কাঁটছাট সিলেবাস: কওমী মাদ্রাসা হয়ে যাচ্ছে ‘ইলমহীন’

কাঁটছাট সিলেবাস: কওমী মাদ্রাসা হয়ে যাচ্ছে ‘ইলমহীন’

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

কদিন পরপর সিলেবাস পরিবর্তন। মানে সিলেবাস কাঁটছাট। অমুক কিতাব বাদ দিতে হবে। ওটার এখন প্রয়োজন নেই। মানতেক বাদ দাও! বর্তমানে মানতেকের   কোন দরকার নেই। আজ সুল্লাম -কুতবী বাদ তো কাল শরহেজামী ও গুলিস্তা বাদ। এভাবে দেদারসে কওমী মাদ্রাসার সিলেবাসকে কেটেছেটে ‘ন্যাড়া’ করে ফেলা হচ্ছে। কওমী শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন এর স্লোগান দিয়ে বহু কিতাবাদি এখন আর কওমীতে পড়ানো হচ্ছে না। সবশেষে এখন রব উঠেছে উর্দু- ফার্সি কওমী থেকে তুলে  দিতে হবে। কতকের দাবি, উর্দু- ফার্সিতে নাকি কোন ফায়দা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।  মানে কওমীর সিলেবাস এখন  অতি সংগোপনে আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসের দিকে পা বাড়াচ্ছে। কেউ এটা ঠাওর করতে পারছেনা। মানে আলিয়া মাদ্রাসার মত ইলমশূন্যতায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে কওমী মাদ্রাসাকে। কাঁটছাট সিলেবাসে কওমী মাদ্রাসা হয়ে যাচ্ছে ইলমহীন।

একসময় আলিয়া মাদ্রাসাতে কওমী মাদ্রাসার মত সকল কিতাব পড়ানো হত। উর্দু- ফার্সি ভার্সনও সেখানে ছিল। কিন্তু কিছু মানুষ স্লোগান উঠাল আলিয়া মাদ্রাসাকে আধুনিকায়ন করা দরকার। তার জন্য সিলেবাসের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। যেই কথা  সেই কাজ। একে একে বিভিন্ন কিতাব বাদ দেওয়া শুরু হল। বাদ দিতে দিতে এখন কিছু নামকেওয়াস্তে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  আধুনিক শিক্ষার প্রতি বেশী জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন আলিয়া মাদ্রাসাতে মূল কিতাব পড়া এবং পড়ানোর  ব্যাপারে গুরুত্ব নেই। ‘ন্যাড়া’ সিলেবাস। নোট-গাইডে ভরপুর। ছাত্ররা গাইড নির্ভর।   যে কারণে আলিয়া মাদ্রাসাতে ইলমী যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম পাওয়া দুস্কর হয়ে  পড়েছে।

ঠিক আমাদের কওমী মাদ্রাসাগুলো ওই পথে হাঁটছে। সিলেবাস থেকে আস্তে আস্তে   নানা কিতাব বাদ দেওয়া হচ্ছে। কওমীতেও এখন নোট – গাইডের আস্ফালন।  একদম ইবতেদায়ী থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত প্রায় সকল কিতাবের নোট- গাইড মুড়ি মুড়কির মতো বাজারে বিকাচ্ছে। সেই সাথে এখন কিছু মানুষ স্লোগান দিচ্ছে উর্দু- ফার্সি বাদ দেওয়া হোক। এ এক আজব তামাশা শুরু হয়েছে কওমী অঙ্গন জুড়ে।

আচ্ছা, আলিয়া মাদ্রাসাগুলো এত ‘আধুনিক’ হওয়ার পরেও কী সেখানে হাতে গোণা  কোন দুজন যোগ্যতা সম্পন্ন আলেম জাতিকে উপহার দিতে পেরেছে? আমরা খোঁজ নিলে দেখতে পাব আসলে সেখানে কোন গভীর জ্ঞান সম্পন্ন আলেম এখন তৈরী হচ্ছে না। সেখানে দু’ চারজন যা দেখা যায়, খোঁজ নিলে পাওয়া যাবে তাদের ভীত তৈরী হয়েছে কওমীতে। প্রাথমিক জীবন কওমী মাদ্রাসাতে লেখাপড়া করে এরপরে তিনি আলিয়াতে ভর্তি হয়েছেন। একদম খালেছ আলিয়াতে পড়া কোন মানুষ এখন যোগ্যতা সম্পন্ন আলেম তৈরী হচ্ছেনা।

আমাদের কওমী মাদ্রাসাগুলোও আজকাল আলিয়ার পদচিহ্নের উপর হাঁটছে।  এ শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করার নেশায় এখন যোগ্য আলেমের অভাব টের পাচ্ছে।  

তদ্রুপ আমাদের কওমী মাদ্রাসাগুলোও আজকাল আলিয়ার পদচিহ্নের উপর হাঁটছে।  এ শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করার নেশায় এখন যোগ্য আলেমের অভাব টের পাচ্ছে।

এর ডজনখানেক প্রমাণ আমাদের সামনে আছে। বোর্ড পরিক্ষায় মোমতাজ হচ্ছে,  মেধা তালিকায় স্হান পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু ইবারত পড়ার যোগ্যতা নেই। বাইরে সবকিছু ‘ফিটফাট’, ওদিকে ভিতরের অবস্থা পুরাই ‘মৈনট ঘাট’। নাহু- সরফ, ফিকহ, উসুলে    ফিকহ, হাদীস, উসুলে হাদীস কোনটার যেন জ্ঞান নেই। কাঁটছাট সিলেবাস পড়ে এখন ইলমশূন্যতায় ভুগছে।

অথচ সেই মূল সিলেবাস পড়ে যোগ্যতা সম্পন্ন আলেমের জন্ম হয়েছে। সেসময়ে ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রের যোগ্যতা ছিল। কিন্তু এখন অধিকাংশের যোগ্যতা নেই। সুল্লাম, মায়বুজী, কুতবী পড়ে যোগ্যতা সম্পন্ন আলেম তৈরী হয়েছে। আর এখন  আমরা সিলেবাসকে আধুনিকায়ন করেছি। বাংলা নোট গাইড ছাপিয়ে দিয়েছি। তারপরেও সেই আগের সিলেবাসে পড়া সাধারণ কোন আলেমের কাছে যাওয়ার যোগ্যতা নেই বর্তমানের বোর্ড স্ট্যান্ড ছাত্রের। মানে চরম মাশুল দিতে হচ্ছে আমাদের।

উর্দু- ফার্সির কোন প্রয়োজন নেই এই কথা বলাটা এটা আমাদের জন্য বড় বোকামী।  কেননা পার্শ্ববর্তি দেশগুলোতে উর্দু- ফার্সিতে ভরপুর। তারা উর্দু ভাষাভাষি। তাছাড়া সেখানে আমাদের সিলসিলার ওলামায়েকেরাম বসবাস করেন।  বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এখন উর্দুভাষি মানুষের বাস। এটা যেন ইন্টারন্যাশন্যাল ল্যাংগুয়েজের স্হানে চলে এসেছে। এছাড়া উর্দুতে রয়েছে হাজারো ফার্সি শব্দ। যেগুলো বুঝতে হলে ফার্সিভাষার জ্ঞানের প্রয়োজন। এজন্য উর্দু- ফার্সি একদম বেকার নয়।

একসময় আমাদের দেশে উর্দু- ফার্সির ব্যাপক প্রচলন ছিল। যেকারণে আমাদের বাংলাভাষার মধ্যে বহু উর্দু- ফার্সি শব্দ মিশ্রিত। অনেক কথার মধ্যে আমরা এখনো উর্দু- ফার্সি শব্দ ব্যবহার করে থাকি। মানে উর্দু – ফার্সি মিশানো বাংলাভাষা। এজন্য একজন স্লোগান উঠাল উর্দু – ফার্সি বন্ধ কর! আর আমরা সেদিকে ঝুকে গেলাম, এটা বড্ড বেমানান।

আজকাল অনেক বক্তা, অনেক লেখক তাদের লিখনী বা বক্তৃতায় উর্দু- ফার্সির বিদায় দেখতে চান। তবে হাস্যকর বিষয় হল, ওই বক্তাই যখন ওয়াজের ষ্টেজে বয়ান করতে ওঠেন তখন ফার্সি শের বলে মানুষকে মোহিত করে থাকেন। তেমনি লেখক যখন লিখতে থাকে তখন কিন্তু তার অজান্তেই তিনি ফার্সি শব্দের ব্যবহার  তার লিখনীতে ঘটান। অর্থাৎ উর্দু- ফার্সি ভাষা আমাদের জীবনের সাথে এমন ভাবে মিশে আছে, বাদ দিতে চাইলেও বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। বেশ কয়েকবছর আগের কথা, সৌদি আরবের একজন স্বর্ণের দোকানীকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনার এখানে সবচেয়ে কোন ভাষার কাস্টমার বেশী? তিনি জবাবে বলেছিলেন, উর্দুভাষার কাস্টমার সবচেয়ে বেশী। মানে উর্দুভাষা এখন সারা পৃথিবী জুড়ে। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা সবখানে উর্দুর প্রচলন রয়েছে।

দেখুন!  স্কুল – কলেজ – ভাসিটিতে বহু বই পুস্তক রয়েছে,যেগুলোকে আমরা নিরর্থক মনে করে থাকি। বহু সিলেবাস ছাত্রদের সামনে দেওয়া হয়েছে, সেসব না পড়লেও মানুষ শিক্ষিত হতে পারে। তারপরেও ওইসকল বই- পুস্তক সিলেবাসে রাখা হয়েছে। কেন রাখা হয়েছে? কী কারণে? যদি প্রশ্ন করা হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। তারা নিশ্চয়ই বলবেন, ওই সকল বই পুস্তক দ্বারা ছাত্ররা জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম। এ কারনে সিলেবাসে রাখা হয়েছে। ঠিকই প্রতিটি কিতাব থেকে ছাত্রদের জ্ঞানের দ্বার উম্মোচিত হবে। প্রতিটি ত্বলাবার যোগ্যতা তৈরী হবে। এজন্য কথায় কথায় কারণে – অকারণে কওমী অঙ্গন থেকে সিলেবাস কাঁটছাট করা সমিচীন নয়।

আল্লাহ আমাদের সহী বুঝ দান করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *