এক বছরে ক্ষতি আট হাজার কোটি টাকা : বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড

এক বছরে ক্ষতি আট হাজার কোটি টাকা : বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বিদ্যুৎ খাতের ওপর চাপ তৈরি করছে। তেলভিত্তিক নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ক্ষতি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরেই উৎপাদন পর্যায়ে ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে বিপিডিবি। আগের অর্থবছর এ ক্ষতি ছিল ৪ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে অতিরিক্ত ৭০ পয়সা অনুদান হিসেবে চায় সংস্থাটি। উৎপাদন ব্যয় ও পাইকারি পর্যায়ে গড় বিক্রয়মূল্যজনিত আর্থিক ক্ষতি এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক সহায়তার একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে বিপিডিবি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য তৈরি ওই সারসংক্ষেপে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ক্ষতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পাঁচটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। এর অন্যতম আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের মূল্যবৃদ্ধি।

বিপিডিবি বলছে, আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলের মূল্য লিটারপ্রতি ১ টাকা বাড়লে এ বাবদ তাদের বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ১৭৫ কোটি টাকা। কারণ প্রতি বছর ১৭৫ কোটি লিটার ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে সংস্থাটি। বিপিডিবির হিসাবমতে, লিটারপ্রতি ফার্নেস অয়েলের দাম গত বছরের ৩০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ টাকা। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলেও বিপিডিবির ব্যয় বেড়েছে। নিজস্ব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানির মূল্য পরিশোধ ও বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ক্রয়কৃত বিদ্যুতের মূল্য ডলারের ভিত্তিতে পরিশোধ করতে হচ্ছে বিপিডিবিকে। সংস্থাটির দাবি, প্রতি ডলারের বিপরীতে ১ টাকা অবমূল্যায়নে তাদের ব্যয় বৃদ্ধি পায় ২৮৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, এক বছরে প্রতি ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৪ টাকা।

গ্যাসস্বল্পতার কারণে ডুয়াল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিজেলে পরিচালনা করতে হচ্ছে। এতেও বিপিডিবির ক্ষতি বাড়ছে। সংস্থাটি বলছে, বিপিডিবি, নর্থওয়েস্ট জোন পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ও সামিট মেঘনাঘাটের প্রায় ১ হাজার ৩৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ডুয়াল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিজেলে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতি ১০০ মেগাওয়াট ৪০ শতাংশ লোড ফ্যাক্টরে পরিচালিত হলে সংস্থাটির বার্ষিক ব্যয়বৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২০ কোটি টাকা।

গ্যাসস্বল্পতার পাশাপাশি বিদ্যুতের দ্রুত চাহিদা বৃদ্ধিও বিপিডিবির ক্ষতি বাড়াচ্ছে। সংস্থাটির মতে, সম্প্রতি এক হাজার মেগাওয়াট ডিজেলভিত্তিক ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্টসহ ৩ হাজার ৯৫৮ মেগাওয়াট তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন তাদের ক্ষতি বাড়াবে। এমনিতেই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনছে বিপিডিবি। নতুন করে আরো রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে। সেগুলোর সঙ্গেও উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করছে বিপিডিবি। এর মধ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জে হাই স্পিড ডিজেলভিত্তিক (এইচএসডি) ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন পেয়েছে এপিআর এনার্জি। কেন্দ্রটির উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য হবে প্রতি ইউনিট ১৯ টাকা ৯৯ পয়সা। কেরানীগঞ্জে এইচএসডিভিত্তিক মোট ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে অ্যাগ্রেকো ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্টস। এ কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১৯ টাকা ৬৭ পয়সায় কিনবে বিপিডিবি। উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে হবে ডলারে।

বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার কমে যাওয়াকে ক্ষতি বাড়ার আরেকটি কারণ হিসেবে দেখছে বিপিডিবি। সংস্থাটির দাবি, বিদ্যুতের পাইকারি বিক্রয়মূল্য (বাল্ক) ৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৮২ পয়সায় হ্রাস পাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। সব মিলিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছর উৎপাদন পর্যায়ে বিপিডিবির মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮ হাজার ৩১ কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে ইউনিটপ্রতি অতিরিক্ত ৭০ পয়সা সরকার কর্তৃক অনুদান হিসেবে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে বিপিডিবি। সংস্থাটির মতে, বর্তমান ক্ষতি থেকে উত্তরণে বিপিডিবির সব উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রকৃত বাল্ক সরবরাহ ব্যয় ও প্রকৃত পাইকারি বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যের অর্থ (ট্যারিফ গ্যাপ) মাসিক ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক বিপিডিবিকে অনুদান হিসেবে প্রদান করা প্রয়োজন।

বিপিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন, ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত বেশকিছু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হয়েছে, যেগুলো তেলভিত্তিক। এছাড়া ডলারের অবমূল্যায়ন ও এইচএফওর মূল্যবৃদ্ধির কারণেও ব্যয় বেড়েছে। পাশাপাশি গ্যাসের স্বল্পতা তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে বিপিডিবির ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। ঘাটতির অর্থ সমন্বয় করা প্রয়োজন। এজন্য পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে না।

বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ পর্যন্ত সংস্থাটির ঘাটতি বা ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। ঘাটতি এ অর্থের বিপরীতে ২০১৭ সালের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ক্রয়কৃত বিদ্যুতের ক্রয়-বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য বাবদ সরকার ঋণ হিসেবে দিয়েছে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর উৎপাদন পর্যায়ে ৪ হাজার ২৪২ কোটি টাকা ক্ষতির বিপরীতে বিপিডিবি সরকারের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পেয়েছে ৩ হাজার ৯৯৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা।

বিপিডিবির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাবের ভিত্তিতে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ বা ইউনিটপ্রতি ৭২ পয়সা বৃদ্ধির জন্য ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রাক্কলিত ব্যয় অনুযায়ী বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২২ শতাংশ বা ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৯ পয়সা। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিইআরসি জ্বালানিভিত্তিক উৎপাদন মিশ্রণ পরিবর্তনের সুপারিশ করে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি (লোড ফ্যাক্টর বৃদ্ধি) ও তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করে (লোড ফ্যাক্টর হ্রাস) এবং সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ডিজেলের পরিবর্তে ফার্নেস অয়েলে পরিচালনার বিষয়টি বিবেচনা করে বিপিডিবির প্রতি ইউনিটের গড় পাইকারি বিক্রয়মূল্য আগের ৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমিয়ে ৪ টাকা ৮৪ পয়সা নির্ধারণ করে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। নির্ধারিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় ৫ টাকা ৪৪ পয়সা ও নির্ধারিত বিদ্যুতের গড় বিক্রয় মূল্য (বাল্ক) ৪ টাকা ৮৪ পয়সার মধ্যে পার্থক্য দশমিক ৬০ টাকা সরকারের কাছে অনুদান হিসেবে চাহিদা প্রদানের জন্য বিপিডিবিকে নির্দেশ দেয় বিইআরসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে মাসিক ভিত্তিতে মোট পাইকারি বিক্রীত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দশমিক ৬০ টাকা হারে অনুদান প্রদানের জন্য সরকারের কাছে চাহিদা দেয় বিপিডিবি।

বর্তমানে গ্যাস স্বল্পতার কারণে তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় ও ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ডিজেল ব্যবহার হওয়ায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জুলাই-মার্চ পর্যন্ত বিপিডিবির প্রকৃত মোট সরবরাহ ব্যয় হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ১২ পয়সা। অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ইউনিটপ্রতি প্রকৃত গড় পাইকারি বিক্রয়মূল্য ৪ টাকা ৮২ পয়সা।

উল্লেখ্য, বিইআরসি কর্তৃক ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দেয়া এক আদেশে বিদ্যুতের গড় বিক্রয় মূল্য (বাল্ক) ৪ টাকা ৮৪ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও বিআরইবির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় (যার বিক্রয় মূল্য কম) ইউনিটপ্রতি প্রকৃত গড় বিক্রয় মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৮২ পয়সায়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. তাজুল ইসলাম বলেন, তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি। এ খাতে ভর্তুকি দেয়া না হলে ভোক্তাদের অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর। তরল জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমে আসবে। বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলো সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। মুনাফা রেখেই এ বিদ্যুৎ বিক্রি করছে তারা। অন্যদিকে সরকার ভর্তুকি দিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *