যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি তাদের মূলশক্তি জামায়াতে ইসলামীকেও অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছেন দেশের প্রখ্যাত আলেম ও শোলাকিয়া ঈদগা ময়দানের ইমাম ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। তিনি বলেছেন, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের মালিকানায় হস্তান্তর করে সুষ্ঠুভাবে সরকারকে পরিচালিত করতে হবে।
দেশের সাম্প্রতিক চলমান ঘটনা নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এসব কথা বলেন। প্রায় ৪০ মিনিটের সাক্ষাৎকারটি সম্প্রতি রাজধানীর বারিধারার তার নিজ বাসভবনে নেয়া হয়।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শুধু আমি নই দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। সরকার শুধু উদ্যোগই গ্রহণ করেনি, সঙ্গে সঙ্গে কাদের মোল্লার ফাঁসির মাধ্যমে এ বিচার বাস্তবায়ন করেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় সরকার বাস্তবায়ন করবে এবং জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়ে পবিত্রতা অর্জনে সক্ষম হবে।
এ সময় মাসঊদ দুঃখের সঙ্গে বলেন, দেশের গরিব মানুষের রক্তচোষার জনক ড. ইউনূস হচ্ছে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির দালাল। তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণের মুখোশে দেশে ইহুদিবাদী পাশ্চত্যের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। একটি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি কিভাবে সমকামিতার বিষয়টিকে সমর্থন জানান। এটা খুব নিন্দনীয় কাজ। গ্রামীণ ব্যাংকের নির্যাতনে বহু মহিলা আত্মহত্যা করেছেন বলে আমার কাছে রয়েছে বহু প্রমাণ। ড. ইউনূসকে একজন ভাঁওতাবাজ মানুষ বলে অভিহিত করেন এ আলেম।
ওলামা মাশায়েখ সংহতি পরিষদের সভাপতি মাসঊদ বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে। আমরা চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গে এদের যে মূলশক্তি জামায়াত ইসলামীকেও অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণের মালিকানায় এনে সুষ্ঠু পরিচালনার ব্যবস্থা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার সঙ্গে আপনি একমত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মাসঊদ বলেন, হেফাজত প্রথমে সঠিক অবস্থানে ছিল। পরে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। উগ্র অবস্থানে চলে যাওয়ার পর সরকার থেকে কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, হেফাজতের মধ্যে জামায়াত-শিবির ঢুকে পড়েছে। হেফাজতকে ব্যবহার করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির। এ সময় মাওলানা মাসঊদ নিজেই স্বীকার করে বলেন, জামায়াত-শিবিরকে হেফাজত দেখতে পারে না।
গত ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা হাজার হাজার বলে দাবি করা হচ্ছে হেফাজতের পক্ষে থেকে। এ দাবির সঙ্গে আপনি একমত কিনা এমন প্রশ্নে শোলাকিয়ার ইমাম বলেন, শাপলা চত্বরে কিছুসংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছেন। একজন মানুষ হত্যাও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তবে যে সংখ্যা বা হাজারের উপরে বলা হচ্ছে সেটা বাস্তব মনে হচ্ছে না। এটা হেফাজতের ব্যক্তিগত দাবি। ওলামা মাশায়েখদের দাবির সঙ্গে তিনি একমত। সরকারের উচিত হবে যৌক্তিক দাবিসমূহ মেনে নেয়া।
গণজাগরণ মঞ্চে আপনার প্রথমে সমর্থন ছিল। পরে আপনি সমর্থন প্রত্যাহার করলেন। কি কারণে এটি করলেন- এ প্রশ্নের জবাবে নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তিনি বলেন, আমার ভূমিকা ইসলাম ও দেশের পক্ষে। গণজাগরণ মঞ্চ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন আমার দেশপ্রেমের তাগিদে তা সমর্থন করি। কিন্তু পরে এদের কেউ কেউ যখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয় তখন আমার ঈমানের তাগিদে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের দাবি জানাই। তাৎক্ষণিক ওই সময় আমার দেয়া সমর্থন প্রত্যাহার করি।
সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা সরিয়ে ফেলায় সরকারের সমালোচনা করে দেশখ্যাত এ আলেম বলেন, আল্লাহর ওপর আস্থা বিশ্বাস যেহেতু সংবিধানে ছিল তা তুলে দেয়া যৌক্তিক হয়নি। তিনি আশা করেন, সরকার এটাকে পুনঃস্থাপন করে এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মনের দাবি বা আকাক্সক্ষা পূরণ করবে।
সরকার অচিরেই কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করবে। এটা গোটা কওমি মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক ও এদেশের আলেম ওলামাদের প্রাণের দাবি। সনদের স্বীকৃতির কোনো বিকল্প নেই।
কওমি মাদরাসার সনদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার অচিরেই কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করবে। এটা গোটা কওমি মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক ও এদেশের আলেম ওলামাদের প্রাণের দাবি। সনদের স্বীকৃতির কোনো বিকল্প নেই।
দেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সবাই আল্লাহ ও তার রাসূলের আদর্শ ও বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু সবারই লক্ষ্য উদ্দেশ্য এক। কি কারণে বর্তমানে আলেম ওলামাদের মধ্যে মতবিরোধ? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির এ আলেম বলেন, আলেম-ওলামা ও ইসলামী রাজনীতিবিদদের মাঝে যে অনৈক্য পরিলক্ষিত হয় আমার ধারণা এর পেছনেও জামায়াত-শিবিরের চক্রান্ত ক্রীয়াশীল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতৃত্বের সংঘাতের কারণেও এমন ঘটে যাচ্ছে। আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে কুরআন হাদিসের ভিত্তিতে নিজের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টির মাধ্যমে অনৈক্য দূরীকরণ সম্ভব হবে বলে মনে করি আমি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে একজন সচেতন আলেম ও নাগরিক হিসেবে আপনার মতামত কি? এর উত্তরে তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন সকলেরই কাম্য। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে পুনরায় নির্বাচন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও যৌথবাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে দেশের প্রগতিশীল এ মাওলানা বলেন, ইসলাম সব সময় সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে হত্যার চেয়ে মারাত্মক অপরাধ বলে গণ্য করে। এ বিষয়ে কুরআন মজিদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সুতরাং যে কোনোভাবেই সহিংসতা সৃষ্টি করা হোক না কেন, তা সমর্থনযোগ্য নয়। আর ইসলামে সহিংসতা সৃষ্টি করা জঘন্যতম অপরাধ। এ ক্ষেত্রে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
সর্বশেষ মাজারভক্ত পীর, আলেম ও ওলামাদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, মাজার পূজা করা ঠিক নয়। যারা এর সঙ্গে জড়িত তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এগুলো করেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ছলিম উল্লাহ মেজবাহ