার এই দোলাচলে পড়তে হয়?
এর কারণ হল বইটিতে রূপায়িত চরিত্রগুলো নিয়ে। এতে রয়েছে জিবিল্লাবী,আদহাম, কাসেম, জাবাল ও রাফাআহ নামের কয়েকটি চরিত্র।

অভিযোগকারীরা বলেন, বইয়ে উল্লেখিত ‘জিবিল্লাবী চরিত্রের মাধ্যমে আল্লাহকে, আদহাম বলে নবী আদমকে, কাসেম বলে নবী মুহাম্মাদ সা.কে জাবাল বলে নবী মুসাকে এবং রাফাআহ বলে নবী ঈসাকে বুঝানো হয়েছে, তারা বলেন লেখক এই নামের ছত্রে মূলত আল্লাহ এবং রাসূলদিগকেই হেয় করেছেন। আর এই অভিযোগেই তারা তাকে ‘কাফের আখ্যা দিয়েছেন।

কিন্ত নাগীব নিজেই এই ব্যাখ্যা অস্বীকার করে বলেন, ‘আদৌ আমার মনে এমন উদ্দেশ্য ছিলো না, আমি একজন পরিপূর্ণ মুসলমান। নবী রাসূলগণের প্রতি আমি পরম ভক্ত ও শ্রদ্ধাশীল’।

সাহিত্যবোদ্ধারা বলেন, বাস্তবতা হলো যারা তাকে কাফের আখ্যায়িত করেছেন কেউই তার বইয়ের বক্তব্য উপলব্ধি করতে পারেননি। সাহিত্য সমালোচনা শাস্ত্রের মানদণ্ডে বইটিকে বিচার করেননি, এমনকি লেখকের সাথেও এ নিয়ে কেউ সরাসরি আলোচনায় বসেননি। বইটির অন্তর্নিবিষ্ট মর্ম না বুঝেই উপরোক্ত কতক তাকফিরী সম্প্রদায়ের লোক তাকে কাফের ফতোয়া দেয় এবং তাকে হত্যা করা ওয়াজিব ঘোষণা দেন।

এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুজন যুবক তাকে হত্যা করতে তার ঘারে ছুড়ি চালায়, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। পরে সেই যুবকদেরকে তার কাছে আনা হলে তিনি ক্ষমা করে দেন এবং তাদেরকে শাস্তি না দিতে রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানান। পরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তারা “আওলাদু হারাতিনা” গ্রন্থের এক অক্ষরও পড়ে দেখেনি।

সাময়িকভাবে এই অপঘাত থেকে তিনি সুস্থ হলেও তার ঘাড়ের বামপাশের কয়েকটি রগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার দরুণ তার লেখালেখি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে ২০০৬ সালের আজকের এই দিনে (৩০ আগস্ট) নিভে যায় আরবী সাহিত্যের এই ধ্রুব তারা। সমাপ্তি ঘটে ৯৫ বছর বয়সের বর্ণাঢ্য ও সংগ্রামী জীবনের।

কায়রোর আলোঝলমলে জামালিয়া নগরীতে ১৯১১ সালে তার জন্ম, পারিবারিক আবহে শিক্ষা সাহিত্য ও দর্শনের প্রাথমিক সবক লাভ করেন। প্রথমে কায়রো ইউনিভার্সিটিতে দর্শন পড়েন। ইসলামী দর্শনের উপর একটি থিসিস পেপারও তৈরী করেছিলেন৷ পরবর্তীতে তিনি সাহিত্যের প্রতিই মনোযোগী হয়ে উঠেন। সব মিলিয়ে তার পয়ত্রিশটি উপন্যাস, দুইশ তেইশটি ছোট গল্প, সাতটি নাটক ও ছাব্বিশটি চিত্রনাট্য প্রকাশ পায়৷

নাগিবের উপন্যাসের হাত ধরে ইজিপশিয়ান ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে বড় পরিবর্তন আসে। বেদায়া নেহায়া, খান খলীলী, যিকাক আল মুদুন, সহ বেশ কিছু উপন্যাস সিনেমায় রূপান্তরিত হয়।

নোবেল ও মাজমাউল লুগাহসহ ছোটবড় বহু পুরুস্কারে তিনি পুরুস্কৃত হন। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করত মিশরের বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তার নামে পুরস্কারের প্রবর্তন করে। তন্মধ্যে ‘নাগীব মাহফুজ সাহিত্য পুরস্কার’  ‘নাগীব মাহফুজ উপন্যাস পুরস্কার ‘ ‘নাগীব মাহফুজ শিল্প সাহিত্য ও গবেষণা পুরস্কার’ উল্লেখযোগ্য।

____________________________________________________________________________________

লেখক: শিক্ষক, আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *