আমিনুল ইসলাম হুসাইনী ● ইস্পিতা আমারই ছাত্রী। পড়ছে নবম শ্রেণিতে। যেদিন থেকে ও জানতে পারলো আমি একটু-আধটু লেখালেখি করি, সেদিন থেকেই ওর এই আসা-যাওয়ার শুরু। ফারজানার মা মানে আমার স্ত্রী যদিও তা মেনে নিয়েছে, কিন্তু পাড়াপড়শিরা যেসব কথা রটাচ্ছে, তাতে যে সে খুব একটা বিব্রত বোধ করছে না তাইবা কী করে বলি? দিন দিন পরিস্থিতি মন্দের দিকেই যাচ্ছে। আমি পড়েছি মহা বিপাকে। ইস্পিতাকে না বারণ করতে পারছি, আর না পাড়াপড়শির মুখ বন্ধ করতে পারছি। ওমা একি! ওর নাম বলতেই যে ও হাজির।
কেমন আছেন স্যার?
হ্যাঁ ভালো। তুমি?
আমিও ভালো।
আচ্ছা তোমার মায়ের কী অবস্থা?
এখন কিছুটা সুস্থ। স্যার আপনার জন্য একটা উপহার এনেছিলাম।
ইস্পিতার এ কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেও তা প্রকাশ করলাম না। বরং আঁড় চোখে লক্ষ্য করলাম ওর হাতের দিকে। দেখি ওর হাতে নীল মলাটের একটি ডায়েরি। ইস্পিতা বলেÑ
এটা আমার মরহুম বাবার লেখা। বাবা আমাকে ডায়েরিটা দেয়ার সময় বলেছিলেন, এটাতে আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক দামী বারতা রয়েছে। পারলে এটা প্রকাশের ব্যবস্থা করিস। আমি তো আর প্রকাশ করতে পারবো না তাই আপনাকে দিয়ে দিলাম। আমার বিশ্বাস এটা পড়লে আপনি হয় তো কিছু একটা করবেন। সেই বিশ্বাস থেকেই আপনার পেছনে লাগা।
রাতে ইস্পিতার দেয়া ডায়েরিটা নিয়ে বসি। দু’পৃষ্টা উল্টাবার পরই নজরে এলোÑ
তারিখ : ১৮.১১.২০০১
মীরবাড়ির ঠিক উত্তর পশ্চিমে জোড়া দিঘীর দক্ষিণ পাড়েই শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মীর নেছার উদ্দীন সাহেবের লাগানো তালগাছটি। মীর নেছার উদ্দীন গত হয়েছেন প্রায় সত্তর বছর আগে। তারই ছোট ছেলে মীর কফিল উদ্দীন গাছটির বর্তমান অভিভাবক। বয়সের ভারে তিনিও কুঁজো হয়ে গেছেন, কিন্তু কুঁজো হয়নি শত বছরের এই তাল গাছটি।
বন্ধু সাব্বির আর ফটো সাংবাদিক আরিফ ভাইসহ আমরা তিনজন হাজির হলাম মীরবাড়ির আঙিনায়। আমাদের দেখে ছোট মীর (কফিল উদ্দীন) খুব খুশি হলেন। আমাদের সাথে মোসাফাহা করার সময় তিনি জিজ্ঞেস করলেনÑ
আসতে কোনো সমস্যা হয়নিতো?
না না। তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।
হুম তাতো বলবেনই। ফরমালিটি বলে কথা!
আমি অবাক হলাম ছোট মীরের গলার জোর দেখে। বার্ধক্য তার শরীরকে কুঁজো করতে পারলেও গলাকে কাবু করতে পারেনি। তিনি বেশ জোড়ালো গলায় বলেনÑ
রাস্তা-ঘাটের যে অবস্থা, তাতে যে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে তাকি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
আমরা তিনজনই মৃদু হাসলাম। ছোট মীর পূণরায় জিজ্ঞেস করলেনÑ
আপনারা কি ঘুরতে এসেছেন?
আমরা আসলে আপনার কাছেই এসেছি। যতোদূর জানি, আপনি একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। এদেশকে স্বাধীন করতে আপনি অনেক কুরবানি দিয়েছেন। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্টে আপনারই নাম আসেনি। কিন্তু কেন? আপনি কি ইচ্ছা করেই তালিকায় নাম দেননি? নাকি আপনার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে? তা জানতেই আমরা এখানে এসেছি। আমরা আপনাকে তুলে ধরতে চাই। আমাদের বিশ্বাস আপনি আমাদের নিরাশ করবেন না।
আপনারা কি সাংবাদিক?
তা বলতে পারেন। তবে অতোটা প্রফেসনাল না। আসলে ভালো কিছু করার লক্ষ্যেই আমরা তিন বন্ধু জোট হয়েছি। য্দ্ধু করার সৌভাগ্য তো আর আমাদের হয়নি, তাই যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের সেবা করার মানসেই আমাদের এই ক্ষুদ্র কর্মসূচি।
হুম! বেশ ভালো। চলুন দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে। আমি আবার ক্ষুধা সহ্য করতে পারি না।
এতো মনোযোগ দিয়ে কী এমন মহাকাব্য পড়ছো শুনি?
ফারজানার মার গলার স্বর শুনে বুঝলাম এখনই ডায়েরিটা বন্ধ করতে হবে। নতুবা… না, তা বলা যাবে না। তারচে বরং ডায়েরিটাকেই সাময়িক ছুটি দিয়ে দিই। তাহলে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। ডায়েরিটা বন্ধ করে একটা মেকি হায় তুলে বলিÑ
এই তো, ইস্পিতার দেয়া ডায়েরিটা।
কী লেখা আছে এতে?
তেমন কিছু না।
টেবিলে সেই কখন খাবার দেয়া হয়েছে। খাবারগুলো যে নষ্ট হচ্ছে সে খেয়াল আছে?
এই তো আসছি।
ফারজানার মা চলে যেতেই পুনরায় ডায়েরিটা খুলে বসি।
‘আসর নামাজ শেষে ছোট মীর আমাদের নিয়ে তালতলায় বসেন। ছোট মীর তালগাছের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলেনÑ
এই গাছটার বয়স কতো হবে বলতে পারবেন?
কতো হবে?
সাব্বির পাল্টা প্রশ্ন করে।
একশ বছর।
একশ বছর!
হ্যাঁ, একশ বছর।
আচ্ছা আপনারা কী যেন জানতে চাচ্ছিলেন?
আপনার যুদ্ধের কথা।
ও! হ্যাঁ।
ছোট মীর আবারো তালগাছটির দিকে তাকালেন। সেদিকে তাকিয়েই বলতে শুরু করলেনÑ
তখন আমি ত্রিশ বছরের যুবক। স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছি। বাড়িতে রেখে গিয়েছি বৃদ্ধা বাবা-মা
আর কিশোরি এক বোনকে। বোনের নাম জামিলা। তাদের জন্য খুব আতঙ্কে থাকতাম। কেননা হানাদারদের নৃশংসতা আজ এ গ্রাম তো কাল ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছিল। একদিন আমাদের গ্রামেও মিলিটারির বহর ঢুকলো। গ্রামের স্কুলকে করা হলো তাদের ক্যাম্প।
সেদিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই।
ফজরের আজান শেষ হওয়ার পরপরই আব্বা মসজিদে যাওয়ার জন্য রওনা হচ্ছিলেন, এমন সময় ছয়জন মিলিটারি আর দুজন রাজাকারের সমন্বয়ে একটি দল আমাদের বাড়িতে হানা দেয়। চারদিক থেকে ঘেরাও করে বাড়ির সবাইকে বের হতে বলে। মা তখনো বের হননি। আমার ছোট বোন জামিলা ভয়ে এতটুকুন হয়ে পড়ে। আব্বা ঘর থেকে বের হতেই ওরা আব্বার হাত পা বেঁধে ফেলে। মন্তাজ রাজাকার আব্বার কানের কাছে এসে বলেÑ
তুই শালা হাড়ামি আদমী। ঈমানদার সেজে বেইমানি কাজ করছিস।
বাবা জিজ্ঞেস করেনÑ
কী করেছি?
আহা! মনে হচ্ছে যেন কিছুই জানে না। শালা গাদ্দার কোথাকার। নিজে নামাজি হয়েও ছেলেকে মুক্তি বাহিনীতে পাঠিয়েছিস!
অন্যায় কী করেছি? দেশপ্রেমতো ঈমানেরই বহিঃপ্রকাশ।
ও শালা দেখছি সাচ্চা দেশপ্রেমিক। দাঁড়া তোর দেশপ্রেম ইয়ে দিয়ে বের করছি।
এ কথা বলেই সে পাক সেনাদের বলেÑ
ইয়ে শালা পাকিস্তানকা দুষমন। মুক্তিকা বাপ।
ব্যস, আর কিছুই বলতে হলো না তাকে। হানাদাররা বেনেট দিয়ে বাবাকে একের পর এক আঘাত শুরু করে। বাবার প্রতি এই নির্যাতন দেখে মা আর চুপ করে ঘর বসে থাকতে পারেননি। ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ওরা মাকেও বাবার সাথে বেঁধে ফেলে। বাবা-মায়ের প্রতি এমন বর্বরোচিত নির্যাতনে চুপ থাকতে পারল না জামিলাও। সেও চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রাজাকারদের ইঙ্গিতে হানাদারদের নষ্ট নজর পড়ে জামিলার উপর। ওরা জামিলাকে জোর করে ঘরে নিয়ে যায়। জামিলা কেঁদে কেঁদে বলেÑ
আপনাদের পায়ে পড়ি, আমার এত বড় সর্বনাশ করবেন না।
নিষ্পাপ জামিলার অনুনয়ে শয়তানগুলোর মন নরম হলো না একটুও। জামিলা পুনরায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেÑ
আমার মতো আপনাদেরও তো কোনো না কোনো বোন আছে। আমি তো আপনাদের বোনেরই মতো।
ওরা পিশাচের হাসি দিয়ে বলেÑ
ইস ওয়াক্ত হামারা তোমহারা মেহমান। অর মেহমানকা দেমাগ ঠিক রাকনা হোমহারা লিয়ে ফরজ।
জামিলা যখন বুঝতে পারল, ওদের হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করা সম্ভম না, তখন ও খাটের নিচ থেকে দা বের করে নিজের গলায় লাগিয়ে দেয়। জামিলার আত্মত্যাগে ওরা সামান্যও বিচলিত হলো না। বরং আরো হিংস্র হয়ে ওঠল। ওরা বাবা-মাকে বাঁধা অবস্থাতেই বেনেট দিয়ে জর্জরিত করতে থাকে। হঠাৎ দুটি রাইফেল গর্জে উঠলো ঠা ঠা শব্দে। আমার বৃদ্ধা বাবা-মা কালিমা পড়তে পড়তে শাহাদাতবরণ করেন।
এতটুকু বলে ছোট মীর আবারো তালগাছটার দিকে তাকিয়ে দ্বীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলেনÑ
জানেন ওরা বাবা-মাকে এই তালগাছটার সাথেই বেঁধে ছিল। এই তালগাছ সেই ঘটনার অমর স্বাক্ষী। হানাদাররা চলে যাওয়ার পরপরই গ্রাম বাসি যেন ঝুপ থেকে বেরিয়ে আসে। ওরা বাবা-মা আর জামিলাকে এই তালগাছের নিচেই কবর দেয়।
রাত ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে?
ফারজানার মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পাই। ডায়েরিটা টেবিলে রেখে বিছানায় যেতেই ফারজানার মা লাইট অফ করে দেয়। পুরো ঘরে তখন অন্ধকারের রাজত্ব। আমার মনে প্রশ্নেরা উঁকি দেয়Ñ
এই অন্ধকার কি একাত্তরের অন্ধকারে চেয়েও বেশি?
যে অন্ধকারে হারাতে হয়েছিল শত সহস্র নিরপরাধ
বাঙালিদের। আমার চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে ছোট মীরের সেই শতবছরের তালগাছটি। আর কানে বেজে ওঠেÑ
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে,
উকি মারে আকাশে
মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়
একে বাড়ে উড়ে যায়;
কোথা পাবে পাখা সে?
মাসিক পাথেয়, ডিসেম্বর ২০১৭