করোনা; রমজানের করণীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে ভারতীয় উলামায়ে কেরামের ঐক্য

করোনা; রমজানের করণীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে ভারতীয় উলামায়ে কেরামের ঐক্য

করোনা; রমজানের করণীয় দিকনির্দেশনা নিয়ে ভারতীয় উলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ আহ্বান

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : আমাদের দেশে যখন মসজিদ নিয়ে রাজনীতি চলছে। হক্বের ডিলাররা মসজিদে জামাতের মুসল্লীদের সংখ্যার ব্যাপারে কাঁদা ছুঁড়াছুঁড়িতে লিপ্ত। এক জানাযায় শরিক হতে লকডাউন আর সরকারের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ। এই যখন বাংলাদেশের অবস্থা তখন এর উল্টো চিত্র প্রতিবেশী দেশ ভারতের। আলেমে আলেমে নাকি কোনদিনও একটি বিষয়ে একমত হতে পারেননা। মতানৈক্য হবেই হবে! প্রতিবেশী দেশ ভারতের আলেমরা বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের গুরু। অথচ আজ তাঁরা নিজেরা শুধু মসজিদের মুসল্লী সংখ্যার ব্যাপারে একমত হননি! সাথে মুসলিমদের মাঝে যত ফেরকা আছে তাদের লিডারদেরকেও এক করেছেন এই মরণব্যাধী করোনা ইস্যুতে। ভারতের সকল মুসলমানদের একই প্লাটফর্ম থেকে ঐক্যবদ্ধ্য হয়ে জাত পাত নির্বিশেষে সবাইকে মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে ইবাদতের লক্ষ্যে একই সুতোয় সবাইকে বাঁধার মত কঠিন কাজ অনায়েসে সেরেছেন এক দিকনির্দেশনা মূলক আহ্বাননামা দিয়ে। ভাবলাম এ দেশের মুসলমানদের ও খুব উপকার দিবে তাঁদের সেই আহ্বাননামা।

পাথেয় টোয়েন্টিফের ডটকম-এর পাঠকদের জন্য ভারতের মুসলমানদের প্রতি উলামায়ে কেরামের সেই আহ্বাননামা হুবহু অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ আইয়ূবআব্দুর রহমান রাশেদ। নিচে অনুবাদ তুলে ধরা হলো।—

‘ভারতের বিভিন্ন মাসলাক ও মতাদর্শের প্রধান প্রধান উলামায়ে কেরামের পক্ষ হতে সকল মুসলমানদের প্রতি লকডাউনের দিনগুলোতে রমজানের করণীয় সম্পর্কে জরুরী দিকনির্দেশনা।’

রমজানের বরকতময় মাসে মুসলমানরা কয়েকটি ইবাদতের খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তবে যেহুতু করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার লকডাউনের হুকুমজারী রেখেছে এবং শরীয়ত ও মানুষের জীবনকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। এ কারণে মানব জীবনের হেফাজতের কথা বিবেচনা করে শরীয়তের বিধি বিধান পালন করা উচিত। সে লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সকল জামাত ও মতাদর্শের প্রধান প্রধানদের পক্ষ থেকে সম্মিলিতভাবে সকল মুসলমানদের কিছু বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে। আশা করি এর উপর সবাই আমল করবেন।

যাদের পক্ষ থেকে এই আহ্বান :

১। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ রাবে’ হাসান নদভী সাহেব, সদর মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড ইন্ডিয়া।
২। হযরত মাওলানা আবুল ক্বাসিম নুমানী সাহেব, মুহতামিম দারুল উলূম দেওবন্দ।
৩। হযরত মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানী সাহেব, সদর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।
৪। হযরত মাওলানা তাওক্বীর রেযা খান সাহেব, সদর মুসলিম ইত্তেহাদ পরিষদ বেরেলী।
৫। হযরত মাওলানা সাইয়েদ আশরাফ সাহেব কুচুছুবী, সদর অল ইন্ডিয়া মশায়েখ বোর্ড।
৬। হযরত মুফতী আহমদ খানফুরী সাহেব, প্রধান মুফতী তা’লিমুদ্দীন ডাভেল গুজরাট।
৭। হযরত মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ ওয়ালী সাহেব, গদ্দীনিশীন খানকাহে মুঙ্গীর বিহার।
৮। হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ উসমান সাহেব, সদর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।
৯। হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানী সাহেব, সেক্রেটারি ইসলামিক ফিকহ একাডেমি।
১০। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ মাহমুদ আসআ’দ মাদানী, জেনারেল সেক্রেটারি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।
১১। হযরত মাওলানা আসগর আলী ইমাম সালাফী সাহেব, আমীর মারকাযে জমিয়তে আহলে হাদীস।
১২। জনাব মুজতবা ফারুক সাহেব, জামাআতে ইসলামি হিন্দ।
১৩। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ তানভীর হাশমী সাহেব, সদর কর্ণাটক জামাআতে আহলুস সুন্নত।
১৪।হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব, মুহতামিম জামিআ রহিমিয়া হান্ডিপুরি কাশ্মীর।
১৫। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ সালমান মনসুরপুরী সাহেব, মুফতী মাদ্রাসা শাহী মুরাদাবাদ।
১৬। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ বেলাল হাসান নদভী সাহেব,নদওয়াতুল উলামা লক্ষ্ণৌ।
১৭। হযরত মাওলানা আবু বকর তয়্যিবী সাহেব,রুকনে শূরা কর্ণাটক মারকাযুস সুলতান শাহ।
১৮। প্রফেসর আখতারুলওয়াসি’ সাহেব, সদর যৌদপুর ইউনিভার্সিটি রাজস্থান।
১৯। হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ শাব্বির আহমাদ হুসাইনি সাহেব, মুহতামিম মাদ্রাসা ইসলাহুল বানাত ব্যাঙ্গলুর।

নির্দেশনাবলী :

১। লকডাউনের অতীত দিনগুলোর মত রমজানেও ইমাম মুআজ্জিন সহ মোট পাঁচজন ওয়াক্তিয়া নামাজের মত তারাবীহর নামাজেরও ইহতেমাম করবে। আর যদি মসজিদে সহজে একজন হাফেজ সাহেব মিলে যায় তাহলে পুরো রমজানে এক খতম কুরআন পড়ার চেষ্টা করবে অন্যথায় ছোট ছোট সূরা দিয়ে তারাবীহ আদায় করবে।

২। অন্যান্য মুসল্লীগণ পাঁচ ওয়াক্তের মত তারাবীহর নামাজে জামাতে বা একা একা আদায় করবে। যদি হাফেজ থাকে তাহলে তারবীহতে এক খতম কুরআনের চেষ্টা করবে, না হলে ছোট ছোট সূরা দিয়ে তারাবীহ শেষ করবে। পাশপাশি রমজানের রোযার খুব গুরুত্ব দিবে, কোন ওযর ছাড়া নামাজ, রোযা,তারবীহ ও অন্যান্য নফল ইবাদাত তরক করবেনা।

৩। ভাইরাস থেকে বাঁচতে ডাক্তার ও রাস্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া পরামর্শ যেমনঃ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরিধান করা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা,বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব দেওয়া সহ অন্যান্য সকল ব্যাপারে (মসজিদ হোক বা ঘরে,জামাতের সময় এবং জামাতের বাহিরে) খুব খেয়াল রাখবে।

৪। রমাজানের সাথে কোরআনুল কারীমের বিশেষ একটা সম্পর্ক আছ, তাই বেশি বেশি কোর’আন তেলাওয়াত করে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো।

৫। করোনা ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে সবার প্রতি অনুরোধ করা যাচ্ছে যে, আপনার বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবেন না।কোন দাওয়াত ও ইফতার পার্টিতে যাবেন না। রমজানের রাতে ও জরুরত ছাড়া বের হবেন। অবৈধভাবে গাড়ি চালাবেন না।মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাবেন না।

৬। সেহরির শেষ সময়ের জন্য ও ইফতারের সময়ের জন্য লাউড স্পিকারের ব্যাবহার করা যেতে পারে।সেহরির জন্য ঘুম থেকে জাগাতে মাইক না ব্যাবহার করাই ভাল।

৭.(ক) মহল্লার প্রত্যেক এতিম,গরীব,অসহায় চাই সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক তাদের প্রতি খেয়াল রাখা। তাদেরকে সাহায্য সহযোগীতা করা।

(খ)দেশের বিভিন্ন জায়গায় লক ডাউনে ও হোক কোওয়ারাইন্টানে থাকা ব্যাক্তিদের জরুরতের প্রতি,বিশেষ করে রোজাদারদের সেহরি ও ইফরমতারের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবে।এর সবচেয়ে সুন্দর পদ্বতি হলো প্রশাসন বা সরকারের সহযোগীতা নিয়ে মসজিদ বা অন্য কোন জায়গাকে সিলেক্ট করা যেতে পারে।

(গ)প্রত্যেক এলাকার যেখানে যেখানে আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা দ্বায়িত্বে নিয়োজিত আছেন তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে তাদের সাহায্য করা।

৮। দ্বীনের কল্যানকামী ভাইবোনদের প্রতি আবেদন এই যে,আপনারা মসজিদের খতীব,ইমাম,মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের প্রতি খেয়াল রাখার পাশাপাশি এই সমস্ত দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর দিকে ও নেক দৃষ্টি দিবেন।কেননা বেশীরভাগ মাদ্রাসার বাৎসরিক আয়-ব্যায় নির্ভর করে রমজানের চাঁদার উপরেই।

৯। যারা ধনী অথবা যথেষ্ট পরিমান সম্পদের মালিক আছেন,আপনার আপনাদের যাকাতের অর্থ যাকাতের হকদারদের কাছে পৌছে দিবেন,বিশেষ এই সমস্ত মাদ্রাসায় গিয়ে অথবা মাদ্রায়ার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট নাম্বারে পাঠিয়ে দিবেন।এতে করে আপনার যাকাত ও আদায় হবে এবং আপনার যাকাত হেফাজতেও থাকবে ইনশা’আল্লাহ।

১০। যারা কবরস্থানের মুতাওয়াল্লি ও যিম্মাদার আছেন, পাশাপাশি যারা কবরস্থানের নিকটস্থ বাসিন্দা আছেন তাদের প্রতি সুবিনিত অনুরোধ এই যে, করোনা ভাইরাসে মৃত ব্যাক্তিকে দাফন দিনে আপনারা বাধা দিবেন না। মনে রাখবেন এরা শহিদ এদেরকে কবর দিতে বাধা প্রধান করা সর্বচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টতা এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্পুর্ণ বিপরিত। মনে রাখবেন আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো কোন ক্ষতি হয় না।

১১। সাধারনত আমলের অবনতির কারনের পরিস্থিতির অবনতি হয়,আর আমলের উন্নতির কারনেই পরিস্থিতি সুন্দর হয়।তাই এই সময়টাকে সুবর্ণ সু্যোগ মনে করবো।আল্লাহর কাছে ফিরে যাবো।অত্যাধিক মাত্রায় আল্লাহর কাছে অতীতের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাইবো।আল্লাহর কাছে নিজের অক্ষমতাকে প্রকাশ করবো।

প্রিয় পাঠক! পরিশেষে আপনাদের কাছে আমার হাতজোড় অনুরোধ। দেশ, দশ সবাইকে বাঁচাতে ও নিজে বাঁচতে উপরের নির্দেশনাবলী আমাদের জন্যও অবশ্যই পালনীয়। সুতরাং ইন্ডিয়া আর আমরা ভিন্ন বলে পাশ না কাটিয়ে ‘আমরা মুসলমান’ স্লোগানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো মেনে চলি। আল্লাহ চাহেনতো এতেই আমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে।

(দেশ ও দশের জন্য আর মাত্র কয়েকটি দিন ঘরে থাকুন, সতর্ক থাকুন, সবাইকে বাঁচতে দিন। বেশি বেশি দোআ, তওবা, ইস্তিগফার, কান্নাকাটি করুন ও মাহে রমযানের প্রস্তুতি নিন।)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *