কওমির শিক্ষক হওয়া-ই কি আমার অপরাধ? | মুহাম্মদ আইয়ূব

কওমির শিক্ষক হওয়া-ই কি আমার অপরাধ? | মুহাম্মদ আইয়ূব

‘আমার স্ত্রী সন্তান আর আত্মীয়-স্বজনের চোখে আমি এখন আলেম নয় বরং জালিম। আমি যে তাদের প্রাপ্য দিতে পারছিনা! তাই আমি আমাকে এখন প্রশ্ন করি, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়াই কি আমার অপরাধ?’

আমি আইয়ূব। শিক্ষাগত যোগ্যতা: হাফেজ, মাওলানা এবং বিদেশি মুফতী (ইন্ডিয়ায় ইফতা পড়েছি তাই হা,হা,হা)। এক গাদা সার্টিফিকেট এর মালিক আমি। অথচ এই সবই আজ আমার কাছে কেমন অনর্থক মনে হয়। এর জন্য সব দায় আমি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালদের ঘাড়ে চাপাইতে চাই (সবার উপর না, বরং টাউট বাটপার নির্দয়, স্বার্থপর আর ওয়াদা ভঙ্গকারী শ্রেণীর উপর)।

আজ এপ্রিলের পনের তারিখ অথচ গত মাসের বেতনটা এখনও পাইনি। চার সদস্যের সংসার সাথে বাবা মা। মাথার উপর করোনার সঙ্কট। চারিদিকে ত্রাণের ছড়াছড়ি ঠিক, তবে আমার শিক্ষা আর আত্মমর্যাদাবোধ আমাকে অন্যের কাছে হাত পাততে বারণ করে। আচ্ছা আমি ত্রাণের জন্য কেন লাইনে দাঁড়াব? আমি তো একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমার বেতন ধার্য করা। কিন্তু বেতন যে দিচ্ছেনা!

আমার স্ত্রী সন্তান আর আত্মীয়-স্বজনের চোখে আমি এখন আলেম নয় বরং জালিম। আমি যে তাদের প্রাপ্য দিতে পারছিনা! তাই আমি আমাকে এখন প্রশ্ন করি, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়াই কি আমার অপরাধ?

গাধাও পরিশ্রমের পর খোরাক পায় কিন্তু আমি গাধার সমান ও হতে পারলামনা প্রিন্সিপাল সাহেবের দৃষ্টিতে আফসোস! কওমের ভাগ্য বদলাতে যে মাদ্রাসার জন্ম সে মাদ্রাসা কওমের ভাগ্য বদলাতে ব্যর্থ হলেও মুহতামিম সাহেবদের ভাগ্য কিন্তু বদলে দিয়েছে। অনেকে মাদ্রাসার বরকতে জায়গা-জমি, গাড়ি-বাড়ি আর ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন। আল্লাহর রহমতে প্রতি বছর হজ্ব ওমরাহতেও যাচ্ছেন।

আর আমরা যারা শিক্ষক? আরে আমরাতো কলুর বলদ যার কাজই হচ্ছে ঘানি টানা। দায়িত্বে একটু এদিক সেদিক হলেই মিটিংয়ে তুলোধুনো করা হয় আর মাস শেষ হলে যখন বেতনের কথা বলি তখন সবরের শিক্ষা দেওয়া হয়। কেন? সবর কি শুধু শিক্ষকদের জন্য? তোমাদের কোন করণীয় নাই? বেতন দিতে না পারলে মুহতামিমের সিট খালি করে দাও। যোগ্যদের অভাব নাই দেশে।

পাঠক! এমন করে কেন বলছি জানেন? আমার নিষ্পাপ ছোট দুটি ছেলে ফোনে আমার কাছে জানতে চায়, আব্বু তুমি কবে আসবে? আমাকে চকলেট কিনে দিবে ঠিক আছে? ঠিক আছে বলে এক হাতে ফোন রাখি অপর হাতে চোখের পানি মুছি। আমার চোখের পানি কেউ দেখেনা। আমার মনের কষ্টগুলো কেউ বুঝেনা। তাই বলছিলাম মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়াই বুঝি আমার অপরাধ।

‘বাংলাদেশের নামকরা কওমী মাদ্রাসার বোর্ডের কথা আর বলে লাভ নেই। বেতনের বিষয়টা তাদের সাবজেক্ট না, তবে তাবলীগের মাওলানা সা’দ সাহেবকে আটকানোর জন্য বিমানবন্দরের রাস্তা আটকিয়ে দেওয়া তাঁদের সাবজেক্ট!!’

সব কিছু বন্ধ। গাড়ি চলেনা এই অজুহাতে যারা বেতন আটকে রাখছেন তারা বোধহয় ভুলে গেছেন যে, আমরা ডিজিটাল দেশের নাগরিক। বিকাশ আর রকেট চালু আছে সমস্যা নাই। আর যদি টাকা ম্যানেজ না হয় তাহলে কিডনি বিক্রি করে টাকা দিন; যেহুতু আপনি মুহতামিম। তারপরও বেতনের টাকা দিয়ে দিন। নইলে আজকের “আহ” শব্দটি আপনার জীবন তছনছ করার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ বলে একজন কিন্তু আছেন উপরে!

বাংলাদেশের নামকরা কওমি মাদ্রাসার বোর্ডের কথা আর বলে লাভ নেই। বেতনের বিষয়টা তাদের সাবজেক্ট না, তবে তাবলীগের মাওলানা সা’দ সাহেবকে আটকানোর জন্য বিমানবন্দরের রাস্তা আটকিয়ে দেওয়া তাঁদের সাবজেক্ট!! এমন অকর্মণ্য বোর্ড সারা বিশ্বে আর একটা আছে কিনা আমার জানা নাই। আজ এ পর্যন্ত থাক।

ও হ্যাঁ! আজকের লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি আমি জামিআ’ ইকরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন না করি। শিক্ষক- স্টাফদের হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে বিকাশেই প্রত্যেককে বেতন পাঠিয়ে দিয়ে তারা আবারও প্রমাণ করেছে আমরা বয়ানবাজিতে নয় কর্মে বিশ্বাসী।

জামিআ’ ইকরার মত যারা শিক্ষক-স্টাফদের কথা বিবেচনায় রেখে বেতন কমপ্লিট করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজ এখানেই ক্ষান্ত দিচ্ছি একটা বিনীত আহবানে। করোনার এই করুণ সময়ে যে সকল মাদ্রাসার বেতন বাকি সে সকল মাদ্রাসার সম্মানিত প্রিন্সিপাল সাহেবদের কাছে অনুরোধ, বকেয়া সহ চলতি মাসের বেতন পরিশোধ করার।

প্রয়োজনে যাদের সহযোগিতা নিলে ফায়দা হবে তাদের সহযোগিতা নিন। তারপরও কারো চোখের পানি দেখতে যাবেননা। চোখের পানি অনেক ভয়ঙ্কর। (দেশ ও দশের জন্য আর কয়েকটি দিন ঘরে থাকুন, সতর্ক থাকুন, সবাইকে বাঁচতে দিন।)

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *