ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ধনবাড়ীর নবাব মসজিদ

ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ধনবাড়ীর নবাব মসজিদ

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে পৌরসভায় অবস্থিত ধনবাড়ী নওয়াব শাহী জামে মসজিদ। প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের ধারক ও বাহক টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নওয়াব শাহী জামে মসজিদ ইসলামি ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। ৭০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদে ১৯২৯ সালে নবাবের মৃত্যুর পর থেকে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হচ্ছে, যা এখনো এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি। বর্তমানে সাতজন ক্বারি নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁরা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করে থাকেন। এটি বিশ্বের বুকেও একটি বিরল ঘটনা। ষোড়শ শতাব্দীতে সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ দুই ভাই ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটির প্রথম (এক কক্ষ বিশিষ্ট মসজিদ) নির্মাণ করেন। সংস্কারের আগে মসজিদটি ছিল আয়তাকার। তখন এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৩.৭২ মিটার (৪৫ ফুট) এবং প্রস্থ ছিল ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট) কিন্তু সংস্কারের পর মসজিদটির আকার রীতিমতো পরিবর্তিত হয়ে যায়। বর্তমানে এটি একটি বর্গাকৃতির মসজিদ এবং সাধারণ তিনগম্বুজ বিশিষ্ট আয়তাকৃতির মুঘল মসজিদের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কারের পর মসজিদের প্রাচীনত্ব কিছুটা লোপ পেলেও এর চাকচিক্য ও সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে। সুন্দর কারুকার্যময় এ মসজিদের পূর্বদিকে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ, এছাড়া উত্তর ও দক্ষিণে আরো একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে।

মসজিদটির চর্তুদিক থেকে ৪টি প্রবেশ পথ এবং ৯টি জানালা রয়েছে। ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ রয়েছে। বড় ১০টি মিনারের প্রত্যেকটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট উচু। মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। ৫ ফুট উচ্চতা এবং ৩ ফুট প্রস্থের মেহরাবটি দেখতে আকর্ষণীয় এবং সুপ্রাচীন। এখানে বসে ইমাম খুতবা পাঠ করেন। প্রচলিত নিয়মে এ মসজিদের পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর এর অভ্যন্তরে কিবলা দেয়ালে তিনটি মিহরাব নির্মিত। কেন্দ্রীয় মিহরাবের কুলুঙ্গিটি অষ্টভুজাকার ও বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান সহযোগে ফুলের নকশায় অলংকৃত। উভয় পাশের দুটি বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানযোগে গঠিত, তবে অলংকারহীন। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে একটি মিনার রয়েছে। পুরো মসজিদের মেঝে আর দেয়াল কাঁচের টুকরো দিয়ে নকশাদার মোজাইক করা। মেঝেতে মার্বেল পাথরে খোদাই করা নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। ভেতরের সব জায়গাতেই চীনামাটির টুকরো দ্বারা মোজাইক নকশায় অলংকৃত, যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফুলের নকশা দৃশ্যমান। এতগুলো বছরে একটু ফাটল পর্যন্ত ধরেনি সেই নকশায়। মসজিদটির সুউচ্চ ৩০ ফুট উচ্চতার মিনারের চুড়ায়, ১০টি তামার চাঁদ মিনারের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর সংরক্ষিত কক্ষে শোভা পাচ্ছে ১৮টি হাড়িবাতি, যা নারিকেল তেল দ্বারা আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে মুঘল আমলে ব্যবহৃত ৩টি ঝাড়বাতিও। মসজিদ নির্মাণে চুন, সুরকি, সাদা সিমেন্ট, কড়ি পাথর, লোহার খাম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে।

মসজিদের পাশেই প্রায় ৩০ বিঘা জমির উপর রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। যেখানে দাফন করা হয়েছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। নবাব নওয়াব আলীর মৃত্যুর আগে তার এ স্টেট ওয়াকফ করে যান। ওয়াকফকৃত সম্পদেই মসজিদ ও পাশে অবস্থিত মাদ্রাসা, ঈদগাহ ইত্যাদি পরিচালিত হয়ে আসছে। সুপ্রাচীন এ মসজিদটিতে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ধনবাড়ির বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৫ বছর আগে এ মসজিদটি সম্প্রসারণ করে আধুনিক রূপ দেন। মসজিদের ভেতরের দেয়ালে কড়ি পাথরের লতাপাতা আঁকা অসংখ্য রঙিন নকশা ও কড়ি পাথরের মোজাইক করা প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন পরিলক্ষিত হয় মসজিদটিতে। মসজিদটির দেয়ালের বাইরের অংশেও রয়েছে সিমেন্ট আর কড়ি পাথরের টেরাকোটা নকশা।

বর্তমানে ময়লা-আবর্জনায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী নওয়াব বাড়ির ঐতিহ্যবাহী দীঘিটি। শতাধিক বছরের পুরনো এ দীঘির পাড়ে নির্মিত বসতবাড়ির নিত্য ব্যবহার্য আবর্জনা ফেলে ও পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপ লাইনের নোংরা পানিতে দূষিত হচ্ছে পানি। ফলে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এটি। ধনাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মীর ফারুক আহাম্মদ ফরিদ বলেন, আসলেই এ মসজিদটি ঐতিহাসিক। বাংলাদেশে যতগুলো মসজিদ আছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। অনেক পুরানো স্থাপত্য, এটি সংস্কারের অভাবে তার অতীত ঐতিহ্য ও জৌলুস হারাচ্ছে। ধনবাড়ী নবাব শাহী জামে মসজিদের খতিব ও ইমাম হাফেজ মাওলানা ইদ্রিস হোসাইন বলেন, পীরের নির্দেশনায় কবরের আযাব থেকে মুক্তি পেতে ১৯২৭ সালে সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী এ মসজিদের সার্বক্ষণিক কোরআন তিলাওয়াতের ব্যবস্থা করেন। ১৯২৯ সালে নবাব বাহাদুর সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী। মসজিদের এক পাশে তাঁকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। তার মৃত্যুর পর চলমান রয়েছে কোরআনা তেলাওয়াত। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক নামাযের সময় ছাড়া ১ মিনিটের জন্যও বন্ধ হয়নি কোরাআন তেলাওয়াত। স্থানীয়রা প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপনাটি রক্ষার্থে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *