এদেশের মসজিদগুলোর দরজা নারীদের জন্য কবে উম্মুক্ত হবে?

এদেশের মসজিদগুলোর দরজা নারীদের জন্য কবে উম্মুক্ত হবে?

(পর্ব – ২)

  • ফাহমিদা মুন্নী

বিশবছর আগে মসজিদে জায়গা না পেয়ে, আমার মনে ইসলামে নারীর অধিকার বিষয়ে যে প্রশ্নের উদয় হয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমি খুব তাড়াতাড়িই পেয়েছিলাম।

২০০৩ সালে যখন আমি আমার স্বামীর সাথে হজ্জ্বে যাই, তখন পবিত্র কাবা শরীফ এবং মসজিদুন নববীতে পুরুষ মুসুল্লীদের পাশাপাশি এ পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে আগত লক্ষ লক্ষ নারী মুসুল্লীদের স্বতঃস্ফূর্ত ও অবাধ অংশগ্রহণ দেখে আমি যারপরনাই অভিভূত হয়েছিলাম এবং বুঝেছিলাম যে, ইসলাম নারীদের মসজিদে সালাত আদায় করা থেকে বঞ্চিত করেনি, বঞ্চিত করেছে ইসলাম সম্পর্কে হয় অজ্ঞ, আর না হয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী আমাদের তথাকথিত মুসলিম সমাজ।

পরবর্তীতে, ২০০৯ সালের রামাদান মাসে আমি আমার স্বামী-সন্তানসহ উমরাহ পালন করতে গিয়ে আরো অভিভূত হয়েছিলাম।

কারণ, আমি দেখেছিলাম যে, সম্মানিত এই মসজিদ দুটোতে নারীরা শুধু পাঁচ ওয়াক্ত সালাতই আদায় করে না, বরং, তারা পুরুষ মুসুল্লীদের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের মহান রবের সন্তুষ্টি ও ক্ষমা পাবার আশায় তারাবীহ’র সালাত এবং রমাদানের শেষ দশটি রাতে কিয়ামুল লাইলেও অংশ নেয়।

আমার লেখা পড়ে কেউ হয়তো বলবেন, “ভাই, মক্কা-মদীনার কথা বাদ দেন। এগুলোর সাথে কি আর অন্য মসজিদের তুলনা হয়?”

তর্কের খাতিরে যদি আমি তার কথা সত্য বলে মেনেও নেই, কিন্তু, আরব ভূখণ্ডেরই আর একটি মুসলিম দেশে আমার পরবর্তী অভিজ্ঞতা আরো চমকপ্রদ।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস। তখন করোনা মহামারী চীনের উহানে তার ভয়াবহ ছোবল বিস্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছে মাত্র। সে সময় আমি আমার স্বামীর সাথে নয় দিনের জন্য দুবাই গিয়েছিলাম। ইতিপূর্বে আমার সৌদী আরব ছাড়া আরবের অন্য কোন ভূখণ্ডে কখনও যাওয়া হয়নি।

যাই হোক, পরবর্তীতে আমার মনে হয়েছিল, এই নয়টি দিন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম দিনগুলোর মধ্যে অর্ন্তভূক্ত।

কারণ, এই স্বল্প সময়ে, আমার স্বামী আমাকে নিয়ে দুবাইয়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছে। কিন্তু, আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে গিয়ে কখনো কোথাও এতটুকু বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়নি।

দুবাইয়ের একেবারে প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম্য অঞ্চলে, বিভিন্ন মসজিদে, বিভিন্ন সময়ে আমরা সালাত আদায় করেছি।

কোথাও কোন মসজিদে আমাকে শুনতে হয়নি, “এই মসজিদে মহিলাদের জন্য কোন জায়গা নেই।” কেউ আমার দিকে ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকায়নি।

ভিনদেশে স্বল্প সময়ের এই সফরে, আমার এক ওয়াক্ত সালাত কখনো কাজা হয়নি, কিংবা, সালাত আদায় করা নিয়ে আমাকে কখনো উদ্বিগ্ন হতে হয়নি, অথবা, কাজা হয়ে যাবার ভয়ে আমার জোহর-আসর, কিংবা, মাগরিব-ইশা একসাথে পড়ারও প্রয়োজন হয়নি।

সে সময় আমরা ছিলাম দুবাই এর পশ্চিমে আল-বারসা নামে একটি নতুন গড়ে উঠা আবাসিক এলাকায়। আমাদের হোটেলের ঠিক পেছনেই পায়ে হাঁটা দূরত্বে ছিল খুব চমৎকার স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি মসজিদ।

আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকাতেও এরকম চমৎকার স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত অনেক মসজিদ আছে।

কিন্তু, পার্থক্য যেটা ছিল, তা হল সেই মসজিদের দরজাগুলো দেশী-বিদেশী সকল মুসলিম নারীদের জন্য ছিল সবসময় উম্মুক্ত।

আমি আর আমার স্বামী মাঝে মাঝে আমাদের হোটেল সংলগ্ন সেই মসজিদে ফজরের সালাত আদায় করতে যেতাম।

আর, দেখতাম, সেখানকার স্থানীয় সব বয়সের নারীরা সেই মসজিদে ফজরের সালাত আদায় করতে আসেন, আসেন বয়োবৃদ্ধ নারীরা, সেইসাথে, মধ্যবয়সী নারী সহ তরুণীরাও অবলীলায় এসে সালাত আদায় করেন।

কেউ তাদের দিকে ভ্রুকুটি করে না, কিংবা, সমাজের লোকেরা নারীদের মসজিদে সালাত আদায় করাকে ফিতনার কারণ বলেও মনে করে না।

শুধু তাই নয়, দুবাইয়ের প্রতিটি মসজিদে আমি দেখিছি নারীদের জন্য প্রবেশপথ ভিন্ন হলেও সে প্রবেশ পথটি পুরুষদের জন্য নির্মিত প্রবেশ পথের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ ও বিশাল।

আর সেইসাথে, নারীদের সালাত আদায়ের স্থানটি পুরুষ মুসুল্লীদের সালাত আদায়ের স্থানের মতোই অনেক প্রশস্ত, পুরু গালিচা বিছানো, মনোরম আলোয় সজ্জিত এবং সেইসাথে সাজানো-গোছানো ও পরিপাটি। যেখানে গেলে দুনিয়ার সব কাজ ফেলে শুধু আল্লাহ’র জন্য সিজদাবনত হয়ে থাকতেই মন আকুলী-বিকুলী করে।

আমাদের হোটেল সংলগ্ন সেই মসজিদটিতে, নারীদের সালাত আদায়ের স্থানটি ছিল দোতলায়। সাজানো-গোছানো একটি লবি পেরিয়ে, প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেই প্রশস্ত হলঘরের একপাশে ছিল সারি সারি পরিস্কার ঝকঝকে বাথরুম আর সেইসাথে ওযুর জায়গা। আর অন্যদিকে ছিল নারীদের সালাত আদায়ের স্থান।

সেই সালাত আদায়ের স্থানের ঠিক সামনেই ছিল কাঠের কারুকাজ ঝাঁঝড়ি যুক্ত একটি পার্টিশন, যেখান থেকে নীচতলায় পুরুষদের জায়গায় ইমামের দাঁড়ানোর স্থান মিহরাব পরিস্কার ভাবে দেখা যেত। সেখান থেকে আমি উঁকি দিয়ে দেখেছিলাম যে, নারী আর পুরুষের সালাতের জায়গা তারা একই সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, একই ভাবে সজ্জিত করেছে এবং সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষে তারা কোন ভেদাভেদ করেনি।

ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তখন আমরা দুবাই এর প্রাণকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে রাস-আল-খাইমাহ নামের একটি শহরে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে জোহরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে পথিমধ্যে আমরা একটি গ্রাম্য এলাকায় সালাত আদায়ের বিরতি নিলাম।

গ্রাম্য এলাকার সেই মসজিদটি আমাদের হোটেল সংলগ্ন মসজিদের মত এক আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখেছি, সেখানেও নারীদের জন্য প্রবেশ পথ, সালাতের স্থান সহ অন্যান্য সকল সুবিধা পুরুষদের থেকে এতটুকু কম ছিল না।

দুবাইয়ে থাকাকালীন সময়ে কেনাকাটার জন্য বিভিন্ন সময়ে আমরা সেখানকার বিভিন্ন নামকরা শপিংমলে গিয়েছি।

সেই চোখ ধাঁধানো শপিংমলগুলোতে শুধু আলো ঝলমলে দোকান আর পৃথিবীর সেরা সেরা পণ্যসামগ্রীই ছিল না, বরং প্রতিটি শপিংমলে নারীদের জন্য নির্মিত মুসল্লা বা সালাত আদায়ের স্থানগুলো ছিল প্রাণ জুড়িয়ে দেবার মত।

আমি সেখানে দেখিছি ছোট ছোট শিশুসন্তান, এমনকি দুধের সন্তান সহ অল্পবয়সী কিংবা মধ্যবয়সী নারীরা এসে নির্দ্বিধায় সালাত আদায় করছে। শিশুদের দুধ পান করানো ও তাদের কাপড়-চোপড় বদলে দেয়ার জন্য সে মুসল্লাগুলোতে সালাতের স্থানের পাশেই রয়েছে সুন্দর সাজানো-গোছানো কক্ষ।

শুধু তাই নয়, সেখানে আমি শপিং মলের মহিলা গার্ড, কিংবা নারী বিক্রেতাদের দেখেছি কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে তারা নির্দিধায় আর নিশ্চিন্তে সময়মত সালাত আদায় করে চলে যাচ্ছে।

সেই নয়টি দিনে দুবাইয়ের সর্বত্র নারীদের শুধুমাত্র সালাত আদায়ের এত সুযোগ-সুবিধা দেখে আমার মনে হয়েছিল, মক্কা-মদীনার পর, এটিই বুঝি এই পৃথিবীতে বসবাস করার জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা, যেখানে একজন মুসলিম নারী হিসেবে আমাকে মসজিদে প্রবেশিধাকার থেকে বঞ্চিত করা হবে না, আর আমাকে ঘরের বাইরে সময়মত সালাত আদায় করা নিয়ে জীবনভর উদ্বিগ্ন থাকতে হবে না।

(চলবে)

লেখক : গবেষক ও স্থপতি

[মতামত বিভাগের লেখার দায়ভার সম্পূর্ণ লেখকের। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ এর সাথে যুক্ত নয়।] 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *