পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : গ্রামে শুরু হয়েছে শীতের আমেজ। রাতের কুয়াশা আর ভোরের শিশির ভেজা প্রকৃতি সেই কথাই বলছে। বাহারি সব পিঠে পুলির সুঘ্রাণে ম-ম করছে শীতের সকাল। এই মৌসুমকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ জনপদে কতশত আয়োজন, আর সেসব আয়োজনের প্রধান উৎস হলো খেজুরগুড়। গাছিরাও রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন খেজুর রস সংগ্রহের কাজে।
বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গুড়। শীতের ভোরে গ্রামীণ জনপদে খেজুরের রস সংগ্রহে বেড়িয়ে পড়েন গাছিরা। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উকি দেওয়ার আগেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি মটির চুলায় সেই রস জ্বাল করে গুড় তৈরি করা হয়। রস থেকে নানা ধরণের পাটালী এবং ঝোলা গুড় বানানো হয়।
চলতি মৌসুমজুড়ে চার জেলায় ২৪৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার খেজুরগুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি অফিসের।
কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, রাজশাহী অঞ্চলের চারটি জেলায় রস দেওয়ার মতো উপযোগী গাছের সংখ্যা ১৭ লাখ ১ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে রাজশাহী জেলায় ১১ লাখ ১২ হাজার ১০৬ টি গাছ, নওগাঁয় ১৬ হাজার, এদিকে নাটোরে ৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৫০টি এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১ হাজার ৫০টি ।
জানা গিয়েছে শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৫ দিন খেজুর রস সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত সময় ধরা হয়। এই সময়ে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ এসব গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ, গাছের পরিচর্যা এবং গুড় তৈরির কাজ করে থাকেন।
কৃষি অফিস জানিয়েছে , উপযুক্ত একটি গাছের রস থেকে ১৭ দশমিক ৪০ কেজি গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ১৬৩ টাকা কেজি দরে, ৯ হাজার ৬৪ মেট্রিকটন গুড়ের আনুমানিক বাজার মূল্য হয়েছে ১৪৮ কোটি ৬৪ লাখ ৩২ হাজার ৮৬০ টাকা, নওগাঁয় ১৫০ টাকা কেজি দরে ২৮০ মেট্রিকটনের দাম ৪ কোটি ২০ লাখ, এদিকে নাটোরে ১২০ টাকা কেজি দরে ৭ হাজার ৭৮৪ মেট্রিকটনের দাম ৯৩ কোটি ৪০ লাখ ৮০ হাজার এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৫০ টাকা কেজি দরে ১ দশমিক ৫ মেট্রিকটন গুড়ের আনুমানিক বাজার মূল্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা। সবমিলিয়ে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪৯ মেট্রিকটন গুড়ে ২৪৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাজার দর ধরা হয়েছে।
গাছিরা জানান, একজন গাছি প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করেন। শীত মৌসুমে ৭০ থেকে ৭৫ দিনে একটি খেজুর গাছ থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজি গুড় পাওয়াস যায়।
কৃষি অফিসের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৯ সালে এই অঞ্চলে রস দেওয়ার উপযোগী গাছের সংখ্যা ছিলো ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৩৬৬টি। গত ৫ বছরে সেই গাছ কমে ১৭ লাখ ১ হাজার ৫০৬ টিতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এই সময়ে ৮১ হাজার ৮৬৬টি খেজুর গাছ কমেছে। কমেছে গুড়ের উৎপাদনও। অথচ গত মওসুমেও গুড়ের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯৯৩ মেট্রিকটন।
গুরুদাসপুরের শহীদ সামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের কৃষি বিভাগের শিক্ষক জহুরুল ইসলাম জানান, দেশজুড়ে খেজুরের রস এবং গুড়ের আলাদা খ্যাতি রয়েছে। অথচ চাহিদা পূরণে খেজুরের গাছ রোপণের মাধ্যমে গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। কেবলমাত্র শীত পড়লেই সামনে আসে খেজুর গাছের কথা। সুস্বাদু খেজুরের গুড় গুরুত্বপূর্ণ মিষ্টান্নর চাহিদা পূরণ করলেও এই গুড় বাণিজ্যিকরণে ব্যাপকভাবে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না কৃষি অফিসের।
গাছিরা জানান, খেজুরের গুড়ের মৌসুম শুরু হলেই একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চিনি মিশিয়ে খেজুরের গুড় তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করেন। তাছাড়া দীর্ঘদিনের পচা পাটালি এবং ঝোলাগুড় মিশিয়েও গুড় তৈরি করা হয়। এতে করে খাঁটি গুড়ের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। তারা ভেজাল গুড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নজরদারি দাবি করেছেন।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক শাসছুল ওয়াদুদ জানান, এই অঞ্চলের গাছিরা ইতোমধ্যে রস সংগ্রহ করে গুড় উৎপাদন শুরু করে দিয়েছেন। খেজুরের উৎপাদন এবং বিপণনের বিষয়ে তারা কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন।