ওয়াজ মাহফিলের বক্তাগণ রেষারেষি পরিহার করুন

ওয়াজ মাহফিলের বক্তাগণ রেষারেষি পরিহার করুন

মাওলানা আমিনুল ইসলাম :: ওয়াজের ময়দানে যারা আছেন, তাদের কাজ তো ওয়াজ করা। অধিকাংশ পেশাদার ওয়ায়েজের ওয়াজ ছাড়া আর কোন পেশা নেই। কেননা, সময় কোথায়? আজকে ঢাকা ওয়াজ মাহফিল করলে কাল করতে হবে ফরিদপুর। ফরিদপুরের টা শেষ হলে পরের দিন আবার দেখা যায় বরিশাল বা পটুয়াখালি। আবার বরিশাল বা পটুয়াখালি শেষ হলে দেখা গেল পরের মাহফিল কুমিল্লা। আবার দেখা গেল কুমিল্লা থেকে চলে যাচ্ছেন উত্তরবঙ্গে।

এভাবে বক্তাদের চাকা কিন্তু ঘুরতেই থাকে। বিরামহীন ভাবে পথ চলা তাদের। নিজের পরিবার পরিজনের সাথে সময় দেওয়া হয় না। একটানা পাঁচ ছয়মাস এই নিয়মেই চলাফেরা। খাবার দাবারের টাইম-টেবিল থাকে না। নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানোর টাইম হয় না কারো। বহু বক্তা আছেন, এই নভেম্বর থেকে নিয়ে মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত রাতের বেলায় বিছানায় পিঠ দিতে পারেন না। কেউ কেউ তো সারা বছরই রাতের বেলা নির্ঘুম কাটে।

বক্তাদের নিজের সন্তানদের প্রতি যত্ন নেওয়া, লেখা-পড়ার প্রতি খেয়াল রাখার সময় হয় না। কেননা, নিজ বাড়ীতে থাকারই সময় নেই, তো সন্তানদের লেখা পড়ার দিকে খেয়াল করবেন কখন। অধিকাংশ বক্তা মাদ্রাসা থেকে বিচ্ছিন্ন। মাদ্রাসা নামে থাকলেও পড়ানোর সময় নেই। আবার কিছু বক্তা তো অত ইলমে পারদর্শী নন। শুধু ওয়াজের ইলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সময় থাকলেও পড়ানো হয়না। আবার কেউ কেউ ভাল ইলম আছে। তবে সেটার সংখ্যা নগন্য। ওসব ইলমওয়ালা বক্তারা কিছু কিছু পড়ানোর চেষ্টা করেন। তবে ওয়াজ মাহফিলের ফিকিরে ছাত্রদের পরিপূর্ণ হক আদায় করতে পারেন না।

মানে এক মাহফিল থেকে এসে বিশ্রাম নিতে হয়। আবার আরেক জায়গায় যাওয়ার চিন্তা মাথার ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকে। সুস্থ মস্তিস্কে পড়ানোর সময় কোথায়? তবুও তারা মাদ্রাসার সাথে জুড়ে আছেন, যাতে একদম বে-ইলম না হন। কিছু বক্তা ভাইদের তো কোন মাদ্রাসাই নেই। একদম মাদ্রাসা ছাড়া। ওনারা ওয়াজের ময়দানে সময় পার করে দিচ্ছেন। মুখস্থ ওয়াজের উপর চলে যাচ্ছে যুগ যুগ সময়।

বক্তা ভাইদের এত পরিশ্রমের মধ্যে যা কিছু হাদিয়া মেলে তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কেউ কেউ কৌশলী ভাবে চলেন, তাদের ডিমান্ড একটু বেশী থাকে। তবে অনেক খানি চাতুরতার সাথে কাজ করে যান, যাতে সাধারণে দৃষ্টিকটু না হয়। তবে এদিক খারাপ নয়। তাদের সমালোচনা কম। কিন্তু কিছু বক্তা বাড়াবাড়ি করেন। অবশ্য এই দু’চার জনের কারণে বদনাম হয় সবার।

বক্তা ভাইদের একে অপরের সাথে মধুর সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু সবাই ওয়ায়েজীন। তাই একজন আরেকজনের সাথে ভাল সম্পর্ক বিরাজ করে। নিজে এক জায়গায় দাওয়াত পেলে আরেকজনকে সেখানে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আবার তিনি যাকে ঢোকালেন, সে যদি আবার কোথায় দাওয়াত পায়, তাহলে ঐ বক্তা বন্ধুকে নেওয়ার চেষ্টা করেন। মোটামুটি একটা ভাল সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়।

একদম হাদিয়া ছাড়া কোন বক্তা কিন্তু মাহফিল করেন না। শুধু মাত্র যাতায়াত খরচ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন, এরকম ব্যক্তি হয়ত হাজারে একজন। তবুও কিন্তু পাবলিকের দুঃখ নেই। সাধারণ মানুষের এখন সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। যদিও প্রাথমিক সময়ে এটা জুলুমের পর্যায়ে ছিল। বর্তমান সে জুলুমটা এখন সয়ে গেছে। বক্তাদের একে অপরের সাথে তেমন সাক্ষাত হয় না। কোন মাহফিলে কিছু সময়ের জন্য হয়ত মিলিত হয়েছেন, বাকি অন্য সময় তো যার যার মত। কেউ কারো ধার-ধারে না। সবাই নিজ নিজ স্থানে চলে যান।

বড় দুঃখের বিষয়, ইদানিং কালে বক্তাদের মাঝে একে অপরের সাথে কিছু রেষারেষি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অমুককে দাওয়াত দিলে আমরা নেই। অমুক বক্তা থাকলে সেখানে আমরা কেউ যাব না। এই বিষয়টা আগে কোনদিন আমরা দেখিনি। এই অল্প দিন ধরে এটা তৈরী হয়েছে। মানে হৃদয়ের সংকীর্ণতা কাকে বলে। এখানে কাঙাল তো সবাই। অমুককে দাওয়াত দিলে আমি সে দাওয়াতে যাব না এটা কেমন কথা? যার রিজিক সেই খাবে। একজনের রিজিক তো আরেকজন খেতে পারে না। তাহলে কেন এই সংকীর্ণতা?

বক্তাগিরি এটা কোন রাজনীতি নয়। কোন ক্ষমতার মসনদ দখল করা নয়, বা কোন চাকুরী নয়। এটা আল্লাহ প্রদত্ব এক নেয়ামত। এটা যার মধ্যে আছে, সে যদি দাওয়াত পায় তাহলে সমস্যা কোথায়? এজন্য বক্তা ভাইদের উদার হতে হবে। রেষারেষি পরিহার করতে হবে। কাঙালী স্বভাব দিল থেকে মুছে ফেলে বাদশাহী মেজাজ আনা চাই। দেখুন! আপনাদের এই রেষারেষিতে জাতির কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে। যেটা অপূরনীয়।

তবে এটা যদি আপনারা কেউ মনে করেন, আমরাই সব কিছু, আমাদের ছাড়া ওয়াজের ময়দান চলবে না। আমরা জোট বেঁধেছি। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক না। নিজেদের সব জ্যান্তা মনে না করা ভালো। আল্লাহ যদি নারাজ হয়ে যান, তবে তিনি আপনাদের পরিবর্তে অন্য কাউকে বসাতে পারেন যে কোন সময়। এজন্য সাবধান। সব ধরনের হিংসা বিদ্বেষ ত্যাগ করে আল্লাহর দিকে রুজু হোন। আল্লাহ আমাদের সকলকে সহী বুঝ দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *